ক্ষমতার লোভে ও মামলা থেকে রেহাই পেতেই দলবদল কংগ্রেস বিধায়কদের
দল বদলালেই বিধায়ক-সাংসদ পদ খারিজ করে দেওয়ার আইন হোক
- Total Shares
কংগ্রেস একটি ঐতিহ্যবাহী দল। আমরা ঐতিহ্য ও আদর্শে বিশ্বাসী। আমরা যারা কংগ্রেস করি, অর্থাৎ কংগ্রেসের নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে লড়াই করি, তাদের কাছে কংগ্রেসের ভাবধারাই সবচেয়ে বড় কথা। কংগ্রেসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখবেন, অনেক মানুষ আছেন ১৯৭৭ সাল থেকে এখনও অবধি যাঁরা কংগ্রেস ছেড়ে চলে গেছেন দীর্ঘ দিন পরে তাঁরা কংগ্রেসেই ফিরে এসেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে লজ্জার ও দুঃখের দিক হল, তিনি জোট করার জন্য রাহুল গান্ধীর কাছে যাচ্ছেন আবার কিছু দিন পরে উনি ফিরে এসে সেই কংগ্রেসকেই ভেঙেচুরে ছারখার করে দিচ্ছেন।
২১ জুলাই দিনটিকে জাতীয় কংগ্রেস শহিদ দিবস হিসাবে পালন করে। সকলেরই মনে থাকা উচিৎ, স্বরাষ্ট্রদপ্তরের নির্দেশে, বিশেষ করে মনীষ গুপ্তর আদেশ ও নির্দেশে ১৩টি তরতাজা যুবকের প্রাণ চলে গিয়েছিল। লড়াইটা ছিল বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে। সেদিন তৃণমূল কংগ্রেস তৈরিই হয়নি। তবে এই শহিদ দিবসকেই দলবদলের দিন হিসাবে দেখে আসছি গত পাঁচ বছর ধরে।
আমাদের ধারনা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সরকার ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস আমাদের কংগ্রেসকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দিতে চাইলেও তা তিনি পারবেন না। সাময়িক ভাবে দেখে মনে হয় যাঁরা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে চলে যাচ্ছেন তাঁরা কংগ্রেসের প্রতি বিদ্বেষ বা বিরূপ মনোভাবের জন্য দল ছেড়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁদের কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়ার একটা কারণ হল ভয় এবং ভীতি। মানস ভুঁইয়ার কথা ধরা যাক। একটি হত্যা মামলায় এফআইআরে মানস ভুঁইয়ার নাম দেওয়া হল। তৎকালীন পুলিশসুপার ভারতী ঘোষও এফআইআরে তাঁর নাম দিলেন এবং বললেন, উনি মেদিনীপুরে ঢুকলে ওনাকে গ্রেপ্তার করা হবে। মানস ভুঁইয়ার আগাম জামিনের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেছিল জাতীয় কংগ্রেস, তবে কলকাতা হাইকোর্ট তা খারিজ করে দেয়।
পরে অবশ্য অদ্ভুত ভাবে আমরা দেখলাম, যখনই মানস ভুইঁইয়া তাঁর নিজের দল ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে গিয়ে রাজ্যসভার সাংসদ হলেন, সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, চার্জশিট ও এফআইআর থেকে মানস ভুঁইয়ার নাম বাদ চলে গেল। অর্থাৎ উনি যতদিন কংগ্রেসে ছিলেন তত দিন অপরাধী ছিলেন, যেই তৃণমূলে গেলেন তখন কোনও অপরাধই ওঁকে স্পর্শ করতে পারল না। এই ধরনের এফআইআর, চার্জশিট প্রভৃতি জনমানসে কতটা প্রভাব ফেলবে, সেই উত্তর অবশ্য শেষ পর্যন্ত সময়ই দেবে।
গত ২১ জুলাই এবং এ বছর ওই একই দিনে কয়েকজন হয়তো নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যাচ্ছেন। কংগ্রেসের কংয়েকজন বিধায়ক এবং কয়েকজন সাংসদ তৃণমূলে যাচ্ছেন, তাঁদের কাছে নীতি ও আদর্শের থেকে বড় ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে কী ভাবে ক্ষমতার সঙ্গে হাঁটতে হবে। স্রোতের দিতে যেমন অনেকে যায়, তেমনই স্রোতের বিপরীতে কোনও কোনও মাছ যাওয়ার চেষ্টা করে।
জাতীয় কংগ্রেস হল একটি গণতান্ত্রিক মঞ্চ। শুধু বাংলায় নয়, জাতীয় স্তরেও দেখবেন কংগ্রেসকে বার বার ভাঙা হয়েছে। কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেই নতুন দলই আবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে, হাত মিলিয়ে ভোটে লড়াই করছে। কংগ্রেসকে ভেঙে অনেকেই মনে করে ইতিহাস তৈরি করবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে কালের ইতিহাসে তারাই বিলীন হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, কয়েকজন বিধায়ক-সাংসদ নন, আমাদের কর্মী ও সমর্থকরাই দলের আসল সম্পদ। তাঁরাই নেতা তৈরি করেন। অনেকে নেতা হয়েছেন, হারিয়েও গেছেন। কিন্তু উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, কোথাও দেখাতে পারবেন না, তাঁরা কংগ্রেস ছেড়ে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে তাদের পতাকা বহন করছেন।
যে সব স্বার্থান্বেষী বিধায়ক বা নেতা কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে মানুষের কাছে গিয়ে ভোটে জিতেছেন, আমি তাঁদের অনুরোধ করব, দল ছাড়ার সঙ্গে বিধায়ক পদ ছেড়ে দিয়ে তারপরে নতুন দলের প্রতীকে সেই আসনে জিতে দেখান। তাঁরা যদি নতুন করে জিততে পারেন, তবেই বুঝব মানুষের আস্থা রয়েছে তাঁদের প্রতি। কংগ্রেসের চিহ্ন নিয়ে, কংগ্রেসের পতাকা বহন করে যখন তাঁরা ভোটে জেতেন, তার পরে মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্য দলে যান তাঁদের বলব, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটে লড়াই করে, নতুন করে জিতে আসুন। মানুষ যদি মনে করেন যে কংগ্রেস দল ত্যাগ সঠিক ছিল, তা হলে মানুষ আপনাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, না হলে মানুষ সেই প্রার্থীকে পরাজিত করবে।
কোনও ব্যক্তি কোনও রাজনৈতিক দলে যেতেই পারেন, তিনি তাঁর যদি সৌজন্য বোধ থাকে তা হলে কংগ্রেসের প্রতীকে জেতা আসনটি ছেড়ে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনে জিতে আসুন।
নীতিহীনতার একটি ছোট্ট উদাহরণ আমি দিতে চাই। ধরুণ হুমায়ুন কবিরের কথা। প্রথমে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে জিতে বিধায়ক হলেন। তারপরে দল বদল করে উনি তৃণমূলে গেলেন। সেখানে গিয়ে উনি পরাজিত হলেন। তারপরে আবার উনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কাছে অনুনয়-বিনয় করে কংগ্রেসে ফিরে এলেন। তখন উনি বললেন যে উনি অন্যায় করেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসে গিয়ে ভুল করেছিলেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে দেখলাম তিনি আবার দিলীপ ঘোষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন।
মানুষ এদের গ্রহণ করে না, কারণ মানুষ এখন বুঝে গেছে যারা কংগ্রেসের টিকিটে জিতে তৃণমূলের পতাকা নিয়ে চলে, এদের কংগ্রেসের সব শ্রেণীর কর্মীই পরিত্যাগ করেছেন। কংগ্রেসে কোনও বিধায়ক-সাংসদ অন্য দলে গেলে কংগ্রেস ম্লান হয়ে যাবে না যদি তার কর্মী-সমর্থকরা সঙ্গে থাকে। আমার মনে হয়, দল বদল করলেই যাতে বিধায়ক বা সাংসদপদ খারিজ হয়ে যায়, তা নিয়ে একটি বিল আনা উচিৎ। না হলে ইউরোপিয়ান লিগের মতো হয়ে যাবে রাজনৈতিক দলবদল।