মোদীর নেপাল সফরের পরেই দুই কমিউস্টদলের বিভাজন আরও বেড়েছে
প্রশ্নের মুখে পড়ে মোদী নেপাল ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন ওলি
- Total Shares
নরেন্দ্র মোদীর নেপাল সফরে আবার রাজনৈতিক তুফান উঠল হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ছোট দেশটিতে। বর্তমানে সেই দেশ ক্ষমতায় রয়েছে দুই বাম শরিক - কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউএমএল) এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (এমসি)। কিছুদিন আগে অবধি নেপাল সরকারকে দেখে বেশ শক্ত বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু মোদীর সফরের পরেই সরকারের ভিত কিছুটা হলেও নড়ে গেছে। একই সঙ্গে, নেপালে মোদীর সফরের পরে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী খড়্গপ্রসাদ শর্মা ওলি তাঁর 'জাতীয়তাবাদী' তকমা হারাতে চলেছেন।
মোদী নেপাল ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন ওলি। সংসদে তাঁর বক্তৃতায় ওলি স্বীকার করে নিয়েছেন যে এই সফর বাতিল না করার পিছনে তাঁর সরকারের কিছু দুর্বলতা ছিল। তবে এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে দু'দেশের সম্পর্ক চিরদিন খারাপ থাকতে পারে না। তাই তিনি দেশের দেশপ্রেমিক জনতাকে সরকারের উপর আস্থা রাখবার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন যে, অতীতের ভুল যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য নেপাল সরকার সদা সচেষ্ট।
বক্তৃতায় নেপালের প্রধানমন্ত্রী জানান যে, তিনি দেশের বিদ্বজনেদের ও সংবাদমাধ্যমের উদ্বেগ যথেষ্ট গুরত্ব দিয়ে বিচার করেছেন। দু'দেশের সম্পর্ক কী ভাবে জোড়া লাগানো যায় তা বোঝাতে ওলি এ বছর জুনে অনুষ্ঠিত হতে চলা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উনের বৈঠকের উদাহরণ টেনেছেন।
তবে এত কিছুর পরেও, ওলিকে বেশ বিচলিত বলেই মনে হল কারণ মোদীর সফর ঘিরে নেপালের জনতার মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে এবং এর ফলে তিনি তাঁর 'জাতীয়তাবাদ' তকমা হারিয়েছেন।
বিলম্বিত সম্পর্ক স্থাপন
নেপালের বামপন্থীদের এক করবার প্রতিশ্রুতি নিয়েই ওলির ইউএমএল ও প্রচণ্ডর এমসি এক সঙ্গে সাধারণ নির্বাচনে লড়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি এখনও পূরণ হয়নি এবং মোদীর সফরের পর তা আদৌ পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেশ দানা বেঁধেছে। দুটি দল এখনও এক হতে পারেনি বলে দলের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে যথেষ্ট অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।
২২ এপ্রিল লেনিনের জন্মবার্ষিকীর দিনে নেপালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের সময় দুই শরিক দলের সদস্যরা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং তীব্র বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এমসি সদস্যরা অভিযোগ তুলেছেন যে ইউএমেল সমর্থকরা রীতিমতো জেদ দেখিয়ে মঞ্চের উপর লেনিনের ছবি বসাতে দেয়নি। এছাড়াও, এমসি পার্টির সদস্য সমর্থকদের অভিযোগ ছিল যে অনুষ্ঠানের স্বাগত বার্তায় ওলিকে যে ভাষায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সেই মাত্রায় প্রসংশা প্রচণ্ডের জন্য স্বাগত বার্তায় বরাদ্দ ছিল না।
শুধুমাত্র লেনিনের ছবি মঞ্চে তোলার পর ও প্রচণ্ডকে নিয়ে আবার নতুন করে স্বাগত বার্তা পড়ে শোনানোর পরেই মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।
মোদীর নেপাল সফর পিছিয়ে দিল দেশের দুই বামপন্থী দলের এক হওয়ার প্রক্রিয়া
নির্বাচনের পর থেকেই ওলি ও প্রচণ্ড তাঁদের সমর্থকদের বলে চলেছেন যে দুই দলের এক হয়ে যাওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। প্রথমে এই প্রক্রিয়া ওলির ভারত সফরের আগেই সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তার পর বলা হয়েছিল যে মোদীর ফিরতি নেপাল সফরের আগে এই প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলা হবে। মাসখানেক আগে ওলি ও প্রচণ্ডর মধ্যে সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং দু'টি দলের বেশ কিছু নেতাকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে। এই দলের প্রাথমিক দায়িত্ব দুই দলের এক হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত জটিলতা রয়েছে তার সমাধান খুঁজে বের করা।
মোদীর সফর ও ফাটল
জনকপুরে মোদীর বিমান অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে দুই দলের সম্পর্ক ফাটল দেখা দিতে শুরু করল। মোদীর সফরের সময় প্রচণ্ড নিজেকে আড়ালে রাখলেন। তাঁর দলের মন্ত্রীরাও সরকারি অনুষ্ঠাগুলোতে অনুপস্থিত ছিলেন। একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বয়ং নেপালের শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী বর্ষামান পান উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, তাঁকে নাকি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণই করা হয়নি।
এর পরে মাওবাদী নেতারা কাঠমান্ডুতে মোদীর গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠান বয়কট করেন। এরকম খবরও শোনা যাচ্ছে যে ওলি নাকি এমসি নেতৃত্বের দেওয়া সমস্ত প্রস্তাবই নাকচ করে দিচ্ছেন। একই সঙ্গে প্রচণ্ডর পরামর্শও শুনছেন না।
প্রচণ্ড কি সম্পর্ক ছেদ করবেন?
এখনও পর্যন্ত একটি বিষয় পরিষ্কার নয় - ইউপিএল নেতৃবৃন্দ কি প্রচণ্ডের নেতৃত্বের উপর বিশ্বাস করেন? নব্বইয়ের দশকের তৈরি হয়েছিল ইউএমএল এবং তখন থেকেই ইউপিএল এমসি-কে শ্রেণী শত্রু হিসেবে গণ্য করে এসেছে।
দু'দলের রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশ কিছু প্রাণহানিও হয়েছে। দুটি দল এখন এক সঙ্গে সরকার চালাচ্ছে, অথচ ইউএমএলের ওয়েবসাইটে এখনও ৪৯০ জন কর্মীর তালিকা দেওয়া রয়েছে যাঁরা নাকি এমসি কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে এই এক হওয়ার ব্যাপারে মাওবাদী নেতৃত্বও উৎসাহ হারিয়েছেন। সরকারে দলীয় নেতাদের খুব একটা পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। দলের যুব শাখা বা আন্তর্বিষয়ক বিভাগ কিন্তু চায় না যে দুটি দল এক হোক। তবে এই বিষয় শেষ কথা অবশ্যই প্রচণ্ডই বলবেন।
প্রচণ্ড অবশ্য ওলিকে কিছুটা সময় দিয়ে পরখ করে নিতে চাইছেন। দু'জনেই ক্ষমতা চান এবং দু'জনেই জানেন যে একের অপরের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তাঁদের বোঝা উচিৎ যে এই এক হওয়ার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে কারও কোনও লাভ হচ্ছে না।
এই প্রক্রিয়া শীঘ্র শেষ না করতে পারলে জোটে ভাঙন অবশ্যম্ভাবী। সেক্ষত্রে ওলি অবশ্য এ কূল ও কূল দুই কূলই হারাবেন।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে