এনআরসি: আদালতের আদেশ, সরকারের অবস্থান ও কয়েকটি প্রশ্ন
ভারত আগে সত্যিই ধর্মশালা ছিল, এখন গোশালা হয়েছে
- Total Shares
এনআরসি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান কী, তা আমাদের দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমাদের দলনেত্রী বলেছেন। আমরা বিস্মিত হলাম যখন দেখলাম যে এক কলমের খোঁচায় ৪০ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়ার মতো একটা অবস্থা তৈরি হল।
এনআরসি-র বিরোধিতা করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়
বলা হচ্ছে যে এটি চূড়ান্ত নয়, তবে চূড়ান্ত খসড়া। যাঁদের নাম বাদ গেছে, যদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকে তা হলে তাঁরা এর পরেও নাম তোলার জন্য আরেকটা সুযোগ পাবেন। এখানে আমাদের কয়েকটা প্রশ্ন আছে।
প্রথমত, যে সব মানুষ একাধিক প্রমাণপত্র দিয়েছেন তাঁরা আবার কেন নথি দেবেন এবং নতুন করে কী নথিই বা তাঁরা দেবেন? সরকার বলেছে ১৬টি নথির মধ্যে যে কোনও একটি গ্রাহ্য হবে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে, যেমন রেশন কার্ড, ভোটার তালিকায় নাম প্রভৃতি। বহু মানুষ এ রকম অনেকগুলো প্রমাণপত্র দেওয়া সত্ত্বেও তাঁদের নাম বাদ পড়ে গেছে। তাঁরা আবার নতুন করে এগুলি দেবেন? এটা কি প্রহসন হচ্ছে না? তাঁরা তো একবার সব নথি জমা দিয়েছেন!
দ্বিতীয়ত, ৩০ অগস্ট থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ ৩০ দিনের মধ্যে ৪০ লক্ষ লোক নতুন করে আবেদন করতে পারবেন বলে বলা হচ্ছে। আমার মতে বাস্তবে এটা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। ৩০ দিনের মধ্যে না ৪০ লক্ষ লোক তাঁদের দাবি জানাতে পারবেন, না প্রশাসন উপযুক্ত ভাবে শুনানির পরে এই ৪০ লক্ষ দাবির প্রেক্ষিতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে পারবে। মানুষের পক্ষে এই কাজ এই সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়। এটা অবাস্তব ভাবনা, লোকদেখানো পদক্ষেপ।
তৃতীয়ত, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, যা কিছু করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে করা হয়েছে এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত সংসদে এ কথা বলেছেন। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট কি বলেছে যে পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও ৩০ লক্ষ বা ৪০ লক্ষ বা ৫০ লক্ষ লোককে বাদ দিয়ে দিতে?
মিলিয়ে দেখা হচ্ছে নাম (সংবাদ সংস্থা)
রিট পিটিশন নম্বর ১০২০/২০১৭ অনুযায়ী, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে ওই মামলার আদেশে সুপ্রিম কোর্ট ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলেছে, “Citizens who are originally inhabitants/residents of the State of Assam and those who are not are at par for inclusion in the NRC” অর্থাৎ, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী, যে সমস্ত নাগরিক অসম রাজ্যের মূল বাসিন্দা তাঁরা এবং যাঁরা মূল বাসিন্দা নন তাঁরা একই ভাবে এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য, যদি তারা ওই পরিচয়পত্র দাখিল করতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশ কি মান্য করা হয়েছে? এই আদেশ মান্য করা হয়নি বলেই ৪০ লক্ষ লোক এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, কারও যদি প্রমাণপত্র থাকে তাঁদের বাদ দেওয়া হবে না। আর বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে বলছেন, এই ৪০ লক্ষ লোক হলেন ঘুসপেটিয়া, অর্থাৎ এই ৪০ লক্ষ লোকই হলেন অনুপ্রবেশকারী, এঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। কেউ কেউ আবার বলছেন, ভারত কি ধর্মশালা?
ভারত ধর্মশালা হতে যাবে কেন? বিজেপি সরকার এবং বিজেপি নেতৃত্ব তো ভারতকে গোশালা বানিয়ে ফেলেছে। ভারত এখন গোশালা। বিবেকানন্দ যে ভারতের কথা বলেছিলেন শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের বক্তৃতায়, তখন ভারতবর্ষ সত্যিই ধর্মশালা ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন এসে ভারতে বসবাস করেছেন, এমনকি অধুনা পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতাতেও। আমরা বিশ্ব তো বটেই, ভারতের ক্ষুদ্র সংস্করণ। আমাদের এখানে পর্তুগিজ এসেছে, মোগল-ব্রিটিশ-ডাচরা এসেছে। কলকাতায় চায়না টাউন আছে। এখানে গুজরাটিরা আছেন, পার্সিরা আছেন—সকলেই ভারতের সংস্কৃতি মেনে শান্তিতে বসবাস করছেন। এঁরা সকলেই বাংলার মানুষ আর অসম তো বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল!
এনআরসিতে নাম তোলা তখনও চলছিল (এএফপি)
তাই বহু মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে বংশপরম্পরায় কাছাড়, শিলচর ও নাম্নী অসমের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছেন। অসম বাংলার অংশ ছিল বলে এখানেও বিভিন্ন জনজাতির বহু মানুষ বসবাস করছেন বহু বছর ধরে, তাঁদর বংশধররা সেখানে রয়ে গেছেন। তাঁরাও বিদেশি? তাঁরাও অনুপ্রবেশকারী? কোনও ব্যাখ্যা নেই।
চতুর্থত, অভিযোগ তোলা হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রক্তগঙ্গার কথা বলেছেন। রক্তগঙ্গা তো বয়েছে অসমে! একবার নয়, একাধিক বার। ১৯৬০ দশকে ওখানে বঙ্গাল খেদা আন্দোলন হয়েছে। ১৯৮০-র দশকে নেলী ও নেলী সংলগ্ন ছয়টি গ্রামে ৩০০০ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এ কাজ করেছিলেন আসু আন্দোলনকারীরা। তাদের স্লোগানও ছিল বঙ্গাল খেদা। এখন যিনি মুখ্যমন্ত্রী সেই সর্বানন্দ সোনোয়ালও আসুর আন্দোলনকারী ছিলেন। আমরা ঘরপোড়া গোরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো ডরাবই!
যাঁরা অসমীয়া ভাষায় কথা বলেন না, তিনি বাঙালি হতে পারেন, হিন্দিভাষী বিহারী হতে পারেন, নেপালি হতে পারেন, তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া থেকে। এক লক্ষ মতো নেপালি, ৭০ হাজার হিন্দিভাষী বিহারীকে বাদ দেওয়া হয়েছে, দক্ষিণ ভারতের কিছু সংখ্যক মানুষকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা স্থানীয় ভাষায় কথা বলেন না, তাঁরা সকলেই হচ্ছেন বিদেশি, অনুপ্রবেশকারী—অমিত শাহের ভাষায় তাঁরা ঘুসপেটিয়া, তাঁদের বের করে দেওয়া হবে!
কোনও শাহ বা শাহেনশা ঠিক করে দিতে পারে না কে বিদেশি আর কে বিদেশি নন। ভারতে যদি আইনের শাসন থেকে থাকে, তা হলে আমাদের দেশে ফরেনার্স অ্যাক্ট বা বিদেশি আইন আছে। এই আইনের বিভিন্ন ধারায় বলা আছে কাউকে বিদেশি হিসাবে চিহ্নিত করতে গেলে তার একটি আইনি প্রক্রিয়া আছে। তাঁকে ট্রাইবুনালে প্রমাণ করতে হবে তিনি বিদেশি কিনা। সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার করে ট্রাইবুনাল দেখবে কে বিদেশি, কে বিদেশি নয়। ট্রাইবুনালের সেই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যাবে, তারপরে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যাবে। এখন ওঁরা ঘুরিয়ে সেটাই বলছেন।
আইন আছে ঠিকই, এই ৪০ লক্ষ মানুষ কী ভাবে ট্রাইবুনালে যাবেন? এই ৪০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র এবং পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের লোক। আর্থিক কারণে তাঁরা হাইকোর্টের দরজা অবধিই পৌঁছাতে পারবেন না, সুপ্রিম কোর্ট তো দূরঅস্ত্।
১৯৫১ সালে প্রথম এনআরসি হয়েছিল। তখন সব ঠিকঠাক চলছিল। তারপরে আসু আন্দোলনকে আটকানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী একটি চুক্তি করলেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে, যাকে বলা হয় অসম অ্যাকর্ড, ১৯৮৫। একই ভাবে মিজোরামের সঙ্গে করা হল মিজোরাম অ্যাকর্ড এবং পঞ্চাবে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য করা হল পঞ্জাব অ্যাকর্ড। তিনটি চুক্তিই হয়েছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এর মধ্যে অসমে চুক্তিটি হয়েছিল আসু আন্দোলনকারীদের সঙ্গে।
১৯৮৫ সালের চুক্তি কার্যকর করা হচ্ছে ২০১৮ সালে। পৃথিবীর কোথায় এই ধরনের নজির আছে যে ৩৩ বছর বাদে একটি চুক্তি কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে? এখানে এক মুহূর্তে ৪০ লক্ষ মানুষকে নিজভূমে পরবাসী করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রতিবাদ এখানেই। গণতান্ত্রিক পথে আমরা প্রতিবাদ করছি। আমরা সেই পীড়িতদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। জোর করে, বেআইনি ভাবে, গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে যে আচরণ আমাদের সঙ্গে অসম পুলিশ করেছে, তাতে আমরা শুধু বিস্মিত ও হতবাক নই, আমরা শুধু এই ঘটনার নিন্দা করছি না, আমরা মনে করি এর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সংসদে এসে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
আমাদের সংবিধানের ১৯ ধারায় বলা আছে, ভারতের যে কোনও নাগরিক ভারতের যে কোনও জায়গায় যেতে পারবে। সেই অধিকার হরণ করা হয়েছে। ২১ ধারায় বলা হয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের কথা। আমাদের সেই মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হল। আমরা সাংসদ হিসাবে আলাদা সুযোগসুবিধা চাইনি, আমরা সাংসদরাও পাবলিক সার্ভেন্ট। বিশাল সংখ্যক মানুষ যখন সমস্যায় পড়েছেন, সেটা খতিয়ে দেখার অধিকার পাবলিক সার্ভেন্ট হিসাবে সাংসদ ও বিধায়কদের রয়েছে। গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার মেনেই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম।
বিমানবন্দরে আটকানো হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ও বিধায়কদের (নিজস্ব চিত্র)
গিয়ে দেখলাম শিলচর বিমানবন্দর কার্যত অধিগ্রহণ করে ফেলেছে রাজ্যের অধীনস্ত পুলিশ ও প্রশাসন। বিমানবন্দর তো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান, যার নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করার কথা সিআইএসএফ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য বাহিনীর। কিন্তু আমরা দেখলাম সেখানে কোনও কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই, সেখানে বিশাল সংখ্যক পুলিশকর্মী মোতায়েন রয়েছে, সংখ্যাটি কোনও ভাবেই ২০০র কম নয়। সঙ্গে রয়েছেন কয়েক ডজন নবীন আধিকারিক। তাঁরা পুরো বিমানবন্দর নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছেন।
আমরা যে বিমানে কলকাতা বিমানবন্দের আসি সেই বিমানে আরও ৭৭ জন যাত্রী ছিলেন। তাঁদের বাইরে যেতে দেওয়া হল। আমার প্রশ্ন, আমাদের কেন যেতে দেওয়া হল না? রাজ্যে তখন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আমরা বললাম যে আমরা ৪ জনের কম দলে ভাগ হয়ে আমরা যাব। যদি তিন জন করে যাই তা হলে আমাদের ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না। যাঁরা প্রশাসনিক পদে আছেন তাঁদের তো আইনের ধারাগুলি জানা উচিত! ওখানে উপস্থিত কেউ আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। যে কারণে অন্য যাত্রীদের তাঁরা যেতে দিলেন, সেই একই কারণে আমরাই তো যেতে পারি। আমাদের তাঁরা কী ভাবে আটকাবেন? ওঁরা বললেন, “স্যর আমরা নিরুপায়।” একেই কি বলে গণতন্ত্র? এটাই কি আইনের শাসন?
আমার সঙ্গে যখন এই সব আইনি কথা চলছে তখন দেখি আমাদের সঙ্গে যে মহিলা জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন, পুলিশ তাদের কাউকে মারছে, কাউকে তাড়া করছে। অসভ্যতা-বর্বরতার চূড়ান্ত নজির। আমি নিষেধ করলাম, বাধা দিতে গেলাম। আমাকে পর্যন্ত ধাক্কা দেওয়া হল। অথচ আমার যে পেসমেকার আছে, সেই সংক্রান্ত নথি আমি আগেই দেখিয়েছি। আমার পেসমেকার আছে বলে এই সংক্রান্ত কার্ড আমার সঙ্গে সব সময়ই থাকে যাতে বিমানবন্দরে আমার নিরাপত্তা-তল্লাশির সময় মেটাল ডিটেক্টর জাতীয় কিছু ব্যবহার না করে। এই ধাক্কাধাক্কিতে আমার বড় বিপদ হতে পারত, মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারত।
এই সব করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূল কংগ্রেসকে আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে রাখা যাবে না। আমরা গণতান্ত্রিক পথে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যদি একজনও অসহায় মানুষ আমাদের সাহায্য চান তা হলে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করব। এই ফ্যাসিস্ত নীতির বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে এবং চলবে।