পুলওয়ামা জঙ্গিহামলা ও এক 'দেশপ্রেমিক' প্রধানমন্ত্রীর কাহিনী
মোদী মনে করছেন দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে পারলেই তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার করে যাবেন
- Total Shares
অনেকটা এক সঙ্গে জোড়া লাগা যমজদের মতোই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উগ্র-জাতীয়তাবাদ থেকে আলাদা করতে পারাটা দুষ্কর। জাতীয়তাবাদ মাঝে মধ্যেই নিঃশেষ হতে পারে। কিন্তু মোদী নিজের মধ্যে থাকা জাতীয়তাবোধ ব্যক্ত করতে এতটাই মরিয়া যে, আমার মতে, পুলওয়ামা জঙ্গি হানায় ৪০জন সিআরপিএফ কর্মীর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ বার্তা আদানপ্রদান করে তিনি তাঁর খুশি চেপে রাখতে পারেননি।
পাকিস্তানের মদতপুষ্ঠ মৌলানা মাসুদ আজহারের জঙ্গি গোষ্ঠী জৈশ-ই-মহম্মদ এই পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার দায়ে স্বীকার করে নিয়েছে। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে নির্মম। কিন্তু ভারত যেভাবে দিবানিদ্রা দিচ্ছিল তাও যথেষ্ট নিন্দনীয়; কী ভাবে ছ'শো পাউন্ড আরডিএক্স সকলের নজর এড়িয়ে গেল, এই বিষয়টিও কিন্তু যথেষ্ট চিন্তার বিষয়।
উগ্র জাতীয়তাবোধে বিশ্বাস করেন নরেন্দ্র মোদী [ছবি: পিটিআই]
কিন্তু মোদীর মতো একজন 'নিখুঁত' রাজনীতিবিদ জাতীয় সুরক্ষাকে প্রাধান্য না দিয়ে যুদ্ধংদেহী মেজাজে নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়লেন। বিরোধীদের তুলোধোনা করে তাদেরকে দেশদ্রোহীর তকমা দিয়ে দিলেন (এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সরকারি টুইটার হ্যান্ডেলকেও বিরোধীদের দেশদ্রোহী ঘোষণা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে)।
এই পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে খুব খারাপ সঙ্কেত বহন করে। মোদী যেভাবে শহীদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললেন তাও অত্যন্ত কুরুচিকর রাজনীতি বলে আমি মনে করি।
পুলওয়ামাতে ঠান্ডা মাথায় চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ানকে খুন করা হয়েছিল। এর পর ভারত পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়ার বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক করল। উইং কমান্ডর অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানের হাতে বন্দি হলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁকে মুক্তিও দেওয়া হল। এই ঘটনা প্রবাহের মাঝে মোদী নিজেকে বোঝাতে চাইলেন যে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ এবং সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেই তিনি আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের বৈতরণী পার করতে পারবেন।
কিন্তু, ঘটনা হচ্ছে, পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার পরেও আরও ২০জন নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। জম্মুতে একটি বাসে বোমা ফাটানো হয়েছে, যে ঘটনায় একজন কিশোর নিহত হয়েছেন ও আরও তিরিশজন আহত হয়েছেন। কিন্তু মোদী অনড়; মূলস্রোত সংবাদমাধ্যমের মোদী-অনুগামীরা এখনও মোদীর মত ও নীতি প্রচার করে চলেছেন।
পুলওয়ামা জঙ্গিহামলা কী ভাবে সম্ভব হল তা নিয়ে উত্তর দিক মোদী সরকার [ছবি: রয়টার্স]
সেনাবাহিনীর একদল প্ৰাক্তন আধিকারিক এদের সমর্থন করে চলেছেন। সেনাবাহিনীর এই প্রাক্তন আধিকারিকরা বীর বিক্রমে যুদ্ধে ডাক দিচ্ছেন। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, সার্জিকাল স্ট্রাইকের মূল লক্ষ হচ্ছে তরুনদের অনভূতি বুঝে চলা, ভোট ব্যাঙ্ককে মজবুত করা ও বিভ্রান্ত ভোটারদের নিজেদের দলে টানা। যে কোনও মূল্যেই এখন ২০১৯ সালের নির্বাচন জিততে মরিয়া ভারতীয় জনতা পার্টি। তার জন্য অন্য সব কিছুই অপেক্ষা করতে পারে।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের দাবি বালাকোটের জৈশ শিবিরে ২৫০জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য এমনিতেই অমিত শাহের নাম রয়েছে (যেমন তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে গতবার বি এস ইয়েদিরাপ্পা বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের অংশ ছিলেন)। কিন্তু তাঁর এই দাবি দেখে মনে হচ্ছে যে এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে তিনি এতটাই আহ্লাদিত ছিলেন যে সংখ্যাটা রাউন্ড ফিগারে দিতে ভোলেননি।
তবে তাঁর সামনে এখন কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। হিসেবে নিকেশ করে বিএসওয়াই পূর্বাভাস দিয়েছেন যে কর্নাটকে বিজেপি ২৮টির মধ্যে ২২টি আসন পাবে। অন্যদিকে, যোগী আদিত্যনাথ কিন্তু অমিত শাহের এই জঙ্গি মৃত্যুর 'আন্দাজ' নিয়ে বেশ ক্রুদ্ধ। আদিত্যনাথের মতে, মৃত্য জঙ্গিদের সংখ্যা কমপক্ষে চারশো হওয়া উচিত ছিল। বিজেপির উত্তর পূর্বাঞ্চলের 'কুঠার-মানব' খ্যাত হিমন্ত বিশ্ব শর্মা একটি টম ক্রুস মার্ক ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, জনগণ যদি বিজেপিকে ভোট না দেয় তাহলে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসবে।
অমিত শাহ দাবি করছেন এয়ার স্ট্রাইকে ২৫০জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে [ছবি: পিটিআই]
শর্মা মনে করেন যে পাকিস্তানের এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানগুলো ভারতের আকাশে জেট এয়ারওয়েজের বিমানগুলোর পাশাপাশি উড়তে উড়তে অবলীলাক্রমে পশ্চিম থেকে পূর্বে পৌছিয়ে যাবে। কেউ তাদের সনাক্তও করতে পারবে না। আমার মতে, এইভাবে আলটপকা মন্তব্য করে ভারতীয় বায়ুসেনার যোগ্যতাকে অসম্মান করাটাই কিন্তু দেহদ্রোহীতার লক্ষণ। মোদী মহাশয়, আপনার কী মত?
সহজ সরল ভাষায়, বিজেপি মনে করতে শুরু করে দিয়েছে পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার পর তারা দেশাত্মবোধের আবেগকে তুলে ধরে নিজেদেরকে দেশের সীমান্তের একমাত্র রক্ষাকর্তা বলে প্রমান করতে পারবে। বেকারত্ব, গ্রামীণ বিপর্যয়, রাফাল বিতর্ক, দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ কিংবা অর্থনৈতিক ব্যর্থতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে মোদী একেবারেই চিন্তিত নন।
উল্লেখ্য, বায়ুসেনার চিফ মার্শাল বিএস ধানওয়া সরকারের মন্তব্যের উল্টো পথে গিয়ে দাবি করেছেন যে এয়ার স্ট্রাইকে কতজনের মৃত্যু হয়েছে সে সম্পর্কিত কোনও সংখ্যা তাদের কাছে নেই। কিন্তু তা দিয়ে বিজেপিকে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তারা উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সেই ছবিতে দলীয় প্রতীক পদ্ম লাগিয়ে রাজনীতি করে চলেছেন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডিএস হুদাও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন [সৌজন্যে: টুইটার]
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বেশ বোকা বোকা গল্পকরণে মত্ত ছিল গোটা ভারত। মূলস্রোত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সঞ্চালকরা সর্বদাই বদলার কথা শুনিয়ে গেলেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডিএস হুদা, ২০১৬ সালের সার্জিকাল স্ট্রাইক যার মস্তিষ্কপ্রসূত, এ নিয়ে আতঙ্ক প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু বিজেপি এসব নিয়ে ভাবতে নারাজ।
পরিশেষে, সৈনিকদের পরিবারও প্রমান চেয়েছে। বিজেপির মহারাষ্ট্রের শরিক দল শিবসেনাও নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একই সময়, নিরাপত্তারক্ষা বাহিনীর আধিকারিকেরা দিল্লিতে ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে চলেছেন।
কয়েকজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু সে ব্যাপারে মোদী খুব একটা চিন্তিত নন। তিনি নিজে তো নির্বাচন জয়ের হাতিয়ার পেয়ে গিয়েছেন। "বাড়িতে ঢুকে মেরে আসব" - তাঁর এই আহ্বান তো বেশ সারা ফেলে দিয়েছে।তাই তো তিনি বিরোধীদের জাতীয়তাবোধ নিয়ে প্রশ্ন করছেন।
ভারতে আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়ে যাবে। দেশের গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে হলে কেউ মুহূর্তে টিভির পর্দা বন্ধ রাখাটাই সেরা উপায়।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে