জনপ্রিয়তা আগেই ছিল, পুলওয়ামা জঙ্গিহামলা পশ্চিমবঙ্গে বাড়তি সুবিধা করে দিল বিজেপিকে
বায়ুসেনার এয়ারস্ট্রাইক পশ্চিমবঙ্গবাসীর হৃদয়েও 'স্ট্রাইক' করেছে, মা-কাকিমার নয়নের মনি হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদী
- Total Shares
সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে কর্মরত এক পরিচিত ঝটিকা সফরে কলকাতায় এসে ছিলেন। এক সান্ধ্য আড্ডায় তিনি জানিয়ে গেলেন যে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে তিনি আবার আসবেন। অফিস আধিকারিকের কাছে তিনি নাকি মৌখিকভাবে অনুমতি নিয়ে রেখেছেন। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হলেই তিনি সরকারিভাবে ছুটির জন্য আবেদন করবেন। এত কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁর ভোট দিতে আসার উদ্দেশ্য একটাই, "তিনি নাকি বিজেপিকে ভোট দেবেন।"
বছর দশেকের গল্প বাদ দিন। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনেও এ রাজ্যে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি। যে নির্বাচনে এ রাজ্যে বামফ্রন্ট 'সাম্রাজ্যের' পতন ঘটেছিল সেই নির্বাচনের বিশ্লেষণ করতে বসে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিজেপিকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কাগজে কলমে মাত্র দুটি আসনেই জয় পেয়েছিল বিজেপি - আসানসোল ও দার্জিলিং। সেই নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনেও মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করেছিল বিজেপি। তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার পাঁচ শতাংশের সামান্য বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
কিন্তু গত বছর দু'দুয়েক ধরে বিজেপি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্য থেকে 'বড়' কিছু করার কথা ঘোষণা করে আসছে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তো জোর গলায় বলেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপি অন্তত ২৩টি আসনে জয়লাভ করবেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারী একটি অনুষ্ঠানে বিজেপি সভাপতি দাবি করেন, "পশ্চিমবঙ্গে আমরা দু'নম্বর দল হিসেবে উঠে এসেছি। নির্বাচনের ফলাফল অবধি অপেক্ষা করুন। পশ্চিমবঙ্গে আমরা অন্তত ২৩টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করব।"
অমিত শাহের দাবি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ২৩টি আসনে জয়লাভ করবে বিজেপি [ছবি: রয়টার্স]
২০১৪ সালের মাত্র তিনটি আসন থেকে বিজেপি সভাপতি ২০১৯ সালে ২৩টি আসন জয়লাভের কথা বলছেন। দিবাস্বপ্ন নয় কি? আসন সংখ্যা নিয়ে ভব্যিষদ্বাণী না করেও, একটু তলিয়ে দেখলে একটা কথা মেনে নিতে হবে। শেষ দু'বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জনপ্রিয়তা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি হয়েছে। তার কিছুটা আভাস আমরা শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনেও পেয়েছি।
কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ কী?
আমার মতে, এর প্রধান কারণ শহরের ভৌগোলিক পরিবর্তন। কলকাতায় বসবাসকারী অবাঙালিদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের একটা বড় অংশ আবার গুজরাট এবং হিন্দি বলয়ের থেকে এসেছে। অর্থাৎ, এই ভিন রাজ্য থেকে আসা ভোটারদের এই বড় অংশ বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক। দুই, কিছুদিন আগে অবধিও কলকাতা বা অন্যান্য ছোট ছোট শহরের একটি কী দুটি লোকালয়ে এই অবাঙালি বাসিন্দারা একত্রে থাকত। কিন্তু ক্রমশ তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। কলকাতাতে যেমন এখন প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই আপনি অবাঙালি ভোটারদের দেখতে পাবেন।
গত দু'বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে [ছবি: পিটিআই]
দুই, প্রচুর বাঙালি এখন ভিন রাজ্যে বা অন্য দেশে কর্মসূত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছেন। প্রথাগতভাবে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে বিজেপি সম্পর্কে যে সীমাবদ্ধতা ছিল সেই সীমাবদ্ধতা কিন্তু এই 'নব্য' প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে নেই। বেঙ্গালুরু থেকে আগত আমার সেই পরিচিত ব্যক্তিটির মতো। নির্বাচনের সময়ে তারা যদি ভোট দিতে পশ্চিমবঙ্গে আসেন তাহলে তাদের অধিকাংশ ভোটই কিন্তু বিজেপির অনুকূলে পড়বে।
যে বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গে রয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ যারা ভোটের ভাগ্য অনেকটা গড়ে দিতে পারবে, তারাও কিন্তু কিছুটা হলেও বিজেপিতে মজেছেন।
তাদের অভিযোগ, বর্তমান শাসক দল ক্ষেত্রে বিশেষে কয়েকটি ক্ষেত্রে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তোষণ করে চলেছে। এই তোষণ পশ্চিমবঙ্গে আগেও হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল আমলে এই তোষণ নাকি সরাসরি তাদের রুটিরুজিতে আঘাত করছে। আর, এই নিয়ে তারা যারপরনাই ক্ষিপ্ত বর্তমান শাসক দলের উপর। তারা মনে করছেন, এই মুহূর্তে তৃণমূলের বিকল্প কোনও মতেই কংগ্রেস কিংবা বামফ্রন্ট নয়। বরঞ্চ বিজেপিকেই তারা একমাত্র বিকল্প হিসেবে মনে করছে।
বায়ুসেনার এয়ার স্ট্রাইক পশ্চিমবঙ্গবাসীর হৃদয়েও স্ট্রাইক করেছে [ছবি: রয়টার্স]
আর এসবের মাঝেই পুলওয়ামা জঙ্গি হামলা নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা এমনিতেই দেশপ্রেমিক বলে খ্যাত। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি বা পশ্চিমবঙ্গবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামের তালিকা লিখতে বসলে সেই তালিকা সহজে শেষ হওয়ার নয়। পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার পর ভারত প্রত্যাঘাত করেছে। ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তানের সীমান্তে টপকে বালাকোটে বোমাবর্ষণ করে এসেছে। এ সংক্রান্ত খবর ও মতামতগুলো সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে প্রত্যক্ষ করেছে পশ্চিমবঙ্গবাসী। গোটা ভারতের মধ্যে তাদের মনেও দেশাত্মবোধের সঞ্চার হয়েছে।
বায়ুসেনার এয়ার স্ট্রাইকের পরিণাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসী মাথা ঘামাতে নারাজ। পাকিস্তানকে 'শিক্ষা' দেওয়া গিয়েছে তাতেই এ রাজ্যের বাসিন্দারা খুশি। আর, শুধুমাত্র তরুনদের নয়, ভারতের এই প্রত্যাঘাত মা-কাকিমাদেরও নাড়া দিয়েছে। আর, তাই নরেন্দ্র মোদী হটাৎ করেই তাদের 'নয়নের মণি' হয়ে উঠেছে।
নির্বাচন কটা আসন পাবে তা ভবিষ্যতেই জানা যাবে। কিন্তু বায়ুসেনার এয়ার স্ট্রাইক যে পশ্চিমবঙ্গবাসীর হৃদয়েও স্ট্রাইক করেছে তা বলাইবাহুল্য। আর, এই 'স্ট্রাইকে' সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে বিজেপি।