রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিসত্ত্বার সমস্যা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কেউ নিজেকে সংগঠন বা সরকার কিংবা রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে মনে করলে এই সমস্যার হয়
- Total Shares
ইউপিএ (১) সময়কার কথা। আমি তখন কলকাতা উত্তর পূর্ব কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ হওয়ার সুবাদে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন দপ্তরের স্থায়ী কমিটির সদস্য। সেই সময়তেই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডোর প্রকল্প অনুমোদিত হয়। কথা ছিল দপ্তরের অধীনে একটি সংস্থা তৈরি হবে যে সংস্থা এই প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব নেবে। আশির দশকের শুরুতে কলকাতা মেট্রো রেল প্রকল্পের সময় দেখা গিয়েছিল যে রেলমন্ত্রক না করে যদি এই ধরণের কোনও সংস্থা তৈরি করা যায় তা হলে ঝামেলা কম হয়। পরবর্তীকালে দেশে যে ক'টি মতো রেল প্রকল্প হয়েছে সবকটি এই ফর্মুলা মেনে হয়েছে। এতে কাজের গতি ঠিক থাকে, পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বেড়ে যায়।
সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চলছিল। কিন্তু ইউপিএ (২) সরকারে রেলমন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে এই প্রকল্পে প্রথম বাধ সাধলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাওড়া স্টেশন ও শিয়ালদহ স্টেশনে কাজ করা যাবে না বলে ফতোয়া জারি করা হল। শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পকে রেলের অধীনে নিয়ে এসে সবুজ সঙ্কেত দিলেন তিনি। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নতুন আবদার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডরের দায়িত্ব রাজ্য সরকারকে দিতে হবে।
আসলে রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই। কোথাও কোনও প্রটোকলের ধার ধারেন না। কোনও দিনও কারও সঙ্গে পরামর্শ করেন না। যখন তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন রাজ্যে একের পর এক রেলপ্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিয়েছেন। কোনও দিনও রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি যে কোথায় কোন প্রকল্প রূপায়ণ করলে উন্নয়ন ঘটবে বা সেই প্রকল্প থেকে সাধারণ মানুষ লাভবান হবে। আবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেন হওয়ার পরে তিনি কোনও দিনও রেল ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রকের সঙ্গে পরামর্শ করবার প্রয়োজন মনে করেন না।
এটা কিন্তু কোনও রাজনৈতিক সমস্যা বা রাজনীতির খেলা নয়, আসলে এটা ব্যক্তিত্বের সমস্যা। একজন ব্যক্তি যখন নিজেকে কোনও প্রতিষ্ঠান, কোনও সরকারের বা রাষ্ট্রের উর্দ্ধে মনে করেন তখনই এই সমস্যা দেখা দেয়। মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার পিছনেও এই একই সমস্যা কাজ করছে।
ব্যক্তিস্বত্ত্বার সমস্যা রয়েছে মমতার [ছবি: রয়টার্স]
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়েছে মাঝেরহাট সেতু। এই নিয়ে কোথাও কোনও দ্বিমত নেই। সেতু ভেঙে পড়ার পর এমন অনেক দস্তাবেজ সামনে এসেছে যেখানে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে যে মাঝেরহাট সেতুর সারাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিকে নজর দেয়নি রাজ্য সরকার। মাঝেরহাটের মতো সেতুগুলোকে আরওবি বলা হয়। অর্থাৎ, রেলওয়ে ওভার ব্রিজ। এ ধরণের ব্রিজে রাজ্য সরকার ও রেলের পঞ্চাশ শতাংশ করে অংশীদারিত্ব থাকে। দু'টি সংস্থার মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কোঅর্ডিনেশনের মাধ্যমে এই সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণার কাজ করতে হয়। কিন্তু সেই সমন্বয়ের অভাব ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। তৃণমূল সরকার তৃণমূল বাদে আর কোনও সংস্থাকে পাত্তা দেয় না। এখন অবশ্য জোকা-বিবাদিবাগ মেট্রো প্রকল্পের উপর দোষ চাপিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাজ্য সরকারের থেকে দাবি করা হয়েছে যে রেলের তরফ থেকে ব্রিজের অবস্থার কথা তাদের জানানো হয়নি বা রেল এই সেতু রক্ষণাবেক্ষণে রাজ্য সরকারকে কোনও সাহায্য করেনি। যদিবা এই দাবি মেনেও নেওয়া যায় তাহলে ওই অঞ্চলের সাংসদ কী করছিলেন? একজন সাংসদের দায়িত্ব তাঁর কেন্দ্রে অবস্থিত কোনও বিষয়ে যদি কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে বিষয়টি নিয়ে দরবার করা। কলকাতা উত্তর-পূর্ব কেন্দ্রের সাংসদ থাকাকালীন আমি নিজে রেলের সঙ্গে কথা বলে ওই কেন্দ্রে অবস্থিত বেশ কয়েকটি রেল ওভারব্রিজের মেরামতির কাজ করিয়েছি। মাঝেরহাট সেতু দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। আর, দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা আসন গত তিরিশ বছর ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দখলে। একটা চিঠি তিনি দেখাতে পারবেন যেখানে তিনি বা সুব্রত বক্সী রেলকে চিঠি পাঠিয়েছেন। শুধু মাঝেরহাট কেন, বিজন সেতু বা ঢাকুরিয়া সেতু নিয়েও রেলকে কোনও চিঠি পাঠানো হয়নি।
কারও সঙ্গে পরমার্শ করে প্রটোকল মেনে কাজ তিনি কোনও দিনও করেননি। আজও করেন না।
একটা ঘটনার কথা বলি। আমার বর্তমান লোকসভা কেন্দ্রে ডালখোলা বাইপাস প্রকল্প বহুদিন আটকে ছিল। না, কোনও জমি অধিগ্রহন বা অন্য কোনও পরিকাঠামোগত সমস্যার জন্য নয়। ওই এলাকায় একাধিক 'অনুব্রত মণ্ডল'রা রয়েছেন। সকলকে 'খুশি' করা যাচ্ছিল না বলেই প্রকল্প থেমে ছিল। শেষ পর্যন্ত এলাকার লোকজন যখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পথে নামলেন তখন প্রকল্প পুনরায় শুরু হল। এটা যদি রাজ্য সরকারের প্ৰকল্প হত তাহলে এই সমস্যা হত না।
রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ভেঙে পড়ছে মাঝেরহাট সেতু [ছবি: পিটিআই]
মুখ্যমন্ত্রীকে একটা কথা বুঝতে হবে। কলকাতা শহরের একদিকে গঙ্গা আর তিনদিকে রেললাইন। গঙ্গা ও রেল দুইই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এই শহরে সম্প্রসারণের কাজ করতে গেলেই কেন্দ্রের সাহায্য লাগবে। কিন্তু তিনি যদি কেন্দ্রের সাহায্য না নেন তাহলে কোনওদিনও শহর লাগোয়া বা বৃহত্তর কলকাতার উন্নয়ন হবে না।
গত শতাব্দীর শেষ দিকে আমরা (বামফ্রন্ট সরকার) একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মুম্বাই হাইওয়ে (যা কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে এসে শেষ হয়ে যায়) একেবারে কাকদ্বীপের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া। তার মানে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বিদ্যাসাগর সেতু হয়ে, খিদিরপুর হয়ে গোটা ডায়মন্ড হারবার রোডকে জাতীয় সড়কে উন্নীত করার কথা ছিল। কিন্তু রেলমন্ত্রী থাকাকালীন জোকা বিবাদিবাগ মেট্রো করিডোর প্রকল্প ঘোষণা করে সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ সেই প্রকল্প রূপায়িত হলে বছর ষাটের মাঝেরহাট সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চলে যেত এনএইচএআই (ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া)-এর হাতে।
যা করব আমিই করব। আমি সিদ্ধান্ত নেব আমিই নেব। মানুষ যদি নিজেকে সংস্থা, সরকার বা রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে মনে করে তাহলে এই অবস্থাই হয়।