কর্নাটক বিধানসভা ভোট ২০১৮: নরেন্দ্র মোদী কেন পিছনের সারিতে
বিজেপির মুখ কৌশলী মোদী জানেন, হাওয়া খারাপ হলে কী করতে হয়
- Total Shares
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যিনি প্রতিটি ভোটে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, এই প্রথমবার বড় একটি রাজ্যের ভোটে তিনি পিছনের সারিতে। ভোটে বিজেপির প্রধান মুখ এবং ইন্দিরা গান্ধীর পরে সবচেয়ে বেশি সমীহ আদায় করে নেওয়া নেতা সেই নরেন্দ্র মোদীর হয়তো এবার বোধোদয় হয়েছে।
কর্নাটক বিধানসভা ভোটের মতো সেমি-ফাইনালে তিনি ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বাজিতে লাগিয়ে ‘আহত ও অবসৃত’ হতে চান না। ভোটে বিজেপির প্রধান কাণ্ডারী হিসাবে ফাইনাল ম্যাচ, মানে ২০১৯ সালের ভোট পর্যন্ত নিজের সম্পদ, শক্তি ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে নরেন্দ্র মোদীকে।
এর কারণ, এবার উল্টো পথে হেঁটে, বিজেপি ভোটে জিতলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন সে কথা আগেই ঘোষণা করে রেখেছে বিজেপি। কর্নাটকের জমিতে লড়াই যে সহজ নয়, সে কথা মেনে নিয়েই বিএস ইয়েদ্যুরাপ্পাকে দলের তরফে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। একমাত্র দক্ষিণী রাজ্য, যেখানে আগে বিজেপি জিতেছে এবং জেতার ক্ষমতা রাখে, সেখানে নিজের কৌশল বদল করা ছাড়া মোদীর অন্য কোনও উপায়ও ছিল না।
ইয়েদ্যুরাপ্পাকে প্রার্থী করার বেশ কয়েকটি নেতিবাচক দিক রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুটি নেতিবাচক দিক হল তাঁর বয়স এবং কলঙ্কময় অতীত। এখন তাঁর বয়স ৭৫ বছর। এই বয়সটাই হল দলের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে মোদীর ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে। তাই বয়সের জন্য নয়, তাঁদের রাজনৈতিক ওজস্বীতার জন্যই জোর করে অবসর নিইয়ে মার্গদর্শী মণ্ডলে পাঠানো হয়েছে, এ কথা মনে করার করার যথেষ্ট যুক্তি থাকবে বিজেপির অবিসংবাদী নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশী ও যশবন্ত সিনহাদের।
উত্তরপ্রদেশের নেতা কলরাজ মিশ্র ও নাজমা হেপতুল্লারও প্রশ্ন তুলতে পারেন ৭৫ বছর হওয়া মাত্রই তাঁদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে।
ইয়েদ্যুরাপ্পার সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হল তাঁর কলঙ্কময় অতীত। দুর্নীতির প্রশ্নে মোদী কখনোই কংগ্রেস ও বিরোধী নেতাদের ব্যাপারে সুর নরম করেননি এবং সততার ব্যাপারে চিরকালই বিজেপিকে আলাদা করে তুলে ধরেছেন। কিন্তু ২০১১ সালে দুর্নীতির অভিযোগে যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়েছিল, সেই নেতার ব্যাপারে তাঁকে নমনীয় হতে হয়েছে। লোকায়ুক্তের রিপোর্ট তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করার পরেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন।
তাঁকে তুলে ধরার ব্যাপারে বিজেপির রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল, কারণ ইয়েদ্যুরাপ্পা দল ভাঙানোর জন্যই বিজেপি পরাজিত হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হওয়ায় তিনি কর্নাটক জনতা পক্ষ (কেজেপি) নামে একটি দল গঠন করেন এবং ২০১৩ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপির লিঙ্গায়ত ভোট ব্যাঙ্কে ধস নামান।
কূটকৌশলী এই বৃদ্ধ নেতার ক্ষমতা সম্বন্ধে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল। ২০১৩ সালে বিজেপি পর্যুদস্ত হওয়ার ইয়েদ্যুরাপ্পার সেই স্মরণীয় উক্তি, “আমি বিজেপিকে বুঝিয়ে দিয়েছি আমি না থাকলে কী হবে।”
বিহার, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং অতিসম্প্রতি গুজরাটে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কাউকে তুলেই ধরেনি বিজেপি, সেই সব রাজ্যের মতো কর্নাটকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদী। এর কারণ হল, মোদী জানেন যে কর্নাটকে কংগ্রেসই এগিয়ে। লোকসভা ভোটের আগে তাই তাঁর স্টার ক্যাম্পেনার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছেন না নরেন্দ্র মোদী।
বিজেপির দিক দিয়ে বিচার না করে মোদীর দিক দিয়ে বিচার করলে ইয়েদ্যুরাপ্পা হলেন শাপে বর। কর্নাটকে বিজেপি হারলে তার দায়ভার মোদীকে বইতে হবে না, বইতে হবে ইয়েদ্যুরাপ্পাকে।
বিজেপি ভেঙে কেজেপি গড়ার সময় যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন এখন সেই সমর্থকদের ক্ষোভ সামলাতে হচ্ছে ইয়েদ্যুরাপ্পাকে, কিন্তু এখন সেই ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। ২০১৩ সালের ভোটে যাঁরা কেজেপির টিকিটে লড়েছিলেন বা অল্পের জন্য হেরেছিলেন, তাঁরা এখন প্রার্থীপদের দাবিদার। এই সংখ্যাটাও কম নয়, কেজেপি জিতেছিল ছ’টি আসনে এবং ৭০টি আসনে তারা দ্বিতীয় তো হয়েইছিল, কোথাও কোথাও বিজেপি বা কংগ্রেসকে কঠিন লড়াইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এই সব আসনে এখন দাবিদার উভয়েই— কেজেপি ছেড়ে আসা লোকজন এবং বিজেপির লোকজন। এটি অবশ্য বিজেপির অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে ইন্ধন দিতে পারে।
যদি কর্নাটক নিয়ে নরেন্দ্র মোদী কিছুটা কুঁকড়ে থাকেন, তা হলে বলতে হয়, অমিত শাহও চাপ রাখতে না পেরে এলোমেলো কথা বলে ফেলছেন। অমিত শাহ পর্দার পিছনে থেকে কৌশল স্থির করা নেতা, তিনি জননেতা নন। এখন তাঁকে আচমকাই জনসভায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তাই তিনিও জনসমক্ষে অসংলগ্ন এমন সব কথা বলছেন তাতে কংগ্রেস তো বটেই, রাহুল গান্ধীও তা নিয়ে কৌতূক করতে ছাড়ছেন না।
যে দিন ভোট ঘোষণা হল, সে দিনই অমিত শাহ একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসলেন। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার কথা বলতে গিয়ে মুখ ফস্কে তিনি বলে ফেললেন, ‘সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলেছেন, যদি সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা হয়, তা হলে ইয়েদ্যুরাপ্পা সরকার তাতে প্রথম স্থানে থাকবে।” এমন কথা শুনে ইয়েদ্যুরাপ্পা মোটেই খুশি হননি। ভোটের প্রচারে আরও অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটিয়েছেন বিজেপির ধারওয়ার্দের সাংসদ প্রহ্লাদ জোশী। কর্নাটকে তফসিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য সিদ্দারামাইয়া কোনও কিছুই করেননি বলে আক্রমণ করে এবং নরেন্দ্র মোদীই তাঁদের জন্য যা করার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু সেটি কন্নড়ে তর্জমা করতে গিয়ে প্রহ্লাদ জোশী বলে ফেলেন, “তফসিলি জাতি-উপজাতির জন্য নরেন্দ্র মোদী কিছুই করবেন না।” তাঁর এই ভুল খেয়ালই করেননি অমিত শাহ, তিনি বক্তৃতা করে যেতে থাকেন। অস্বস্তি এড়াতে জোশীও বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে উপস্থিত জনতা এ নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। এতদিন এই দল মহানন্দে
ছদ্ম-বিজ্ঞান এবং রূপকথার সঙ্গে ইতিহাস মিশিয়ে সে সব প্রচারে মত্ত ছিল, আর এখন অমিত শাহের এমন বেফাঁস কথা যেন কর্নাটকে বিজেপির টলমলে ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।বুদ্ধিমান ও কৌশলী হওয়ায় মোদী জানেন, হাওয়া খারাপ বুঝলে কী করতে হয়।