আদালতের ঐতিহাসিক রায়ে ডিজিটাল ভারতের পথে আরও এক ধাপ, ই-মেলের ভাবনা কী ভাবে?
কমিশনকে পরামর্শ দেওয়ার এক্তিয়ার কোনও রাজনৈতিক দলের নেই বলেও রায়ে জানিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট
- Total Shares
রেশন কার্ড, প্যান, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রাথমিক স্কুল-হাসপাতাল সর্বত্রই আবশ্যিক হয়েছে (বা হওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু হয়েছে) আধার লিঙ্ক। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বপ্নের ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় আধার লিঙ্ক থেকে এখনও বাদ রয়েছে ভোটার কার্ড। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে জমা দেওয়া মনোনয়নকে গ্রহণ করার জন্য কলকাতা হাইকোর্ট মঙ্গলবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে যে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নপূরণের দিকে আরও একধাপ এগোল দেশ।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার ও বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে ২৩ এপ্রিল বিকেল ৩টে পর্যন্ত যতজন প্রার্থী ইমেলে মনোনয়ন পাঠিয়েছেন সেগুলি গ্রহণ করতে হবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে।
কলকাতা হাইকোর্ট
২৩ এপ্রিল এক দিনের জন্য মনোনয়ন পেশ করার সুযোগ পেতেই বিডিও এবং এসডিও অফিসে ভিড় করেছিলেন প্রার্থীরা, কিন্তু উন্নয়ন যে ভাবে রাস্তা আগলে দাঁড়িয়েছিল, যে ভাবে মশারি খাটানো ছিল এবং স্প্রে করা হয়েছিল, তাতে প্রার্থীরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ক’দিন আগেই হোয়াটসঅ্যাপে পেশ করা মনোনয়ন গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত, তাই ওই দিন শেষ বেলায় ই-মেল করে মনোনয়ন পেশ করতে শুরু করে দেয় সিপিএম। সেই মনোনয়ন গ্রহণ করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়। সিঙ্গল বেঞ্চ তা খারিজ করে দিলেও এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ অবশ্য বিকেল ৩টে পর্যন্ত দাখিল করা সব মনোনয়ন গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনকে। শুধু তাই নয়, এমন ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনও ছুতোতেই সেই মনোনয়ন বাতিল করতে না পারে নির্বাচন কমিশন। ৮০০-র বেশি মনোনয়ন ইমেল মারফত দাখিল করা হলেও, বিকেল তিনটের মধ্যে ২৫টি ইমেল থেকে ৬২টি মনোনয়ন জমা পড়েছিল। তবে মোট ৮০০টি মনোনয়ন জমা পড়েছিল।
কতগুলি মনোনয়ন গ্রাহ্য হল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আসল হল এই রায়ের ফলে একটি নতুন দিগন্ত খুলে গেল। অন্তত নির্বাচনপ্রক্রিয়ার প্রথম পর্বে ইমেল করে মনোনয়ন দাখিল করতে পারবেন প্রার্থীরা। ভোটগ্রহণ তার অনেক পরে।
অত্যাচারের মুখেও মনোনয়ন প্রত্যাহার করেনি কাঁকসার সিপিএম প্রার্থী ছবি ওরাং, ফেসবুকে জানিয়েছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র
শুরুটা হয়েছিল মাত্র দিন কয়েক আগে। তবে বর্তমানই যাঁদের খোঁজ রাখে না, ইতিহাস তাঁদের মনে রাখবে কেন? প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপ আর পরে ই-মেল—ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে দাখিল হওয়া মনোনয়ন গ্রহণ করার নির্দেশ যে আদালত দিয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছে ভাঙড়ের জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি। তাঁদের নেত্রী শর্মিষ্ঠা চৌধুরী প্রথমে ভাঙড় ২ পঞ্চায়েত সমিতির একজন ও পোলেরহাট ২ গ্রামপঞ্চায়েতের ৮ জন নির্দল সদস্যকে নিয়ে বিডিও অফিসে মনোনয়ন জমা করতে যান। সেখানে জমা না দিতে পেরে তিনি প্রার্থীদের নিয়ে চলে যান আলিপুরে। সেখানেও জমা দিতে যখন পারছেন না, তখন বিডিও-র মোবাইল নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ করে দেন মনোনয়নপত্র। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদার হোয়াটসঅ্যাপে জমা দেওয়া মনোনয়ন গ্রহণ করার নির্দেশ দিতেই মনোনয়ন পেশ করার ক্ষেত্রে খুলে যায় নতুন দিগন্ত।
এর আগে অবশ্য সর্বদল বৈঠকে এমন একটা প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলি, যদিও আইনের নির্দিষ্ট ধারা দেখিয়ে নির্বাচন কমিশন তা খারিজ করে দেয়। কিন্তু ২৩ এপ্রিল যখন মনোনয়ন জমা দিতে পারছেন না প্রার্থীরা, তখন সিপিএমের সদরদপ্তর থেকে ইমেল করে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। মনোনয়নের সময় যখন প্রায় শেষ, তখন তড়িঘড়ি করে ই-মেল করা শুরু হয়। যদিও বেশিরপভাগ মনোনয়নই জমা পড়ে নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে।
এখনও ছড়িয়েছিটিয়ে আছে হিংসার চিহ্ন
সিপিএম নেতা রবীন দেবের বক্তব্য, তাঁরা আগে চেষ্টা করেছেন সশরীরে মনোনয়ন দাখিল করতে। কিন্তু কিছুই যখন পারছেন না, তখন শেষ বেলায় ইমেল করতে শুরু করেন প্রার্থীরা। প্রথমে তাঁদের আবেদন সিঙ্গল বেঞ্চে খারিজ হয়ে যায়, কিন্তু পরে ডিভিশন বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক নির্দেশ দেয়।
নির্বাচনের অর্থ কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে কী ভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, সেই প্রশ্নই তোলেন মামলায় আবেদনকারীরা। শেষ পর্যন্ত সেই আবেদনেই মান্যতা দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। এই ভাবে মনোনয়ন দাখিল করলে শুধু যে নির্বাচনে হিংসা ও রক্তপাত এড়ানো যাবে তাই নয়, প্রতিনিধিত্বও আরও বাড়বে বলে মনে করে আদালত। তা ছাড়া কমিশনকে পরামর্শ দেওয়ার এক্তিয়ার কোনও রাজনৈতিক দলের নেই বলেও এ দিন রায়ে জানিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।
কোনও বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন না থাকলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই আইনের সমতুল হয়। তাই আগামী দিনে ভোটে সময় ও খরচ বাঁচাতে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করতেই পারে দেশের নির্বাচন কমিশন। পদে যিনিই থাকুন, আগামী দিনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনও মনোনয়নের ক্ষেত্রে একটি উপায় হিসাবে ই-মনোনয়ন রাখতেই পারে।