উন্নয়ন যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে তৃণমূলকে অস্ত্র হাতে সেই রাস্তাতেই দাঁড়াতে হল কেন?
তৃণমূল না বিজেপি - লোকসভা নির্বাচনেই বাংলার জনগণের পছন্দ জানা যাবে
- Total Shares
এটা কে তো ঠিক পঞ্চায়েত নির্বাচন বলা যাবে না। বলতে গেলে বলতে হয়, নির্বাচনের নামে প্রহসন। প্রথমে বিরোধীদের মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার থেকে বিরত করা। তার পর নির্বাচনের দিনে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে মানুষকে ভয়ে পাইয়ে অবাধে ছাপ্পা ভোট দিয়ে নিজেদের আসন নিশ্চিত করা। কিন্তু, এত কিছু করেও শেষ রক্ষা করা গেল না। কাগজে কলমে বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েত বা জেলা পরিষদগুলো তৃণমূল জিতে নেওয়া সত্ত্বেও এই নির্বাচন বিজেপির জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক। যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।
বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসকে ছাপিয়ে এখন রাজ্যের দু'নম্বর দল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিই যে প্রধান বিরোধী দল সে বিষয় আর কোনও সন্দেহই রইল না। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পঞ্চায়েতেও বিজেপি যে দু'নম্বরে শেষ করতে পেরেছে তাতে আমি কিন্তু অবাক হইনি। আমি শুধু ভাবছি যে প্রহসন না হয়ে যদি সত্যিকারের নির্বাচন হত তা হলে আজ বিজেপি কোথায় পৌঁছে যেত বা এই নির্বাচনে তৃণমূলেরই বা কী অবস্থা হত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পঞ্চায়েতে বিজেপি যে দু'নম্বরে শেষ করল তা অপ্রত্যাশিত ছিল না কেন?
নির্বাচনের নামে প্রহসন
উত্তর খুঁজতে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন ও তার পরবর্তী অধ্যায়ে। আসন সংখ্যা দিয়ে বিচার না করে আপনি যদি ভোটের হার দিয়ে বিচার করেন তা হলে দেখবেন ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন থেকেই মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে বিজেপি। এই লোকসভা নির্বাচনের পর যতগুলো উপনির্বাচন হয়েছে তার অধিকাংশতেই দু'নম্বরে শেষ করেছে বিজেপি প্রার্থীরা। যেমন ধরুন চৌরঙ্গী, কৃষ্ণগঞ্জ বা বনগাঁর মতো কেন্দ্রগুলোতে।
২০১৬ সালে দু'শোর উপর আসনে জিতে ক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি। এই নির্বাচনের আগে সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে নির্বাচনী বিশ্লেষকরা এমন একটা হাওয়া তুলে দিলেন যা শুনে মনে হলো বুঝি কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের সরকার গঠন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এতে বিভ্রান্ত হল মানুষ। আমি এখনও বিশ্বাস করি এই হাওয়া না তুললে ২০১৬তে বিজেপি খুবই ভাল জায়গায় ছিল। এমনকি, তৃণমূলকে হারিয়ে সরকার গঠনের ক্ষমতা বিজেপিরও ছিল।
এই বিধানসভা নির্বাচনের পরে বাংলার জনগণ কংগ্রেস ও বামেদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। সিপিএম এখন নেতৃত্বহীন। আর কংগ্রেস তো এখন জেলার দলে পরিণত হয়েছে যার অস্তিত্ব এখন শুধু মাত্র একটি জেলায়, বড়জোর দুটি জেলায়, রয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে মানুষ বিজেপিকেই বেছে নিয়েছে।
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পরে যে আট-ন'টি উপনির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে দুটি বাদ দিয়ে (সবং ও মন্তেশ্বর) প্রত্যেকটিতে দু'নম্বরে শেষ করেছে বিজেপি। সবংয়ে তিন নম্বরে শেষ করলেও এক ও দুইয়ের থেকে আমাদের খুব বেশি ভোট পার্থক্য ছিল না।
এই হিসেবে থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট। ২০১৪ লোকসভা ও ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই তৃণমূলের উপর চাপ বাড়ছে। আর তাই তো নির্বাচনের নামে প্রহসন করতে হল শাসকদলকে।
বিজেপিই এখন এ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল
ভাবতে পারেন মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়সীমা তিন দিন আর প্রত্যাহারের সময়সীমা সাত দিন। দেশের নির্বাচনী ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে এরকম উদাহরণ আর একটিও পাবেন না। হিসেবটা পরিষ্কার, ভাড়াটে গুন্ডা বা পুলিশ প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে বিরোধী মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হবে। তার জন্য পর্যাপ্ত সময় তো চাই।
আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। উন্নয়ন যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তৃণমূলি হার্মাদ বাহিনীকেও মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিনে ও নির্বাচনের দিনে সেই রাস্তাতেই দাঁড়াতে হল কেন?
তৃণমূলের উন্নয়নের বহর জঙ্গলমহলেই প্রকাশ পেয়েছে। এর আগে বামফ্রন্ট আমলেও প্রকট হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লোকসভায় লড়েছিল তৃণমূল। শুধুমাত্র মেদিনীপুর লোকসভা আসনে সমঝোতা হয়নি। সেই ভোটে বিজেপি প্রার্থী মনোরঞ্জন দত্ত সিপিএম, তৃণমূল ও কংগ্রেসের প্রার্থীদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ১ লক্ষ ৭৭ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে দু'নম্বরে শেষ করেছিলেন। বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ২০ শতাংশের বেশি ছিল। পরের বছরই সেই মনরঞ্জন দত্ত তিন লক্ষ ৮৫ হাজার ভোট পেয়ে দু'নম্বরে শেষ করল। বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ৮৫ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই নির্বাচনে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি বিধাসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থীই এগিয়ে ছিল।
২০১৯ নির্বাচন হবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কনিশনের অধীনে, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে আধাসামরিক বাহিনী
আসলে জঙ্গলমহলের জেলাগুলোতে বরাবরই বিজেপির শিকড় শক্ত। তাই তো এত প্রহসনের পরেও জঙ্গলমহলে তৃণমূল খুব একটা দাঁত ফোটাতে পারেনি।
তবে একটা বিষয় আমি নিশ্চিত ২০১৯ লোকসভায় পঞ্চায়েতের পুনরাবৃত্তি তৃণমূল করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কনিশনের অধীনে এই নির্বাচন হবে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীগুলো। কাজেই, পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সেই নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করতে পারবে না তৃণমূল।
তৃণমূল না বিজেপি, বাংলার জনগণের পছন্দের দল কোনটি - তার আভাস ২০১৯ নির্বাচনেই পাওয়া যাবে।