কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের আসন সমঝোতা ভেস্তে গেল: ইতিহাস কী বলে
বামেরা বলছে তারা বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী শক্তিগুলিতে একজোট করার চেষ্টা করছে
- Total Shares
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের মধ্যে আসন সমঝোতার পরে সংবাদমাধ্যমের একাংশের মধ্যে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পূর্বাভাস লাগাতার ভাবে পাঠক এবং দর্শকের সামনে রাখবার চেষ্টা হয়েছিল। পরবর্তী কালে ফলাফল ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গেছে।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে আবার সেই সমঝোতার গল্প সামনে উঠে আসে। কিন্ত আপাতত কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও এই সমঝোতা ফলপ্রসূ হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে শেষ পর্যন্ত আসন সমঝোতা হল না কংগ্রেস ও বাংফ্রন্টের। (ফাইল ছবি: পিটিআই)
উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজপার্টির সমঝোতা একটা সময়ে অলীক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হয়েছে। ফলাফল কী হবে সেটা ২৩ মে জানা যাবে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের প্রেক্ষাপট আর পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট এক নয়। আবার এটাও ঠিক যে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের সম্পর্ক – তারও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্নধর্মী।
যতই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের রাজনীতিতে জাতীয় স্তরে বামপন্থীদের বেঁচে থাকাটা একেবারেই কংগ্রেসের বদান্যতায়। অথচ পশ্চিমবঙ্গে এই সম্পর্কটা অদ্ভুত ভাবে অম্লমধুর। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারে আসার পরে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত খাতায়কলমে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল থেকেছে কংগ্রেস এবং যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে রজনৈতিক সন্ত্রাসের ইতিহাস কুখ্যাত, সেই কারণে ১৯৭৭-এর আগে প্রায় একটা দশক কংগ্রেসের হাতে বামপন্থীদের অত্যাচার এবং ১৯৭৭-এর পরে বামপন্থীদের হাতে কংগ্রেস কর্মীদের প্রতি অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্ত এই অত্যাচার এবং পাল্টা অত্যাচারের কাহিনি একেবারেই তৃমমূল স্তরের কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। নেতৃত্ব কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
জাতীয় স্তরে বামপন্থী তাত্ত্বিকেরা যেমন ভাবে কংগ্রেসের স্নেহধন্য থেকেছেন, একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি নেতারা আন্দোলনের ময়দান থেকে হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। এবং একটি অশুভ আঁতাঁতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই যখন ২০১৬ সালে এই দুই পক্ষের সমঝোতার প্রশ্নটি ওঠে, তখন দুপক্ষের তৃণমূল স্তরে একটি হতাশা কাজ করলেও নেতৃত্ব বরাবরই সাবলীল থেকেছে, দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া।
২০১৯ সালে বিষয়টি একটু ভিন্ন। দলের সভাপতি হিসাবে রাহুল গান্ধী দলের প্রাদেশিক শাখাগুলিকে সমঝোতার প্রশ্নে একটু অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এমনিতে পশ্চিমবঙ্গে শক্তি হিসাবে কংগ্রেস প্রায় সাইনবোর্ড। কিন্তু রাহুল গান্ধীর এই নব্য নীতির কারণে কংগ্রেসের কিছু অতৃপ্ত আত্মা তাঁদের পেশী আস্ফালনের চেষ্টা করেন এবং সফলও হন।
রাহুল গান্ধী ও সীতারাম ইয়েচুরি -- আগে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের উপরেই নির্ভর করত বামফ্রন্ট। (ফাইল ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
বামপন্থীদের ক্ষেত্রে একটা মরিয়া চেষ্টা ছিল ঠিকই, কারণ পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে বামপন্থীদের লোকসভা ভোটে মানুষের কাছে ভোট চাওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ঐতিহাসিক ভাবে লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের ভোট দেওয়া যে ভোট নষ্ট করার নামান্তর এটা গত কয়েক বছরে প্রমাণিত। এবং এবারেও বামপন্থীরা সর্বভারতীয় স্তরে যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাতে কযেকজন মানুষকে তথাকথিত সাংসদ হিসাবে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া ছাড়া বামপন্থী সাংসদদের কাছ থেকে পাওয়ার মতো কিছু নেই।
জাতীয় স্তরে যেমন একটা আলোচনা আছে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নন, তেমনি কংগ্রেস ছাড়া সমস্ত আঞ্চলিক দলের কাছেও এই বামপন্থীরাও তেমন ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নন।
জওহরলাল নেহরু থেকে সনিয়া গান্ধী পর্যন্ত আমলে কী হয়েছে তা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু রাহুল গান্ধী বামপন্থীদের কতটা বিশ্বাস করেন, এতে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন আছে। সেই কারণেই জোট ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থাতেও রাহুল গান্ধীর পক্ষ থেকে তেমন কোনও বাড়তি উদ্যোগ কিন্তু দেখা গেল না।
এই কম একটা অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের লড়াইটা চতুর্মুখী। বামপন্থীরা যতই প্রচার করার চেষ্টা করুন যে তাঁরা বিজেপি বিরোধী এবং তৃণমূল বিরোধী শক্তিগুলিতে একজোট করার চেষ্টা করছে, কংগ্রেস কোনও দিনই এই প্রচারকে খুব একটা আমল দেয়নি। সংসদে সংখ্যা বৃদ্ধি করাটা কংগ্রেসের কাছে সরকার গঠর কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা আর বামপন্থীদের কাছে ব্ল্যালমেলিংয়ের একটা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা।
এই চতুর্মুখী লড়াইয়ে কে কতটা সফল হবে এবং বিজেপি অথবা তৃণমূল কংগ্রেস কে কতটা লাভবান হবে সেটা রাজ্যের মানুষ ঠিক করবেন। কিন্তু মালদায় প্রচারে এসে রাহুল গান্ধী ঠিক কী বার্তা দিয়ে যান, তার উপরে নজর থাকবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই।