বামেরা আর ক্ষমতায় ফিরবে না, তাই তৃণমূল বিরোধিতা করতে বাম কর্মীরা বিজেপিতে
২০১৬য় কোচবিহার আসনে উপনির্বাচনে বামভোট বিজেপিতে যাওয়া শুরু করেছিল
- Total Shares
৭ ডিসেম্বর কোচবিহার থেকে রথযাত্রা শুরু করছে বিজেপি। মহেশের রথ, মেলা, আম আঁটির ভেঁপুর অনুষঙ্গে রথযাত্রার সঙ্গে পরিচিত বাঙালি। তবে ভোটের জারকে চুবিয়ে মেরুকরণ উস্কে দিতে রথের রশিতে টান বঙ্গবাসীর স্মৃতিতে নেই।
ভোটে আসন বাড়ানোর অঙ্কে বিজেপির লাভের ঘরে রথযাত্রার সুখস্মৃতি আছে। ১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ মেনে নিম্নবর্গের মানুষের জন্য সরকারি চাকরিতে ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে বিজেপি তাদের ভোট ভাগ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখে। মন্ডল কমিশনের পাল্টা হিসেবে মেরুকরণের রাজনীতি লক্ষ্যে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আডবাণী অযোধ্যা বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত বিতর্ক উস্কে দেশ জুড়ে রথযাত্রার পরিকল্পনা করেন।
১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেন আডবাণী। রথের যাত্রা পথে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ছড়িয়ে ছিল। তবে এই কর্মসূচিতে বিজেপির গোলায়ে ভালোই ফসল উঠেছিল। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন বেড়ে হয়েছিল ১২২।
সামনেই লোকসভা নির্বাচন। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে মোদী ম্যাজিকে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। সেই নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র দু'হাত উপুড় করে ভোট দিয়েছিল মোদীকে। বিজেপির বিচক্ষণ নেতৃত্ব বুঝেছেন এবার ভোটে ওই রাজ্যগুলি থেকে সেই পরিমাণ ভোট আসবে না। এবার আর মোদী ওয়েভে ভেসে ভোট আসবে না। এবার বিভিন্ন রাজ্যে অনেক মাইক্রো ইস্যুতে ভোট হবে।
নব্বইয়ের আডবাণীর রথযাত্রা ৯১ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]
কৃষি, বেকারত্ব, স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হার কমা, ধর্মীয় অসন্তোষ বৃদ্ধি, নোটবন্দি ও জিএসটি ইস্যুতে গত চার বছরে বিজেপির সঙ্গে মানুষের মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়েছে। তাই ভোটের ঘাটতি পূরণের বিজেপি নেতৃত্বে চোখ এখন অসম সহ দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি এবং ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের দিকে।
এই রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা আসন সবচেয়ে বেশি। তার উপর বাম ও কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষয়িষ্ণু হওয়ায় বিরোধী পরিসরে পদ্মফুলের চাষ বেড়েছে। বিষেয়ত্ব, বাম ভোটের সিংহভাগ রাজ্যের বিভিন্ন উপনির্বাচনে বিজেপির ঝুলিতে যাওয়ায় তারা পুষ্ট হয়েছে।
কংগ্রেস ও বামেদের ভোটে পশ্চিমবঙ্গে পুষ্ট হয়েছে বিজেপি [ছবি: পিটিআই]
বিজেপির রথযাত্রা কোচবিহার থেকে শুরু হওয়ার পিছনেও এই অঙ্ক লুকিয়ে রয়েছে। ২০১৬ সালে কোচবিহার লোকসভার উপনির্বাচনে প্রথম বাম ভোটের বিজেপির বাক্সে যাত্রার ছবিটা ধরা পরে। ২০১৪ সালে মোদী ওয়েভের নির্বাচনেও এই লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ১৬.৩৪ শতাংশ। বামেরা পেয়েছিল ৩২.৯৮ শতাংশ। সেখানে, উপনির্বাচনে বামেদের ভোট কমে দাঁড়ায় ৬.৪৪ শতাংশ আর বিজেপির ভোট বেড়ে দাঁড়ায় ২৮.৩২ শতাংশ।
এর পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন উপনির্বাচনে বাম ও কংগ্রেসের ভোট পেয়ে বিজেপি এখন রাজ্যের দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি। তাই অঙ্ক কষে কোচবিহারকে ফোকাসে রেখেই রাজ্যে রথযাত্রা শুরু করছে বিজেপি।
বাম কর্মী সমর্থকদের এই রামযাত্রায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হওয়ার পর থেকেই, দলীয় নেতা কর্মীদের তুমুল তৃণমূল বিরোধিতা শিখিয়েছে সিপিএম। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও কেন্দ্রের বিরোধিতার মতো কতগুলি ক্লিশে কর্মসূচি ছাড়া তৃণমূল বিরোধিতাই বাম কর্মী সমর্থকদের মূল কর্মসূচি।
তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই সমর্থকদের শুধুই তৃণমূল বিরোধিতা শিখিয়ে ছিল বামফ্রন্ট [ছবি: পিটিআই]
আজ রাজ্যপাট হারিয়ে তৃণমূলের আগ্রাসনের মুখে পরে সেই বিরোধিতা আরও তীব্র হয়েছে। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার কোনও আশাই আর নেই তা বিলক্ষণ বুঝেছে বাম কর্মী সমর্থকরা। তাই না পড়া মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ ও চর্চা না করা কম্যুনিজমের পাট চুকিয়ে তৃণমূল বিরোধিতায় তারা এখন গেরুয়া শিবিরকেই বেছে নিচ্ছেন।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে প্রতিটি জনসভায় জ্যোতি বসু বিজেপিকে বর্বরদের দল বলতেন। এই নিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী অসন্তোষের কথাও তিনি বলতেন। তাঁর সেই দলের কাছেই এখন রক্ষা করতে হয়ে দেখা দিয়েছে বিজেপি। এই দিন দেখার আগেই চোখ বুঝেছেন জ্যোতি বসু। তাঁর প্রতি অবিচার না করার জন্য ইতিহাসকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় নেই।