সময়োপযোগী ও নিতান্তই প্রয়োজনীয়,অ্যাস্যাট পরীক্ষার জন্য নরেন্দ্র মোদীর কৃতিত্ব প্রাপ্য
নির্বাচনে সুবিধা পাবে বলে অ্যাস্যাট পরীক্ষার সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে, এই দাবি ঠিক নয়
- Total Shares
ভারত যে 'মিশন শক্তি' নামক উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ প্রদর্শন করল তার তাৎপর্য এখন রাজনৈতিক চাপানউতোরের মাঝে হারিয়ে যেতে বসেছে। জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে কোনও ইস্যুতেই এই প্রবণতা আজকাল নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই ইস্যুগুলো নিয়ে হওয়া তর্ক-বিতর্ক খুব দ্রুত খেই হারিয়ে ফেলে। তর্ক-বিতর্কগুলোর তখন শুধুমাত্র একটা লক্ষেই পর্যবসিত হয়ে যায় - যেনতেন প্রকারে সরকারকে কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করতে হবে।
An important message to the nation. Watch. https://t.co/0LEOATgOOQ
— Chowkidar Narendra Modi (@narendramodi) March 27, 2019
যদিও, রাজনৈতিক বিরোধীরা বৈজ্ঞানিক মহলের প্রশংসা করে থাকে। কিন্তু এই ধরণের সাফল্যে যে তারা খুব অখুশি হন তা তাদের হাবেভাবে ও কথাবার্তায় বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়।
১৯৯৮ সালের পরমাণু পরীক্ষা, ২০১৬ সালের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, ২০১৭ সালের ডোকালাম অচলাবস্থা, ২০১৯ ফেব্রুয়ারির বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক কিংবা ২৭ মার্চের অ্যাস্যাট পরীক্ষা - এই সব ঘটনাগুলোর পরে একই ধরণের কয়েকটি প্রশ্নই উঠে এসেছে - এখন কেন? প্রয়োজনীয়তা কী ছিল? আমাদের সময়তেও আমাদের ক্ষমতা ছিল এবং আমরা তৈরিও ছিলাম, সে ক্ষেত্রে এখানে কৃতিত্ব নেওয়ার কী আছে?
আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে - কী পাওয়া গেল? এই অভিযান আদৌ কি সফল হয়েছে? তথ্যপ্রমাণ কী রয়েছে? সকলেই বুঝতে পারছেন যে এই প্রশ্নগুলো করে প্ৰশ্নকর্তারা অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। তা সত্ত্বেও প্রশ্নকর্তারা প্রশ্ন করতে পিছপা হবেন না।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থা কোন সময়ে নেওয়া হয়েছে এই প্রশ্ন তুলে আদতে মানুষের মনে সরকারের কৃতিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। এই প্রকল্প রূপায়ণের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক খেলা লুকিয়ে নেই তা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। কিন্তু নতুন অস্ত্র প্রযুক্তি কিংবা নতুন অস্ত্র ব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো রূপায়ণের ক্ষেত্রে কোনও 'উপযুক্ত' সময়ের জন্য অপেক্ষা করা অনুচিত। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কোনও ভাবেই দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়।
তাহলে লোকসভা মুলতুবি না হলে এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন চলে না এলে অটলবিহারী সরকার কি কার্গিল আক্রমণ নিয়ে কিছুই করত না?
নির্বাচনের প্রাক্কালেও বাজপেয়ী সরকার কার্গিল আক্রমণের জবাব দিয়েছিল [ছবি: পিটিআই]
সুতরাং, অ্যাস্যাট পরীক্ষার সময় নিয়ে কোনও সমস্যাই নেই।
বিরোধীরা দাবি করেছে যে আসন্ন নির্বাচনে সুবিধা পাবে বলে অ্যাস্যাট পরীক্ষার জন্য ঠিক এই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে। এই দাবি ঠিক নয়। কারণ এ দেশের নির্বাচন কখনোই একটি ইস্যুর উপর নির্ভর করে হয় না - এক্ষেত্রে ইস্যুটি হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা।
বরঞ্চ আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা তোয়াক্কা না করে এই পরীক্ষার জন্য সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।
দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তিনি যদি বাড়তি কিছু ভোট পান তাহলে সেই ভোটগুলো তাঁর প্রাপ্য হওয়া উচিত। কিন্তু নির্বাচনের ফায়দা তোলার জন্য তিনি পরীক্ষাটি ঠিক এই সময় করলেন - এই দাবি মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। বুঝতে হবে, এই ধরণের পরীক্ষা সব সময়ই সময় সাপেক্ষ। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রাক্তন অধিকর্তা ডক্টর ভিকে সারস্বত তো জনসমক্ষে বলেছেন যে ২০১২ সালে ভারতের এই ক্ষমতা ছিল কিন্তু এই ক্ষমতা প্রদর্শন করতে খুব কম করে বছর দেড়েক সময় লেগে যেত। তিনি একটি আনুমানিক সময় সীমার কথা বলেছিলেন এবং এই সময়সীমা বৃদ্ধি হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল। শেষ পর্যন্ত সফল ভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করতে কিছুটা বেশি সময় লেগেই গেল।
২৭ মার্চের পরে এই সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরগুলো বিশ্বাস করলে মেনে নিতেই হচ্ছে, ২০১৪ সালে সরকারে আসার পরেই মোদী সরকার এই পরীক্ষাটির জন্য সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দিয়েছিল।
FM Arun Jaitley on #MissionShakti: The process started in 2014 after the PM gave the permission, it's a huge achievement, not only we have become space power but we are now in big four. We should not forget that tomorrow's wars will not be the same as yesterday's wars. pic.twitter.com/gEWdpVXWuz
— ANI (@ANI) March 27, 2019
কিন্তু এই পরীক্ষা সফল ভাবে অনুষ্ঠিত করতে বছর চারেক লেগে গেল (সারস্বত যে দেড় বছরের আনুমানিক সময়সীমার কথা বলে ছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি)। তাহলে কি এই পরীক্ষাটি নির্বাচনের পরে করা উচিত ছিল? খুব সম্ভবত নয়। কিছু বিরোধী নেতাদের হম্বিতম্বি দেখে মনে হচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হলে এই প্রকল্প আর দিনের আলো দেখতে পারত না। ঠিক যেমন ২০১২ সালে হয়েছিল যখন এই পরীক্ষাটি করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এই পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বর্তমানে আমরা যে পরিস্থিতিতে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে - বিশেষ করে চিন-পাক ঘনিষ্ঠতার মাঝে। এই পরিস্থিতিতে আমরা মহাকাশ দখলের লড়াইয়ের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করতে পারি না।
চিন ইতিমধ্যেই নিজেদের অ্যাস্যাট দক্ষতা প্রমাণ করে ফেলেছে। ভারতের তাই সেই ক্লাবের সদস্য হওয়া, নিতান্তই প্রয়োজনীয় ছিল। ভারতের উন্নয়নে মহাকাশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই গুপ্তচর উপগ্রহ কিংবা অন্যান্য প্রযুক্তি ভারতীয় মহাকাশে হানা দিতে পরেই। এই আশঙ্কার মাঝে অ্যাস্যাট দক্ষতা না থাকার মানে মহাকাশে আমাদের নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়া। এই পরীক্ষা করে আমরা আমাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছি। পাশাপাশি ভারত এখন আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও (আইসিবিএম) ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা দেখাতে পারে। আইসিবিএম ধ্বংস করার জন্য ভারতকে আরও বেশ কয়েকটি ধাপ পেরতে হবে। কিন্তু অ্যাস্যাট পরীক্ষার ফলে আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রথম পদক্ষেপটি করে ফেলেছি।
অ্যাস্যাট পরীক্ষা করে শত্রুদের কড়া বার্তা পাঠানো গড়ল [ছবি: পিটিআই]
ভারত নীতিগত ভাবে মহাকাশকে অস্ত্রসজ্জিত করার বিরুদ্ধে। কিন্তু শত্রুপক্ষ যদি নিজেদের মহাকাশ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলে তাহলে ভারতের হাতে শুধু দুটি উপায় অবশিষ্ট থাকে - এক হয় নিজেদের পাল্টা প্রস্তুত করা, না হয় আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শত্রুপক্ষের হাতে সমর্পন করে দেওয়া।
একটা কথা বুঝতে হবে। অ্যাস্যাট দক্ষতা সম্পন্ন একটি দেশ যতই এই প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুক, প্রযুক্তি তৈরি হয়ে গেলে তা আর নষ্ট করে দেওয়া যায় না এবং দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতেই হবে। লোকেই যায় বলুক না কেন পরমাণু অস্ত্র নষ্ট করে দেওয়া সহজ নয়। তাই এই পরীক্ষা নিয়ে ভারতের দুঃখপ্রকাশ করার কোনও অবকাশ নেই। বরঞ্চ এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করে এলিট ক্লাবের সদস্য হয়ে ভারত এখন নিজেই নিয়ম তৈরি করার অবস্থায়ে পৌঁছে গেছে। এক্ষেত্রে অন্তত পরমাণু অস্ত্রের মতো, অন্য দেশের তৈরি করা নিয়ম ভারতকে অনুসরণ করতে হবে না।
সব ভালো জিনিসের খারাপ দিকও থাকে। দৌড় শুরু করে দেওয়ার পর প্রযুক্তিগত ভাবে আর পিছিয়ে পড়লে চলবে না। ভারতকে এখন এই প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। তা ছাড়া, শত্রুপক্ষও ভারতের ক্ষমতা খাটো করতে নিজেদের প্রযুক্তির উন্নয়ন করার চেষ্টা করবে। পাল্টা দেওয়ার জন্য ভারতকেও প্রস্তুত থাকতে হবে।
অল্প কথায়, একটি নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হল যেখানে আমাদের দৌড় চালিয়ে যেতে হবে। তার মানে, এখন আমাদেরও নিজেদের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামরিক প্ৰয়োজনীয়তার মধ্যে ভারসাম্যের সৃষ্টি করতে হবে। ভারতের রাজনৈতিক মহলকেও ঊনবিংশ শতাব্দীর মানসিকতার থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তা নিয়ে আরও সজাগ থাকতে হবে।
বিরাট সৈন্যদল সম্বল করে যুদ্ধ জয়ের দিন শেষ হয়ে গিয়েছে, এখন প্রযুক্তির যুগ। এই যুগে যে সৈন্যদল প্রযুক্তিগত ভাবে শক্তিশালী এবং শত্রুপক্ষের প্রযুক্তির চেয়ে উন্নত সেই সৈন্যদলই যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে।
দুর্ভাগ্যবশত, ভারত অবশ্য প্রযুক্তি বা আধুনিকীকরণের চেয়ে সংখ্যার উপর বেশি জোর দিয়ে চলেছে। তা না হলে এখনও কেন ষাটের দশকের মিগ-২১ যুদ্ধবিমান কিংবা আশির দশকের মিরাজ-২০০০ ব্যবহার করে চলেছে?
ভারত এখন কেন মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে চলেছে? [ছবি: রয়টার্স]
মিশন শক্তির পর মহাকাশে ভারতকে আরও বেশি পেশীশক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়বে। শত্রুপক্ষ ভারতের ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছে এবং এই বিষয়টি তাদের পরিকল্পনার মধ্যে স্থান পাবে। শত্রুপক্ষ যে ভাবে প্রস্তুতি নেবে তার পাল্টা দেওয়ার জন্য ভারতকেও প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিবিদরা তো কোনও কিছুই চিন্তা না করে রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পগুলোর জন্য জিডিপির ২ শতাংশ ঘোষণা করে ফেলেন কিংবা কোনও কিছুই না ভেবে ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থা কি করা যাবে?
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে