সরকারের নতুন সংরক্ষণ নীতিতে সুবিধা পাবেন না কেউই
এটি হল গুজরাট মডেলের উদাহরণ, গুজরাটে এই আইন বাতিল করেছে আদালত
- Total Shares
সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম ভেঙে সংরক্ষণ বিল সংসদে পেশ করেছে সরকার। পাঁচ রাজ্যে সদ্য প্রকাশিত ভোটের ফল দেখে অনেকটা প্যানিক বাটনে হাত রা.খার মতো করেই এই বিল সরকার এনেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, যিনি নিজে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেছেন, তাঁর সম্মতিতে এই বিল আনা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘও (আরএসএস) সংরক্ষণের বিরুদ্ধেই। নীতিগত বিরোধী হয়েও তারা বিল আনল। তবে এই বিল যদি আইনও হয় তা হলেও বাস্তবে কারও কোনও লাভ হবে না, কারণ সরকারি চাকরির তো সুযোগই তৈরি হচ্ছে না! উল্টে তা কমছে।
সংসদে জানানোর আগে সংরক্ষণ বিল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে সরকার। (ছবি সৌজন্য: লোকসভা টিভি)
সরকার যে ‘বিকাশ মডেল’-এর কথা বলেছিল তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে সকলের উন্নতি হবে, কোটি কোটি বেকার কাজ পাবেন, বিনিয়োগ হবে, পুরো দেশে গুজরাট মডেল হবে, দেশের উন্নতি হবে। এখন সরকার যেটি করছে সেটিই গুজরাট মডেল। নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি একই কাজ করেছিলেন -- সংরক্ষণের বিল এনেছিলেন এবং আদালত সেটি বাতিল করে দিয়েছিল।
উচ্চবর্ণের জন্য যে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ করা হচ্ছে সেটিকে দরিদ্রদের জন্য সংরক্ষণ বলা হচ্ছে। এর বাস্তবিক অর্থ অন্য, এর ব্যাখ্যাও ভিন্ন। এই বিল অনুযায়ী যাঁদের বার্ষিক আয় আট লক্ষ টাকার কম, মহানগরে ১০০০ বর্গফুটের আবাস -- তাঁরা গরিব, কিন্তু তাঁরা কি সত্যিই গরিব? আয়কর তাঁদেরই দিতে হয় না যাঁদের বার্ষিক আয় আড়াই লক্ষ টাকা বা তার কম, আর এখানে সেই মাত্রা আট লক্ষ টাকা! অর্থাৎ সত্যিই যাঁদের জন্য সংরক্ষণ প্রয়োজন তাঁরা এই সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন না।
তা হলে এর মূল উদ্দেশ্য কী?
দিল্লির সরকার একটা কাজ করে দেখিয়েছে। শিক্ষার অধিকার আইন হওয়ার পরে দিল্লির সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি পদক্ষেপ করে। যে সব বেসরকারি সংস্থা সরকারি জমিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করবে বা হাসপাতাল গড়বে সেখানে বাধ্যতামূলক ভাবে গরিবদের সুযোগ দিতে হবে, এই মাত্রা হল ২০ শতাংশ।
এক্ষেত্রে সেই ধরনের কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। বস্তুত যারা প্রকৃতই গরিব তাঁদের যেটুকু সুযোগ রয়েছে, নিজেদের ভোট ব্যাঙ্কের কথা ভেবে সেই সুযোগে ভাগ বসাতে চাইছে বিজেপি। তা ছাড়া ভোটের আগে এটি একটি বার্তাও বটে – আমরা কি কিছুই করতে পারিনি, এই দেখ করে দিলাম গোছের একটা বার্তাও দেওয়া হয়ে গেল বিজেপির পক্ষ থেকে।
এখন দেশে নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হওয়া দূরের কথা, কাজের যে সুযোগ ছিল তাও সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ জব লস হচ্ছে। গত এক বছরেই ১ কোটি ১০ লক্ষ কাজের সুযোগ কমেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির নাভিশ্বাস উঠছে, ব্যাঙ্কের অবস্থাও তথৈবচ। সেখানে এই সংরক্ষণের কোনও অর্থই হয় না। এটি পুরোপুরি অর্থহীন।
বিতর্কসভায় বলছেন মহম্মদ সেলিম। (ছবি সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
রাজনৈতিক কথা বাদ দিয়ে যদি দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের পদ্ধতি দিয়ে এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয় তা হলেও দেখা যাবে যে সরকার সংসদীয় রীতি লঙ্ঘন করেছে।
সংসদ শুরু হওয়ার আগে সর্বদলীয় বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সরকার জানিয়ে দেয় যে আসন্ন সংসদীয় অধিবেশনে সরকার কোন পথে চলতে চাইছে। সেখানে জানানো হয় যে কোন কোন খসড়া সরকার পেশ করতে চাইছে। তার উপরে আলোচনাও হয়। সেখানে জানানো হয় আসন্ন অধিবেশনে কোন কোন বিল আনা হচ্ছে। অনেক সময় সংসদের অধিবেশন সুষ্ঠু ভাবে চালানোর জন্য অধিবেশন শুরুর আগেই বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে সরকার। এ বার সংসদের অধিবেশন শুরু আগে যখন বৈঠক হয়েছিল তখন এই বিলের উল্লেখ সেখানে ছিল না।
কী বিল আনা হবে, কোন কোন বিল পাস করানো হবে সে সব বিষয়ও সাংসদদের জানিয়ে দেওয়া হয়। কোন কোন বিল নিয়ে আলোচনা হবে সে কথাও জানিয়ে দেয় সরকার। সেখানেই এই বিলের কথা ছিল না।
আমাদের সাপ্তাহিক বৈঠকও হয়। সেখানে আগামী সপ্তাহের কর্মসূচি জানিয়ে দেয় সরকার। সেখানেও এই বিলের কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রতি সোমবার লোকসভার অধ্যক্ষ বিজনেস অ্যাডভাইসরি কমিটির বৈঠক করেন, তার মধ্যেও মঙ্গলবার এই বিষয়টি থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়নি। তার অর্থ এই বিলের কথা লোকসভার অধ্যক্ষ নিজেও জানতেন না।
প্রথমে রাফাল নিয়ে বিতর্ক চলছিল। যেই সরকার জানল যে অলোক ভার্মাকেই সিবিআই পদে পুনরায় বহাল করার পক্ষে রায় দিচ্ছে আদালত (যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁকে ওই পদে রাখা হয়নি) তখনই সরকার প্যানিক বাটনে হাত দিয়ে দিল।
নিয়ম হল, সংসদ চলাকালীন নীতিগত কোনও সিদ্ধান্ত সংসদের বাইরে ঘোষণা করা হয় না, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। সংসদের অধিবেশন চলাকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই বিল পাস করিয়ে তা সংসদকে না ঘোষণা করে দেওয়া হল সংবাদমাধ্যমে। সরকারের নিজের কথা অনুযায়ী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত, তা হলে সংসদকে এড়িয়ে সেই সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা করে দেওয়া হল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সংসদীয় রীতি ভাঙার অভিযোগ উঠেছে। (ছবি সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
সরকারের উচিত ছিল সংসদীয় রীতি মেনে এই বিলের কথা আগে সংসদে জানানো। সরকার সেই কাজ না করে, সংসদের বাইরে বিলের কথা ঘোষণা দিল। বিল পাস করানোর জন্য রাজ্যসভার অধিবেশন এক দিন বাড়িয়ে দেওয়া হল।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বিভিন্ন পদ খালি রয়েছে। সেই সমস্যা মেটানো যাচ্ছে না, কারণ সরকার এখনও আইন আনতে পারছে না রোস্টার সিস্টেমের জন্য। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সরকার তার ইচ্ছা অনুযায়ী কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করে। অলোক ভর্মার ক্ষেত্রে এক দিনের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করা সম্ভব হলেও অন্য ক্ষেত্রে সরকারের সেই তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী যে সব কমিটির প্রধান সাধারণত সেই সব সব কমিটির বৈঠক এক দিনের বিজ্ঞপ্তিতে বসানো সম্ভব হয় না প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততার জন্য। প্রধানমন্ত্রী সময় দিতে পারেন না বলে মাসের পর মাস সেই সব বৈঠক হয় না। অথচ সংরক্ষণ বিলের ক্ষেত্রেও দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী সময় পেলেন বৈঠক করার, অলোক ভার্মার ক্ষেত্রেও সময় পেলেন।
সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি ভেঙে এই বিল এনেছে এবং তা সমাজের কোনও অংশের কথা ভেবে নয়, সরকার এই বিল এনেছে তিন রাজ্যে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে ভয় পেয়ে এবং ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে।