মোদী সরকারের আমলে কী ভাবে হতাশ হতে হয়েছে
২০১৯ নির্বাচনের আগে মোদির হাতে খুব অল্প সময় রয়েছে
- Total Shares
মাঝারি ও ছোট মাপের বিভিন্ন কোম্পানি অডিট করেন এমন একজন ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী সরকার সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, “ব্যবসা একেবারে থমকে রযেছে। পণ্য ও পরিষেবা করে (জিএসটি) এমন জটিলতা রয়েছে আর জমিমানার হার এমন যে আমার অনেক ক্লায়েন্ট কমে গেছে।”
তিনি কাকে দোষ দিচ্ছেন? তাঁর জবাব, “নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক। ওরা এমন একটা অবাস্তব আইন প্রণয়ন করেছে যেখানে কর আধিকারিকদের অবিবেচকের মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখন রিটার্নে কোথাও বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটলেই তাঁরা তৎক্ষণাৎ খোলাখুলি ভাবে গ্রেপ্তারের হুমকি দিচ্ছেন। এখনও অবশ্য কাউকেই তাঁরা গ্রেপ্তার করেননি। তবে এই দমনমূলক নীতি এখন দুর্নীতির দরজা খুলে দিয়েছে।”
কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে যিনি সদ্য ঘরে ফিরেছেন সেই অরুণ জেটলিকে সমস্যা বলেই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা, তিনি কোনও সম্ধান করতে পারেন, এ কথা কেউ মনে করছেন না। যদি জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নরেন্দ্র মোদী, এখনই যার সম্ভাবনা সূদূর, তাঁকে নতুন এক জন অর্থমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে খুব পছন্দসই একজন ব্যক্তি হতে পারেন সাময়িক ভাবে এই মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলানো পীযূষ গয়াল।
অরুণ জে়টলিকে সমস্যা বলেই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা, তিনি কোনও সমাধান নন
বহুবিধ ভুলভ্রান্তির জন্য অরুণ জেটলি ও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের আমলাদের দোষারোপ করা অবশ্য খুব সহজ ব্যাপার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরও এই দায় এড়াতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীও এই মন্ত্রককে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। বলাই বাহুল্য যে গত চার বছরে অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেছেন মোদী: ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণ হ্রাসের জন্য দেউলিয়া সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন, বহু ঔপনিবেশিক আইন রদ করা, বেনামি সম্পত্তির উপরে কুটারাঘাত করা, ক্রেতাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে রিয়েল এস্টেট রেগুলেটরি অথরিটি (রেরা) স্থাপন করা, এবং বিভিন্ন নীতি ও প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সংযুক্তিকরণ, গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন ও পরিচ্ছন্নতা।
তবে অন্য দিকে ব্যর্থতা সাধারণের মনে এই সব সংস্কারের সাফল্যকে ঢেকে দিয়েছে। আমলাতন্ত্রের উপরে অতি-নির্ভরতার ফলে খেলোয়াড়দের আয়ের উপরে হরিয়ানা ক্রিড়া সংস্থার কর আরোপ করতে যাওয়ার হাস্যকর উদ্যোগ তাঁদের অস্বস্তির কারণ হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে হইচই হওয়ার পরে প্রধান সচিব (ক্রিড়া ও যুবকল্যাণ) অশোক খেমকাকে এই বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহারের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছেন মোটামুটি ঝিমিয়ে থাকা হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টার। দশজন টেকনোক্র্যাটকে যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগ করার যে সিদ্ধান্ত ইতিপূর্বে হয়েছে তাও দীর্ঘদিন ঝুলে রয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমলাতন্ত্রের মধ্যেও একটি বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী বিশেষজ্ঞ থাকবে।
২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল অবধি অনাদায়ী ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাওয়ার প্রাক্তন আরবিআই রাজ্যপাল ওয়াই ভি রেড্ডি গত সপ্তাহে ইউপিএ সরকারকে দোষারোপ করেছন। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেছেন যে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এ বিষয় দ্রুত কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এর ফলে বেশ কিছু সম্ভাবনার উদ্ভব হতে পারে।
ইউপিএর দশ দশটি ছন্নছাড়া বছরের পর মোদী যখন ক্ষমতায় এলেন তখন অর্থনীতির অবস্থা বেশ করুন। তিনি এই অর্থনীতির বেহাল দশা ঠিক করতে পাঁচটি বছর সময় নিলেন। এরপরও ২০১৯ লোকসভায় তিনি পরাজিত হলেন এবং তাও এমন একটা সময় যখন দেশের বার্ষিক মোট জাতীয় আয়ে (জিডিপি) ৮ শতাংশ ছোঁবে ছোঁবে করছে, আর্থিক ঘাটতি ৩.৩ শতাংশে নেমে এসে নিয়ন্ত্রনে রয়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতির হার পাঁচ শতাংশের কম।
এবার ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের সঙ্গে ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরের তুলনা করে নেওয়া যাক। সেই সময় জাতীয় আয়ে ৪.৯ শতাংশে নেমে এসেছিল, আর্থিক ঘাটতি ৪.৫ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল আর মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।তার মানে, নির্বাচন হারলে যে বেহাল অর্থনীতি মেরামতি করে মোদীকে রুপোর চামচ ফের ইউপিএর হাতেই তুলে দিতে হবে।
উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল
এই সম্ভাবনা রোধ করতে মোদীর হাতে এক বছরেরও কম সময় রয়েছে। কর প্রকল্পগুলো সংশোধন করতে মোদীকে আরও সাহসী হতে হয়। আমাদের দেশে প্রতক্ষ্য কর বাবদ যা আদায় হয় তার ১০ শতাংশেরও কম অবদান রয়েছে যে সব অ্যাসেসির করযোগ্য আয়ে সাড়ে সাত লক্ষ টাকার কম। তাঁদের আয়কর থেকে মুক্ত করা হোক। এর থেকে দু'দুটি সুবিধা পাওয়া যাবে। প্রথমত, ২০১৯ লোকসভার আগে মধ্যবিত্তরা বিজেপির পক্ষ নেবে। দুই, আয়কর আধিকারিকরাও শুধুমাত্র উচ্চকরদাতাদের উপর নজরদারি বাড়াতে পারবে। এর ফলে, কোষাগারও ফুলেফেঁপে উঠবে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন কিন্তু তিনিও তাঁর ১৭ মাসের মেয়াদকালে মার্কিন অর্থনীতিতে রীতিমতো চমক সৃষ্টি করেছেন। বেকারত্ব (৩.৮ শতাংশ) একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে আর জাতীয় আয়ে ঐতিহাসিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৩.২ শতাংশেরও বেশি। কর্পোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নামিয়ে এনে ট্রাম্প মার্কিন সংস্থাগুলোকে নতুন বিনিয়োগের জন্য ও কর্মচারীদের বাড়তি বেতনের জন্য অর্থের বন্দবস্ত করে দিয়েছেন। ভারতের অর্থ মন্ত্রকেরও অবিলম্বে করে পরিমাণ কমানোর কথা চিন্তা করতে হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে মোদী সরকারের উচিৎ পেট্রল ও ডিজেলের দাম জিএসটির আওতায় আনা। রাজ্য সরকারগুলো এখন মানতে শুরু করেছে যে ভ্যাট থেকে উপার্জিত বিপুল পরিমাণের কর কিন্তু উপভোক্তাদের সারা জীবন ধরে ভোগাতে পারে। জ্বালানি জিএসটির আওতায় এলে জাতীয় কোষাগারের উপর কোনও প্রভাব না ফেলেই পরিস্থিতি উন্নতি হবে।
ক্রেতারা যত বেশি জ্বালানির উপর খরচ বাঁচাতে পারবেন তাঁদের ক্রয় ক্ষমতা ততই বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে কর্পোরেট গুলো লাভের মুখ দেখবে এবং কর্পোরেট কর প্রদানের ক্ষমতাও বাড়বে। এই চক্রের প্রভাব শহর, শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলেও পড়বে।
জম্মু ও কাশ্মীর ও ক্যাবিনেট গঠন সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে মোদী সরকারও আমাদের হতাশ করেছে। নীতিন গড়করি ও পীযুষ গোয়েলের মতো মন্ত্রীদের কথা বলছি না। তাঁরা অসামান্য কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁরা তো ব্যতিক্রমী।
উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। ইউপিএ সরকারের ১০ বছরের কেলেঙ্কারির পর এনডিএ জনস্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল।
জনতার দরবারে বসার আগে মোদীকে প্রতিশ্রুতি পুরণকরতেই হবে। হাতে সময় কিন্তু যৎ সামান্যই। ২০১৯ লোকসভা দরজায় কড়া নাড়ছে যে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে