মধ্যপ্রদেশের রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বরা কেন রাজনৈতিক সৌজন্য ভুলতে বসেছেন
এই প্রথমবার শেষ অধিবেশনের শেষ দিনে সব দলের বিধায়কদের গ্রুপ ছবি তোলা সম্ভব হয়নি
- Total Shares
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই যেন মধ্যপ্রদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও দলীয় নেতাদের খারাপ দিকগুলো ফুটে উঠছে।
বিরোধী নেতা অজয় সিংয়ের কেন্দ্র ছুরহাটে প্রধানমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের কনভয়কে লক্ষ করে ইট বৃষ্টি হয়েছে। সেখানেই একটি জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিং বলেছিলেন যে মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যার চক্রান্ত চলছে। সেই সময় সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা চৌহানকে উদ্দেশ্য করে দর্শক আসন থেকে জুতো দেখানো হয়।
সে দিনই বিজেপির বিধায়ক উমা দেবী খটিকের পুত্র কংগ্রেস প্রচারক কমিটির চেয়ারম্যান তথা গুণা কেন্দ্রের সাংসদ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে হুমকি দিয়ে বলেছেন যে সাংসদ যদি তাঁর মায়ের কেন্দ্রে পা দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তাঁকে তিনি গুলি করে হত্যা করবেন।
বিদ্বেষের রাজনীতির শিকার স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
মধ্যপ্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিন্তু অন্য কথা বলে। সেই ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে দেখা যাবে যে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী নেতারা বরাবরই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।
ষাটের দশকে মধ্যপ্রদেশে প্রথম ও শেষ বারের জন্য জোট সরকার হয়েছিল। সেই সময় রাজ্যের শাসন গোবিন্দ নারায়ণ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন এসভিডি সরকারের হাতে। গোবিন্দ নারায়ণ সিং শক্তিশালী ডিপি মিশ্রকে হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হলেও দু'জনের মধ্যে কোনও দিনও ব্যক্তিগত সংঘাত লক্ষ করা যায়নি।
সেই সময় নির্বাচনের আগে বিজয়া রাজে সিন্ধিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল অভিযোগ তোলেন যে বস্তারের মহারাজ প্রবীর চন্দ্র ভঞ্জদেওর হত্যার পিছনে ডিপি মিশ্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু রাজমাতার জনসঙ্ঘের সমর্থনে এসভিডি সরকার গঠন করে নেওয়ার পরে এই অভিযোগ আর তোলা হয়নি।
আশির দশকে মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের সঙ্গে বিরোধী নেতা সুন্দরলাল পাটোয়ার সুসম্পর্ক তো সর্বজনবিদিত। এদের দুজনের মধ্যে প্রচুর মিলও ছিল। দু'জনেই শক্তিশালী প্রশাসনের পক্ষে। রাজনৈতিক ভাবে দু'জনেই দু'জনকে আক্রমণ করলেও ব্যক্তিগত ভাবে এরা দু'জনেই একে অপরের ভালো বন্ধু ছিলেন।
পরিবর্তীকালে মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিংও শিবরাজ সিং চৌহান-সহ সমস্ত মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।
মধ্যপ্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শাসক ও বিরোধী নেতাদের সুসম্পর্কের কথাই বলে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
অনেকেই মনে করেন যে ২০০৩ সালের শেষের দিকে মধ্যপ্রদেশে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে উমা ভারতীর আবির্ভাব রাজ্যের রাজনৈতিক চরিত্রটাকে অনেকখানি বদলে দেয়। এই সন্ন্যাসিনী রাজ্যের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার প্রচলন ঘটান যার মূল সুর ছিল রেষারেষি। বলা হয় যে রাজ্যের ঠাকুর সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে বেড়ে ওঠা উমা ভারতীর। সেই সময় ভারতীর ঘনিষ্ট সরকারি অফিসাররা দিগ্বিজয়ের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু কোনও তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে পারেননি।
কয়েকমাস পরে উমা ভারতী যখন বিজেপি ছেড়ে নতুন দল গড়লেন তখন তিনি নিজেই সরকারের আক্রমণের শিকার হলেন।
২০০৮ সালে বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী সুনীল নায়ককে ভোটের দিন গুলি করে হত্যা করা হল।
এবার রাজ্যের চতুর্দশ বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন এ ধরণের আরও অনেক ঘটনার সাক্ষী থাকবে মধ্যপ্রদেশ।
রাজ্য রাজনীতির পট পরিবর্তনের সূচনা উমা ভারতীর আগমনের পর থেকেই [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
প্রথাগতভাবে সব দলের বিধায়কদের নিয়ে বিধানসভার শেষ অধিবেশনের শেষ দিনে একটি গ্রুপ ছবি তোলা হয়। কংগ্রেস বিধায়করা ছবি তুলতে অস্বীকার করায় এই প্রথমবার এ বছর এই গ্রূপ ছবি তোলা হয়নি।
রাজনৈতিক বক্তৃতা অনেক অশ্রাব্য ভাষা লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ নেতাদের নিয়ে জাল ভিডিয়ো ও প্যারোডি গান নিয়মিত লক্ষ করা যাচ্ছে। এই ধরনের প্রচার বন্ধ করার কোনও চেষ্টা নেই। আবার, এই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোর জন্যে অজুহাতেরও অন্ত নেই।
অনেকেই বলছেন যে এই ধারার প্রচলনের নাকি সীমানার ওপার থেকে এসেছে। মধ্যপ্রদেশের রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময়ে বলে থাকেন যে মধ্যপ্রদেশে এই 'নোংরা' রাজনৈতিক ধারার শুরু নাকি উত্তরপ্রদেশ থেকে। মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের কনভয় লক্ষ করে ইট ছোড়ার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন যে মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যার চক্রান্ত হয়েছে। এই অভিযোগ যতটা বেশি সত্যি তার চাইতে অনেক বেশি রাজনৈতিক। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য এই অভিযোগ বলে অনেকেই মনে করছেন।
সব দলের বিধায়কদের গ্রুপ ছবিতে থাকতে রাজি হয়নি কংগ্রেস [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
যদি সত্যিই চক্রান্ত হয়ে থাকত তাহলে মাত্র ন'জনকে জামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করে তদন্ত বন্ধ করে দিত না পুলিশ। এই ন'জনের মধ্যে তিনজন আবার স্থানীয় কংগ্রেস নেতা। এই ধরণের পাথর ছোড়া বা হুমকি দেওয়ার মূল কারণ, রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে। তাঁরা জানেন যে এই ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে কতটুকু আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
এছাড়া, রাজনৈতিক নেতারা বর্তমানে রাজনৈতিক নৈতিকতা ভুলতে বসেছেন। এই অস্থির পরিবেশ-পরিস্থিতির জন্য অন্য কেউ নয়, রাজনৈতিক নেতারা নিজেরাই দায়ী।
(সৌজন্যে: মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে