পঞ্চায়েত দখল করতে না পারলে করে খেতে পারবে না, তাই এত সন্ত্রাস
বিরোধীদের সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলে প্রতিরোধ ও সংঘর্ষ হত না
- Total Shares
দশ ঘণ্টার মধ্যে ১৩ জন মানুষ খুন হয়েছেন। এটা উদ্বেগজনক, তবে তার চেয়েও বেশি উদ্বেগের কারণ হল রাজ্যের মন্ত্রীদের এই সংখ্যাটাকেও যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না, বিক্ষিপ্ত বলে মনে হচ্ছে। এর চেয়েও অনেক বেশি লাশ কুড়োতে পারলে তবেই তাঁরা তাকে সন্ত্রাস বলবেন।
এখনও আমাদের দেশের আইনে সন্ত্রাস বলার জন্য মৃত্যুর কোনও সংখ্যা নির্দিষ্ট নেই, তাই ঠিক কত জন মানুষ হিংসার বলি হলে তাকে আমরা সন্ত্রাস বলে মনে করব? সন্ত্রাস হলেও তাকে সন্ত্রাস না বলার প্রবণতা আমাদের রাজ্যে দুশ্চিন্তার কারণ।
রাজ্যে ৩৪ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এই পঞ্চায়েতে ভোটের আওতার বাইরে। দেশের প্রত্যেক ভোটার একটি নির্বাচনে পাঁচ বছর অন্তর ভোট দেন, কিন্তু এই রাজ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভোট দিতে পারলেন না। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও বিজেপি সমর্থকদের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু এই এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকরাও ভোট দিতে পারলেন না। আমাদের রাজ্যের যিনি শাসক তিনি তাঁর সমালোচকদের তো পাত্তা দেনই না, সমর্থকদেরও পাত্তা দেন না। তিনি সরকার চালান অনুব্রত-আরাবুলদের ক্ষমতায়, সেখানে জনগণ কে যে তার সমর্থনের জেরে সরকার চালাতে হবে? এটা তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকদের পক্ষে কতটা মর্যাদার আমি সে কথা জানতে চাই।
সরকার বলছে যে সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য আমরা মনোনয়ন জমা দিতে পারিনি। আমাদের যদি মনোনয়ন জমা দেওয়ার কেউ সত্যিই না থাকত, তা হলে আমাদের এই হিংসা দেখতে হত না। যেখানে একজন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে যাচ্ছেন এবং তাঁর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানেই তাঁকে মনোনয়ন জমা দেওয়া থেকে আটকানোর দরকার হচ্ছে, তখনই সংঘর্ষ বাধছে। যেখানে মনোনয়ন জমা দেওয়ার লোক নেই, সেখানে তাদের আটকানোর প্রয়োজন নেই, সংঘর্ষ ও হিংসারও প্রয়োজন নেই।
আঘাত যেমন সত্যি নেমে এসেছে, প্রতিরোধও গড়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে
মুর্শিদাবাদের কথা ধরা যাক যেখানে জেলা পরিষদের বেশিরভাগ আসনে কোনও বিরোধী প্রার্থী নেই। আজ থেকে দু’বছর আগে এই জেলায় বিধানসভা ভোটে ২২টি আসনের ১৮টিতেই তৃণমূল কংগ্রেস গো-হারা হেরেছে। বিরোধীরা অর্থাৎ কোথাও সিপিএম ও কোথাও কংগ্রেস জিতেছে। যে জেলায় ২৪ মাস আগে ২২টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসনে তৃণমূল কংগ্রেস গো-হারা হেরে যায়, দু’বছরের মধ্যে সেখানে তৃণমূল ছাড়া আর কোনও প্রার্থী দেওয়ার লোক থাকে না?
বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারছে না, শাসকদল বলছে সংগঠন নেই তাই পারছে না। আজ দেখলাম সংবাদমাধ্যমের কর্মী সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মার খাচ্ছেন, গ্রামে ঢুকতে পারছেন না। এবার তো মন্ত্রীরা বলবেন সংবাদমাধ্যমের কোনও সংগঠন নেই, তাই খবর সংগ্রহ করতে পারছেন না। আমরা দেখতে পাচ্ছি বুথের পর বুথ দখল হয়ে গিয়েছে, পুলিশ থানায় বন্দি, তারা সাহস পাচ্ছে না সেই বুথে ঢোকার। আমরা অপেক্ষায় আছি কখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন যে আমাদের রাজ্যে পুলিশের কোনও সংগঠন নেই, তাই তারা তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে পেরে উঠছেন না। সুতরাং এ রাজ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল, সংবাদমাধ্যম, পুলিশ ইত্যাদি কারও কোনও সংগঠন নেই—যা সংগঠন শুধু তৃণমূলেরই আছে, তাই তারাই এ রাজ্যের মালিক। এই ব্যবস্থা আমরা কতদিন সহ্য করব?
আজ তো বটেই, গত এক মাস ধরে যে সন্ত্রাস আমরা দেখছি, মুখে কাপড় বাঁধা লেকজন মায়ের বয়সীকে একজনের কাপড় খুলে নিয়ে মাটিতে ফেলে লাথি মেরে চলেছে, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে মাটিতে ফেলে এমন ভাবে মারল যে তাঁর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গেল, গুলি করে দেওয়ার আগে দু’বার ভাবছে না—যারা এ সব করছে, তারা কারা? এরা তো কেউ পেশাদার অপরাধী ছিল না। অন্তত কয়েক বছর আগে পর্যন্ত। এরা তো সাধারণ পরিবারের সাধারণ ছেলে। আজ থেকে ছ’সাত বছর আগে এদের অন্য চেহারা ছিল। তা হলে আজ ওরা কেন এমন হয়ে গেল?
এই ছবি আজ থেকে দুবছর আগেও বাংলার বুকে কল্পনা করা যেত না
এই পাঁচ-ছ’বছর ধরে এই সরকার বাংলার যুব সমাজের জন্য না কোনও চাকরি, না কোনও ব্যবসা, না জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনও সম্মানজনক ব্যবস্থা করতে পেরেছে। তাই বাংলার যৌবনের একটা অংশের কাছে পঞ্চায়েত দখল এখন উপার্জনের একমাত্র রাস্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি পঞ্চায়েত কোনও ভাবে দখল করতে পারে তবেই কন্ট্রাক্টরদের থেকে কাটমানি খেয়ে, তোলাবাজি করে, বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা পকেটে পুরে সংসার চালাতে পারবে। যদি তা না পারে, দশটার মধ্যে আটটি পঞ্চায়েত জিতেও যদি দুটো পঞ্চায়েত কোনও ভাবে এদের হাতের বাইরে থেকে যায়, তাহলে সেই পঞ্চায়েত এলাকাগুলোতে তৃণমূল কর্মীদের করে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
তাই একদিকে এদের সন্ত্রাস দেখলে যেমন এদের উপরে ঘৃণা হয়, তেমনই এদের অসহায়তা দেখলে করুণাও হয়। এভাবে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, আমার-আপনার পাড়াতেও এরকম কিছু ছেলে তৈরি হয়েছে যাদের হাতে দশ হাজার টাকা ধরিয়ে দিলে এরা মানুষ খুন করতে প্রস্তুত। এই পরিবেশে আজকের বাংলায় দলমত, রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে কোন মানুষটা নিজের পরিবার নিয়ে নিরাপদে আছেন?
আমরা মাটি কামড়ে লড়াই করেছি বলেই এদের আসল চেহারাটা সারা দেশের মানুষের সামনে উঠে এসেছে
অনেক মানুষ একটা শুভ চিন্তা থেকেই মনে করেছিলেন এই প্রহসনের নির্বাচন আমাদের বয়কট করা উচিৎ। কিন্তু নির্বাচন বয়কট করা মানে হত, ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে মানুষকে লুটে খাওয়ার জন্য পাঁচ বছরের লাইসেন্স দেওয়া। সেটা আমরা করতে চাইনি। আমরা মাটি কামড়ে লড়াই করেছি বলেই এদের আসল চেহারাটা সারা দেশের মানুষের সামনে উঠে এসেছে।
সব শেষে আঘাত যেমন সত্যি নেমে এসেছে, প্রতিরোধও গড়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। বহু জায়গায় মানুষ বেরিয়ে এসে ভোট লুঠেরাদের তাড়া করে এলাকাছাড়া করেছে। এই ছবি আজ থেকে দুবছর আগেও বাংলার বুকে কল্পনা করা যেত না। আর এই প্রতিরোধে সবার সামনে থেকেছেন বামপন্থীরা, সেটাও মানুষ দেখেছে। আতঙ্ক যেমন ছড়িয়ে পড়ে, দুঃসাহসও তেমন ছোঁয়াচে। ঐক্যবদ্ধ মানুষের এই দুঃসাহস বাংলাকে লুঠেরাদের হাত থেকে রক্ষা করবে।