নেপালিরা কেন পরের বারও মোদী সরকার চাইছেন
মোদীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নেপালি নেতৃত্বের, দু'দেশের সম্পর্ক অটুট রাখতে যা খুবই দরকারি
- Total Shares
নেপালের ইতিহাসের সবচেয়ে টালমাটাল সময়ে আমি চার চারটি বছর সে দেশে কাটিয়েছি।
তখন নেপালে মাওবাদী বিদ্রোহ তুঙ্গে। আমি নেপালে থাকাকালীন নেপাল রাজপরিবারে সেই কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল। ভাগ্যের জোরে আইসি- ৮১৪ বিমানে অপহরণ হতে হতে বেঁচে গেছি। সে দেশে আমি ভারত-বিরোধী আন্দোলনেরও শিকার হয়েছি, যখন আমাদের কার্যালয আক্রমণ করে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছিল। এত কিছুর পরেও আপনি অবশ্য নেপালের প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য, য়েমন আমিও পড়েছিলাম।
বেশ কিছুটা লম্বা সময পার করে আবার সেই দেশে ফিরে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে দারুণ একটা ব্যাপার। মাঝের সময়টা শুধুমাত্র বর্তমান পরিস্থিতির পার্থক্যটা বুঝিযে দেয় না, অতীতের কথাও মনে করিয়ে দেয়। এই নতুনের মধ্যে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই একটা অন্য আবেশ তৈরি হয়।
জীবনের কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কোনটা কতক্ষণ থাকবে তা নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্রের উপরে। যেমন রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর - কুড়ি বছর বাদেও বিমানবন্দরটির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি, এখনও সেই আগের মতোই ভজকট একটা অবস্থা। উড়ানের সংখ্যা মাত্রাছাড়িয়ে বেড়েছে। এখন এই বিমানবন্দর থেকে ২৭টি মতো আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থার ৪০টি আন্তর্জাতিক বিমান প্রতিদিন ওঠা-নামা করে। এর কারণ, নেপালের সঙ্গে চিন ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক অনেকটাই বেড়েছে।
বর্তমানে পুরো নেপাল জুড়ে ৪০টিরও বেশি চালু রানওয়ে রয়েছে। কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন ৪০০টিরও বেশি অন্তর্দেশীয় বিমান ওঠা-নামা করে। ভারত এখন 'উড়ান' প্রকল্পের কথা বলছে যেখানে 'হাওয়াই চপ্পল' পরে লোকে 'হাওয়াই জাহাজে' উঠবে। নেপালিরা অবশ্য বহু দিন ধরে এই কাজটি করে আসছে। যদিও নেপালের বিমানসুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে এবং সে দেশের কোনও ঘরোয়া বিমানই বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও বিমান পরিষেবা সে দেশের আমজনতার লাইফলাইন। সে দেশের পার্বত্য পর্যটনেও বিমান পরিষেবার অবদান অনস্বীকার্য।
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর [সৌজন্য: উইকিম্যাপিয়া কমন্স]
কাঠমান্ডুর রাস্তাগুলো অনেকটাই চওড়া হয়েছে। কিন্তু তা এখনও শহরের ক্রমবর্ধমান চারচাকা গাড়ি ও দু-চাকার গাড়ির চাপ সামলানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। নেপালে গাড়ি কিনতে হলে মোটা অঙ্কের আমদানি শুল্ক দিতে হয়, তা ছাড়া জ্বালানির দামও অনেকটাই বেড়েছে। কাঠমান্ডু জুড়ে তাই যানজট লেগেই থাকে। কাঠমান্ডুতে বেশ কিছু অট্টালিকাও গড়ে উঠতে শুরু করেছে। নির্মাণশিল্পের এই বাড়বাড়ন্তের জন্য শহরের হাওয়াও দূষিত হতে শুরু করে দিয়েছে। তাই পথেঘাটে ঢাকার (নেপালি টুপি) থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ মুখোশ ব্যবহার বেশি চোখে পড়ে।
বরঞ্চ পোখরাকে দেখলে বেশি পরিষ্কার বলে মনে হয়। জায়গাটির উন্নয়নও বেশ রুচিসম্পন্ন ভাবে হয়েছে। ফেওয়া লেকের সংলগ্ন রাস্তায় রেস্তোরাঁ বা পানশালার ভিড় দেখলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পর্যটন কেন্দ্রগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। বেশ কয়েকটি অসাধারণ হোটেল তৈরি হয়েছে এই অঞ্চল জুড়ে। তাই অঞ্চলের পরিবেশটাও বেশ 'বিলাসবহুল' হয়ে উঠেছে।
তবে, এখানে পৌঁছেই আমি জানতে পারলাম, সত্যিকারের পরিবর্তন দেখতে হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যেতে হবে। মাওবাদী আন্দোলনের সময়ে এই অঞ্চলগুলিতে যাওয়ার কথা কল্পনাও করা যেত না। শেষ কয়েক বছরে এই অঞ্চলগুলোতে গ্রামীণ পর্যটন চালু হয়েছে এবং পর্যটকদের জন্য বেশ কয়েকটি ভালো মানের থাকার জায়গাও গড়ে উঠেছে।
পুণর্নির্মানের কাজ নেপাল জুড়েই চলছে [ছবি: পিটিআই]
২০১৫ সালের ভূমিকম্পের পর এখনও অনেক জায়গাতেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। কাঠমান্ডুর অন্যতম আকর্ষণ বৌদ্ধস্তুপ ভূমিকম্পে বেশ ক্ষত্রিগ্রস্ত হয়েছিল। সেটিকেও পুরোনো রূপে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে পাটান ও ভক্তপুরের ক্ষতিগ্রস্ত কাঠামোগুলোকে নতুন করে তৈরির কাজ এখনও অনেকটাই বাকি রয়েছে। স্বভাবতই এর প্রভাব সংস্কৃতিমনস্ক পর্যটকদের উপর পড়েছে।
এত গেল বাইরের পরিবর্তনের কথা। নেপালিদের ভিতরেও কিন্তু আরও গভীর পরিবর্তন ঘটেছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভিতরে। তাঁরা এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। সুযোগের অভাব রয়েছে - এমন অনুশোচনার কথা এখন খুব বেশি শোনা যায় না। এই পরিবর্তনের কিছুটা হয়তো এই প্রজন্মের মানসিকতার জন্য হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগটাই হয়েছে দেশের বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য।
প্রথমে প্রজাতান্ত্রিক হয়ে ওঠা আর এখন দ্রুত ফেডারেল পরিকাঠামোয় নিজেদের গড়ে তোলা - এর ফলে দেশের ক্ষমতায়ন অনেকটাই বেড়েছে। খারাপ সময়টাও এখন খুব সহজে নেপাল কাটিয়ে উঠতে সক্ষম, এর ফলে গণতন্ত্র ও মানুষের নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাসটা আরও সুদৃঢ় হয়েছে।
বৌদ্ধ পর্যটন থেকেও লাভবান হচ্ছে নেপাল [সৌজন্য: ফেসবুক]
সরকারের শীর্ষস্তরে যতই ওঠা-পড়া থাকুক না কেন, যতই মিউজিক্যাল-চেয়ার খেলা হোক না কেন, আমজনতা অব তৃণমূল স্তরে পরিবর্তনটা বেশ উপলব্ধি করতে পারছে।
যে হারে দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে তা থেকে এই বিষয়টি বেশ মালুম পাওয়া যাচ্ছে, বিশেষ করে তরাই অঞ্চলে (চিনের সাহায্য নিয়ে) যা মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণ করতে চিন দু'দুটি সিমেন্ট কারখানায় বিনিয়োগ করেছে। আবাসন ও পরিকাঠামো শিল্পের চাহিদা পূরণ করতে আঞ্চলিক সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোও নিজেদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে।
আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন চোখে পড়ছে। বাংলাদেশি মডেলকে হাতিয়ার করে ওষুধ শিল্পেও প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে। প্রথম পর্যায়ে নিজেদের চাহিদা পূরণের লক্ষ্য রাখা হয়েছে, পরবর্তী ক্ষেত্রে জেনেরিক ও অন্য ওষুধ বিপুল পরিমাণে রফতানি করতে হবে। নেপালের বৌদ্ধ সার্কিটগুলোতে চিনা তীৰ্থযাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এতদিন ধরে অবশ্য জাপান ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর তীর্থযাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল।
নেপাল-চিন সীমান্তে নতুন নতুন ট্রানসিট পয়েন্ট খুলছে আর এর সঙ্গে সড়ক ও রেল সংযোগ তৈরি হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলো নিয়ে নেপাল অনেকটাই আশাবাদী। তবে এর চেয়ে বেশি করে নেপালিদের মধ্যে 'মনোভাবের' পরিবর্তনের বিষয়টি লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে নেপালিরা এই উন্নয়নগুলোকে 'ভারতকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে' বলে ভাবত। কিন্তু এখন তাদের চিন্তাধারা যথেষ্ট সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। এখন আর সেই 'পাল্টা দেওয়ার' মনোভাবটা নেই।
যদিও নেপালিরা এখনও ২০১৫ সালের 'অবরোধ'-এর কথা ভুলতে পারেনি কিন্তু সেই স্মৃতি আজ আর তেমন তাজা নেই। অনেকেই ভারতের সেই সিদ্ধান্তকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখে। কারণ, এর পর থেকেই নেপাল ভারতকে বাদ দিয়ে চলার কথা চিন্তাভাবনা শুরু করে।
আর এই উপলব্ধিটাই সবচেয়ে বেশি নেপালের তরুণ প্রজন্ম করতে পেরেছে। কিছুটা হলেও নেপালের সমৃদ্ধশালীরা এই উপলব্ধি আরও আগেই করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদেশি ছাত্রসংখ্যার নিরিখে ভারতের স্থান দশম।
কিন্তু এখন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যেও এই উপলব্ধিটা তৈরি হয়েছে।
মোদীর সঙ্গে নেপালের নেতৃত্বের একটি যোগাযোগ গড়ে উঠেছে [ছবি: রয়টার্স]
নেপালি ছেলে ও মেয়েদের চিনে যাওয়ার সংখ্যাও বেড়েছে। পোখরার এক ট্যাক্সিচালক তাঁর ছেলেকে স্নাতকস্তরে পড়াবার জন্যে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর কথা চিন্তা করেছেন। ছেলেটি এখন সেখানে আংশিক সময়ে কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর মতো প্রয়োজনীয় আয় করে নেয়। খুব সম্ভবত ছেলেটি অস্ট্রেলিয়াতে রয়েও যাবে।
নেপালিরা বহু দিন ধরেই কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। এখন তাঁরা বেশি মাইনের পেশাদার চাকরি পছন্দ করছেন। কাঠমান্ডুতে বিদেশি ভাষার শিক্ষাকেন্দ্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে। আর এর ফলে আঞ্চলিক লোকবলের ঘাটতি ঘটছে। এই অভাব পূরণ করতে ভারত থেকে রিভার্স মাইগ্রেশনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে (অনেকে অবশ্য বাংলাদেশ থেকেও নেপালে কর্মসংস্থানের জন্য যান)। আমাকে বলা হয়েছে প্রায় ছ'লক্ষ ভারতীয় শ্রমিক এখন নেপালে কর্মরত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসবের সঙ্গে ভারত-নেপাল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যোগসূত্র কোথায়? নিঃসন্দেহে, মোদীর নেপাল সফরের পরে দুদেশের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠেছিল। 'অবরুদ্ধের' পর মোদী নেপাল সফর করে থাকলেও কোথাও কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। নিজের সরকারের প্রথম বার্ষিকীতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি ওলি বলে ছিলেন, গত একবছরে ভারত-নেপাল সম্পর্ক এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। তিনি অমায়িক ভাব দেখিয়েছেন, এমন কথা ভাবার কোনও কারণ নেই।
নেপালের তরুণ প্রজন্মের মানসিকতায় অনেকটা বদল এসেছে। তাদের চাহিদা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেকটাই বেড়েছে। তারা এখন ভারতের সঙ্গে আত্মবিশ্বাস সম্বল করে যোগাযোগ করতে চায়, নির্ভরশীল প্রতিবেশী হিসেবে নয়। তারা মনে করে, ভারত তাদের অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে পেরেছে।
এই প্রেক্ষাপটেই অনেকেই চান যে নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করুন ।
জোট সরকার ক্ষমতায় এলে সম্পর্কে আবার চিড় ধরতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। মোদীর সঙ্গে সে দেশের নেতৃত্বের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠছে - যা পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপর নির্ভরশীল। দুই দেশের সম্পর্ক অটুট রাখতে এই সম্পর্ক নিতান্তই প্রয়োজনীয়।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে