২০১৪-র গুজরাট মডেল মতো তৃণমূলের ইস্তেহারে এ বার পশ্চিমবঙ্গ মডেল
এতদিনেও ন্যূনতম কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারল না বিরোধীরা
- Total Shares
ভোটর পূর্ববর্তী জোট কি গড়তে পেরেছে বিরোধীরা?
১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডের সভায় সবচেয়ে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতা তথা দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া পরামর্শ দিয়েছিলেন আসন-সমঝোতা ও ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি (কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম বা সিএমপি) গ্রহণ করতে। কিন্তু সেই সমাবেশের পরেই যে বিরোধী দলগুলি তা ভুলে গিয়েছে তা দেখা গেল ভোটের দিন ঘোষণা হতেই। অন্যত্র যাই ঘটুক, এ রাজ্যে লড়াই হচ্ছে চতুর্মুখী। তারা সরকার গড়ার সুযোগ পেলে তবেই যে সিএমপি তৈরি হবে, সেই ইঙ্গিত রয়েছে সদ্য প্রকাশিত তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তেহারে।
ওই সভামঞ্চেই বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ কিছুটা হলেও ত্যাগ করার কথা বলেছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা। সেই মঞ্চের কেন্দ্রে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব, কংগ্রেসের প্রতিনিধি তথা সংসদে বিরোধীদলের প্রধান মল্লিকার্জুন খড়্গে, বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষ হতেই যে যার মতো করে ভাবতে শুরু করলেন – মমতা একাই লড়বেন বলে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জোট গড়ে ফেললেন মায়াবতী-অখিলেশ। অন্ধ্রপ্রদেশেও তথৈবচ অবস্থা জোটের, দিল্লি নিয়েও শুরু হয়ে গেল জট – সুতরাং দেশ জুড়ে একের বিরুদ্ধে এক লড়াই রয়ে গেল অলীক কল্পনা, সেখানে ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচী দূরঅস্ত্।
প্রকাশ হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তেহার। (নিজস্ব চিত্র)
যখন ভোটের আগে এত দীর্ঘ সময় পেয়েও ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি রূপায়ণ করা সম্ভব হল না, সেখানে ভোটের পরে যদি দেখা যায় বিরোধীরা একজোট হয়ে সরকার গড়ার মতো সংখ্যা তৈরি করতে পারছে, তখন সাত-দশ দিনে তারা যে কর্মসূচি তৈরি করবে, তার উপরে নির্ভর করে কী ভাবে পাঁচ বছর সরকার চালাবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বিরোধীদের ভোট পূর্ববর্তী পদক্ষেপ দেখেই।
তৃণমূলের ইস্তেহারের মূল কথা
পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নই মডেলই হবে আগামী দিনে ভারতের উন্নয়নের মডেল – তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তেহার হল এক কথায় তাই। যে ভাবে ২০১৪ সালে গুজরাট মডেলের কথা উঠেছিল, সেই ভাবে ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ মডেল তুলে ধরেই লোকসভা নির্বাচনে (পশ্চিমবঙ্গে) লড়াই করছে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে উন্নয়নের মডেলটি কী, তা নিয়ে যথেষ্ট পরিসংখ্যান দেওয়া হলেও, সেখানে স্পষ্ট ভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
ইস্তাহারে মোদী সরকারের পাঁচ বছরের ‘অপশাসন’ বনাম পশ্চিমবঙ্গে সাত বছরের ‘উন্নয়নে’র তুলনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের বাধ্যবাধকতায় সেটিই সাধারণ ভাবে হয়ে থাকে। কিন্তু উন্নয়নের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বেশ ঘোলাটে।
ইস্তেহারে স্ববিরোধিতা
ইস্তাহারের ৫৯ পাতায় বলা হয়েছে বর্তমানে চা বাগানের শ্রমিকদের দৈনিক আয় তিন গুণ বেড়ে ১৭৬ টাকা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে সরকারের কৃতিত্ব, কিন্তু ২০১৮ সালের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজে (এমজিএনআরইজিএ) পশ্চিমবঙ্গের জন্য দৈনিক মজুরি ১৯১ টাকা। তাই এ রাজ্যে আয় যে এখনও কম, তা শাসকদলের ইস্তেহারেই স্পষ্ট।
তা ছাড়া, রাজ্যের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে শতাংশের হিসাবে – অর্থাৎ টাকার অঙ্ক বলা হয়নি। ধরা যাক কোনও এক বছর একটি রাজ্যে ১ কিমি রাস্তা তৈরি হয়েছিল, পরের বছর তৈরি হল ২ কিমি। তা হলে বৃদ্ধির হার হবে ১০০ শতাংশ। অন্য একটি রাজ্যে ১০০ কিমি রাস্তা তৈরি হয়েছিল, পরের বছর তৈরি হল ১০৩ কিমি, অর্থাৎ বৃদ্ধির হার হবে ৩ শতাংশ। তাই বৃদ্ধির হারের তুলনা দেখে প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়।
তৃণমূলের ইস্তাহারে টাকার অঙ্কের চেয়ে শতাংশের হিসাব বেশি।
তা ছাড়া যে উন্নয়নকে দেশের কাছে মডেল হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস, সেই উন্নয়নের তালিকায় রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সেতু (হাতানিয়া-দোয়ানিয়া) এমনকি এশিয়ান হাইওয়ে পর্যন্ত, যেটির শরিক ২৯টি দেশ।
রাজ্যে জমি অধিগ্রহণের জটে একাধিক রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ দীর্ঘদিন আটকে থাকলেও দেশে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী এবং দ্বারকা থেকে কোহিমা পর্যন্ত পথের কথা বলা হয়েছে – তা জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কী ভাবে সম্ভব!
তা ছাড়া দেশের সব পাহাড়ি এলাকার উন্নয়নের কথা যেখানে বলা হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সপ্ত সিন্ধু’ এলাকাও হবে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এই এলাকাটি কোথায় বা এটি কী, সে কথা বলা হয়নি। সপ্তসিন্ধু বলতে যে সাতটি নদীকে বোঝানো হয়, তার অববাহিকার বড় অংশই অধুনা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। সহজ কথায় সিন্ধু অববাহিকা। (যদিও পরে এই তালিকায় গঙ্গা-যমুনাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।) তা হলে কেন্দ্রে মিলিজুলি সরকার হলে তারা উন্নয়নের তালিকায় পাকিস্তান-আফগানিস্তানকেও রাখবে? উত্তরটি স্পষ্ট নয়। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কোন পথে, তাও স্পষ্ট নয়।
মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছর পরে লোকপাল নিযুক্ত করেছে, মমতা সরকার তা নিযুক্ত করেছে ক্ষমতায় আসার সাত বছরেরও বেশি সময় পরে। তাই এই প্রসঙ্গটি কেন ইস্তেহারে উল্লেখ করা হল তাও স্পষ্ট নয়।
গুজরাট মডেল বনাম পশ্চিমবঙ্গ মডেল
গুজরাটে শিল্পায়ন হয়েছে। গুজরাটে সংখ্যালঘুরা ভালো আছে। সোজা কথায় এটাই ছিল ২০১৪ সালে গুজরাট নিয়ে প্রচার। মোদী-হাওয়ার ভিত্তিও ছিল তাই। এর উপরে ছিল হিন্দুত্ব-রামমন্দির প্রভৃতি। ভোটে দেখা গেল লোকে গুজরাট মডেলকেই বেছে নিয়েছে। তবে লোকে গুজরাট মডেলের পক্ষে ভোট দিয়েছে নাকি সেই সময় গলা পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে ডুবে থাকা কংগ্রেস-পরিচালিত ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে।
১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডের জনসভা। (ছবি: সুবীর হালদার)
প্রশ্ন হল, সেই মডেলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ-মডেলের তুলনা করা যায় কিনা।
নরেন্দ্র মোদী তখন একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ও বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দলের প্রচারকমিটির প্রধান ছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেও তৃণমূল কংগ্রেস একটিমাত্র রাজ্যেই সীমাবদ্ধ। গুজরাটে দাঙ্গা নিয়ে প্রচার করা হলেও সেই রাজ্যে শিল্পায়ন ঘটেনি, রাজ্যের বিকাশ ঘটেনি এমন কথা কোনও বিরোধী পর্যন্ত বলতে পারেননি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের অবস্থা এতটাই করুণ যে মুখ্যমন্ত্রীর একটি উক্তি উদ্ধৃত করে রাজ্যে এখন চপশিল্প কথাটি নিয়ে বেশ চর্চা শুরু হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করায় কাগজে-কলমে রাজ্যে কর্মসংস্থান হলেও, বাস্তবে রাজ্যের তরুণদের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অব্যবস্থায় রাজ্যের শাসকদলের দিকেই আঙুল উঠেছে। টানা প্রায় এক মাস চাকরিপ্রার্থীদের অনশনের ছবিও দেখেছে এই রাজ্য।
তা ছাড়া নির্বাচনের পরে বহুদলীয় সরকার গড়তে হলে অন্য রাজ্যগুলো কেন বাংলাকে মডেল বলবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে।
ইস্তেহারে লক্ষ্য
১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে সভা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা বার্তা স্পষ্ট ভাবেই দিয়েছিলেন যে তিনি এ রাজ্যের ৪২টি আসনে জয় নিয়ে ভাবছেন না, তিনি ভাবছেন কেন্দ্রের সরকার নিয়ে। বিজেপি যতই দাবি করুক যে এ রাজ্য থেকে তারা অর্ধেকের বেশি আসনে জয়ী হবে, এখনও পর্যন্ত অন্তত শরীরী ভাষা ও প্রচারের নিরিখে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূলই।
১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডের ছাপ রয়েছে তৃণমূলের ইস্তেহারেও। ইস্তেহারে সেই শরীরী ভাষাই রয়েছে যেটা সব আঞ্চলিক দলগুলিকে ব্রিগেডের মঞ্চে আনার সময় ছিল। অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস নিশ্চিত যে কেন্দ্রে বিজেপি-বিরোধী সরকারই হবে এবং সেখানে বড় ভূমিকা থাকবে তাদের।