মাইক হাতে গর্জন নয়, পেন হাতে কবিতাই এখন মমতার প্রতিবাদের ভাষা
মানুষের জীবনে কেন্দ্রে অনাধিকার প্রবেশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী 'উঁকি অনলাইন' কবিতাটি লিখছেন
- Total Shares
উনি অনেকটাই নরম হয়েছেন, অন্তত দেখে তো তাই মনে হয়। এখন আর তিনি মাইক হাতে তর্জনী তুলে গর্জান না। তাঁর ক্ষোভ বা প্রতিবাদ এখন সাদা কাগজেই ঝলসে উঠতে দেখা যায়। বহিঃপ্রকাশের ধরণ ও বদল দুই-ই বদলেছে, অস্ত্রটাও যে বদলে গেছে। কোনও এক বিদ্বজন বলেছিলেন, "তলোয়ালের চেয়ে কলম অনেক বেশি শক্তিশালী।" তাই তাঁর কলমটাও এখন অনেক বেশি সক্রিয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কথা কম বলছেন, লিখছেন বেশি। আর কেনই বা তিনি করবেন না? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর প্রকল্পগুলো নিয়ে যতবার সোচ্চার হয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ততবারই মুখ পুড়েছে মমতার।
নোটবন্দি, জিএসটি ও আধার নিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন, বিড়ালের (পড়ুন নরেন্দ্র মোদীর) গলায় ঘণ্টাটা পড়ানোর সাহসও প্রথম তিনিই দেখিয়ে ছিলেন। তাও এমন একটা সময়ে যখন অন্য বিরোধীরা চুপ থাকাটাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিল। এর মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছিল। তাঁর দলের এক বর্ষীয়ান নেতা ও লোকসভায়ে তাঁর দলের দলীয় নেতাকে চিটফান্ড কাণ্ডে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল। এত কিছুর পরেও তিনি ভয় পাননি।
মমতা এখন মাইক হাতে তর্জনী উঠিয়ে গর্জান না [ছবি: পিটিআই]
তিনি যে বিনা কারণে সোচ্চার হয়েছিলেন বা চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিলেন এমনটা নয়। তিনি নিজেকে মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে ছিলেন নরেন্দ্র মোদীর বিপরীতে, কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াই করবার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। শুরুতে তিনি কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে, বিরোধী শিবিরের অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে এই লড়াইয়ের জন্যে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। ভারতের রাজনৈতিক মহলের অনেক বড় বড় নাম সেই সময়ে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিল। তিনি নিজেও বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়ে ছিলেন।
কিন্তু তিনি ক্ষমতালোভী লোকেদের চিনতে ভুল করেছিলেন। ভেবেছিলেন সকলের সমর্থন আদায় করে তিনিই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে উঠবেন।
মমতাকে বিরোধী নেত্রী নির্বাচন করার জন্য ঐকমত্য প্রায় গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন নিজের দলের অন্দরমহলেও তাঁর নাম নিয়ে আর আলোচনা হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই, তিনি বিরোধী দলগুলোর দুটি বৈঠক বাতিল করে দিয়েছেন। এমনকি করুণানিধির শোকসভাতেও অনুপস্থিত ছিলেন। এই মঞ্চটিকে কিন্তু সহজে 'মোদী হঠাও' প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারত।
মমতা এখন নীরব থাকেন, কবিতা লেখেন [ছবি: পিটিআই]
বিরোধী ফ্রন্ট তৈরি করার শুরুর দিনগুলোতে মমতা চেয়েছিলেন যে এনডিএকে ক্ষমতায় দেখতে চান না এমন রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা যেন মাঝে মধ্যে একত্রিত হন। তিনিও এঁদের সমর্থন একজোট করতে গোটা দেশজুড়ে সফর করবেন। কিন্তু মমতার এই মনবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি। আর, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়া অসম্ভব।
মমতার দুই ঘনিষ্ঠ নেতা যাঁরা মমতাকে বিরোধী মুখ হিসেবে দেখতে চেয়ে ছিলেন তাঁরা নিজেরাই সরে গিয়েছেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই মমতাকে নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনা কমছে। রাজনৈতিক মহলের বর্ষীয়ানরা এখন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর হয়ে ব্যাট ধরতে শুরু করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর কবিতা এখন অনেক বলিষ্ঠ
স্বভাবতই, এই পট পরিবর্তনে দুঃখ পেয়েছেন মমতা। এখন তিনি ফুঁসছেন। সকলকে অবাক করে দিয়েই তিনি নীরব হয়ে গেছেন। এখন তিনি তাঁর প্রতিবাদের কথা লেখায় প্রকাশ করছেন। নিজের লেখা পদ্য নিয়ে তিনি এখন এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন যে মাঝে মাঝে এক দিনে দুটি করে পদ্য লিখে ফেলছেন তিনি। মোদীর রাজত্বকালে অর্থনীতি, আর্থিক সমস্যা ও সমাজ-রাজনৈতিক এবং সাংকৃতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তাগুলিই তাঁরকবিতায় ফুটে উঠছে। এনআরসি নিয়ে তিনি একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতার নাম 'পরিচয়'। এই কবিতায় ধর্মীয় রাজনীতি দিয়ে শুরু করে তিনি খাবার ও পোশাক আশাকের উপর যে নজরদারি শুরু হয়েছে তার কথাও উলকে করেছে। এই কবিতায় তিনি দেশজুড়ে কীভাবে প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহীর তকমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার কথাও উল্লেখ করেছেন।
'অচ্ছুৎ' নামের একটি কবিতায় তিনি তাঁর চিন সফর ও শিকাগো সফর বাতিলের কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন যে রাজনৈতিক কূটনীতির মতো বোকা বোকা কারণে তাঁর চিন সফর বাতিল হয়েছে। শিকাগো সফর বাতিলে হওয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন যে 'রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্রের' জন্যেই সেই সফর বাতিলে করে দেওয়া হয়েছে। 'শ্রেণী বিভাজনের' জন্যেই যে তাঁকে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়নি সেকথাও তিনি লিখতে ভোলেননি।
এই সপ্তাহে তিনি 'উঁকি অনলাইন' নামের একটি কবিতা লিখেছেন যেখানে তিনি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কেন্দ্রের অনধিকার প্রবেশের কথা লিখেছেন। কবিতায় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে আধারের সৌজন্যে কী ভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের উপর সর্বক্ষণ কেন্দ্রের নজরদারি থাকবে।
মমতার কবিতা কিন্তু এখন অনেক বলিষ্ঠ হয়েছে। যে কবিতায় অপ্রত্যাশিত ভাবে কোনও কিছু না পাওয়ার বেদনা ফুটে উঠছে। জাতীয় স্তরে লক্ষ্য পূরণ না করতে পারার বেদনা, কয়েকজন অভিন্নহৃদয় বন্ধুর সত্যিকারের মুখটা চিনে ফেলার বেদনা এবং সর্বোপরি মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করার সুযোগ না পাওয়ার বেদনা।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে