সংখ্যা কখনও মিথ্যা বলে না: প্রধানমন্ত্রী মোদীর অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অবদান

অর্থনীতিতে ‘ঘ’ পেলেও বলতে হবে প্রধানমন্ত্রী মোদী খুবই ভাগ্যবান

 |  5-minute read |   18-10-2018
  • Total Shares

মনিকা লিউইনস্কি নামে এক শিক্ষানবীশের সঙ্গে লাম্পট্যের জন্য নয়, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনকে লোকে আরও অনেক কারণে মনে রাখবে, তারমধ্যে একটি হল তাঁর সেই উক্তি, “ওরে নির্বোধ, এটা অর্থনীতি।”

কড়া জাতীয়বাদ, চূড়ান্ত দেশাত্মবোধ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ফাঁকা প্রতিশ্রুতি, বেশিরভাগ গণতন্ত্রই যা করে থাকে সেই যুদ্ধের বীরত্বের কাহিনি শোনানো প্রভৃতি ব্যতিরেকে এই একটামাত্র ধাক্কাকেই আগামী সবকটি নির্বাচনের একটি স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলেন—এটাই হল সবকিছুর ভারসাম্য রক্ষাকারী।

আগামী বছর ২০১৯ সালেই সেই  লোকসভা নির্বাচনের মহাযুদ্ধ হতে চলেছে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে – ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বা আইএনসির মধ্যে – যদিও এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় শক্তিশালী দল ও বিভিন্ন জোটও রয়েছে – যে কেউ একটা জোরদার লড়াই আশা করতেই পারেন। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে গত পাঁচবছরে নরেন্দ্র মোদীর অর্থনৈতিক অবদান ঠিক কেমন?

সত্যি কথা বলতে কী, এটা একটা বিশেষত্বহীন সময়, আর বলার মতো কোনও কিছুই নেই এই সময়ের রিপোর্ট কার্ডে।

embed-modi-1_101818055031.jpg বিগত পাঁচ বছরের সাফল্যের অর্থনৈতিক সূচকের নিরিখে এখন মোদীর অবস্থা কী (ছবি: ইন্ডিয়াটুডে)

২০০৮ সালে লেম্যান ব্রাদারের পতনের পরে বিশ্বজোড়া অর্থনাতিক মন্দা, যার জের পড়েছিল ইউরোজোনেও, যার জেরে আয়ারল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগাল সহ বেশ কয়েকটি দেশ রসাতলে যেতে বসেছিল সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিযা যখন শুরু হল, তার দু’বছর পরে দায়িত্ব পেলেন মোদী।

যে ইউপিএ ২ সরকার ভীষণ ভাবে নিন্দার মুখে পড়েছিল সেই ইউপিএ ২ সরকারের আমলেও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার গড় হার ছিল ৭.৪ শতাংশ (যা তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত করে দেখাতে পারবেন না নরেন্দ্র মোদী), যেখানে বিজেপি আমলে এখনও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়ে ৬.৪ শতাংশে।

তবে রাজনীতি এত পরিসংখ্যান-নির্র হয় না বরং তা হয় অনেকটাই বাগাড়ম্বর এবং এই কেবল টেলিভিশনের যুগে বিভিন্ন চ্যানেলে বলা ভিত্তিহীন কথা ও সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে। মোদী তাঁর রাজনীতির মূলধন করেছিলেন ইউপিএ আমলকে কথায় কথায় খোঁচা মারা ও তাদের হেয় করাকে, তিনি তাঁর শ্রোতা-দর্শকদের সামনে সেলসম্যানদের মতো সবকিছু ফুলিয়েফাঁপিয়ে বলেছিলেন, নাটকীয় ভাবে তিনি তাঁর অতিরঞ্জিত কথা শুনিয়েছিলেন। তাঁর সেই সব ব্যঙ্গবিদ্রূপ দারুণ ভাবে উপভোগ করেছিল সংবাদমাধ্যম, তারা প্রকৃত সত্য কী তা যাচাই করার প্রয়োজনই বোধ করেননি। মোদী কোনও কিছুকে পাত্তা দেননি, তিনি নির্বাচনে জয়ী হতে চেয়েছিলেন এবং যে কোনও মূল্যে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন।

যখন তিনি ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে উদ্যত হয়েছিলেন তখন তাঁর কাছে সত্য, বাস্তব, সংখ্যা, সমস্যা, বাধা, সত্যিকারের সমস্যা – এ সব অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। এটাই শেষ পর্যন্ত সত্য হিসাবে প্রতীয়মান হল – তাঁর বক্তৃতা থেকে উঠে এল তাঁর তৈরি করা সেই কল্পজগৎ এবং সেই আচ্ছেদিনের স্বপ্ন।

তিনি চাতুর্যের সঙ্গে তাঁর লক্ষ্য ২০২২ সালে নিয়ে চলে গিয়েছেন, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্যে ভর করে এখন তিনি ধরেই নিয়েছেন যে ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তিনি দুর্দান্ত ভাবে জয়ী হবেন এবং তিনি তাঁর অসমাপ্ত (সর্বনাশা) কাজ শেষ করবেন। বিভিন্ন পুরোনো কথা মনে করিয়ে দেওয়া, কয়েকটি প্রতীকী ব্যাপার তুলে ধরা, কল্পনা এবং আশার কথা বলে অত্যন্ত নৈপুণ্য ও চাতুর্যের সঙ্গে তিনি তাঁর প্রচার করছেন। মোদী সদাসর্বদা নির্বাচনী মেজাজে থাকেন; এতে অবাক হওয়ার কিছু না থাকলেও তাঁর সরকারই প্রশাসনের চরম মন্দ নিদর্শন স্থাপন করেছে – বিমুদ্রাকরণ, পণ্য ও পরিষেবা কর প্রয়োগ, অনাদায়ী ঋণ আদায়, আধারের ব্যবহার – যা অন্যদের অনুকরণ করে করতে গিয়েছিলেন। সবকটি ব্যাপারেরই শেষপর্যন্ত হাস্যকর পরিণতি হয়েছে। অর্থনীতি একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে, তা এক অর্থহীন মিথ্যা ও হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

তেল থেকে যে সুযোগ মোদী পেয়েছিলেন তা তিনি হেলায় নষ্ট করেছেন, এক সময় তেলের ব্যাপারে ভাগ্য তাঁর সহায় হয়েছিল, আর তিনি মনে করেছিলেন তিনি বিশাল এক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, তাঁর জন্যই এ সব সম্ভব হয়েছে। আর যখন পেট্রল-ডিজেলের দাম চড়চড় করে বাড়তে শুরু করল তখন তাঁর দলের মুখপাত্ররা এই দামবৃদ্ধির কারণ হিসাবে নির্বোধের মতো বিশ্বের পরিস্থিতিকে দোষ দিতে শুরু করে দিলেন। তাঁদের মহান নেতাকে রক্ষা করতে এই নিন্দনীয় অবস্থান গ্রহণ করলেন।

fuel-embed-2_101818055101.jpgযখনই পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ে তখনই মুখপাত্ররা মিনমিন করে সারা বিশ্বের অবস্থা বলতে শুরু করে দেন (ছবি: রয়টার্স)  

মোদীর কল্পনির্ভর অবাস্তব সব কথাকে বারে বারে সম্প্রচারিত করেছে টিভি চ্যানেলগুলি, তাঁরা মনে করেছিলেন তাঁদের প্রবল জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবোধের সঙ্গে ফোরেক্স বাজারে ভারতের টাকা সমানুপাতিক। এই ধারনা অর্থনীতির পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত এবং ভিত্তিহীন। বাস্তব হল টাকা এখন মারাত্মক ভাবে ধুঁকছে।

তবে মোদী কী ফেরি করেছিলেন সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক। ১০০ দিনের মধ্যে সমস্ত কালো টাকা দেশে ফেরাবেন, তরুণদের জন্য বছরে দু-কোটি কর্মসংস্থান, ন্যূনতম সহা.ক মূল্যের অঙ্ক হবে কৃষকদের উৎপাদনমূল্যের দেড়গুণ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন (বিমুদ্রাকরণের সময়ে টাকা পাচার এবং বিপুল অঙ্কের রাফাল কেলেঙ্কারি – এই দুটি উদাহরণই গর্বের বেলুন ফুটো করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট) প্রভৃতি।

চাকরির অভাব ক্রমে ক্রমে প্রকট হচ্ছে: রপ্তানি, মোট মূলধনী সম্পদ গঠন, উৎপাদনশিল্পে ঋণ বৃদ্ধি – কোনও কিছুতেই অবস্থা বিন্দুমাত্র ভালোর দিকে নেই, উল্টো মন্দের দিকেই। এই ভাবে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কপাল খুব ভালো হয়ে মোদীকে বড়জোর ‘ঘ’ দেওয়া যায়। সুযোগ কী ভাবে হারানো যায় তার অন্যতম বড় উদাহরণ হল ভারত, স্বেচ্ছায় সে নিজের বিপর্যয় নিজে ডেকে এনেছে।

পাঁর বছর ক্ষমতায় থাকার পরে মোদী যখন দেখছেন যে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি তখন ২০১৪ সাল থেকে ভারতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ যেখানে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোটামুটি ভাবে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ, যা একটা ধারায় পরিণত হয়েছিল। ২০০৫-০৬ সালে (যেটা পুরোপুরিই ইউপিএ আমল ছিল) দেশ থেকে ২৭.১ কোটি দারিদ্র দূরীকরণ করা সম্ভব হয়েছিল এবং কংগ্রেসের মডেল সার্বিক বিকাশ (ইনক্লুসিভ গ্রোথ) যে কার্যকরী তাও দেখা গিয়েছিল।

এই পদ্ধতি সত্যিই কাজের ছিল।

demonetisation-cash__101818055126.jpg অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে মোদী যদি ঘ পান, তাহলেও বলা যাবে তিনি যথেষ্ট ভাগ্যবান (ছবি: রয়টার্স)

২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ফরেন পোর্টফোলিয়োয় বিনিয়োগকারীরা ৭১০ কোটি মার্কিন ডলার তুলে নিয়েছে যা গড় বিদেশি অর্থ মজুদের ৫২ শতাংশ। এর ফলেই স্বল্পমেয়াদে আমাদের অর্থনীতির উপরে যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনীতির জেরে মার্কিন ফেডেরাল ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াতে পারে, এটা ভারতের কাছে যথেষ্ট সুসংবাদ। এর ফলে ডলারের ইল্ড বৃদ্ধি পাবে। এখানেও ক্ষীণ ভাবে একটা ব্যাপার দেখতে পাবেন, তা হল মোদী সরকার প্রতিভা – তারা চাইছে টাকার দর আরও পড়ে যাক। সত্যি কথা বলতে কী এই সরকারের যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে। রাজনীতি এই দেশের ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ২০১৪ সাল থেকে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে রয়েছে।

তা হলে এবার কী?

অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ধামাচাপা দিতে বিজেপির নীতি মেনে মোদী সেই একই ভাবে দেশাত্মবোধ ফেরি করবেন (অন্তর থেকে তিনি তা বিশ্বাসও করেন)। সাম্প্রদায়িকতার সুর আরও চড়া করবেন এবং সত্যিকারের সমস্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তারি করবেন। বিরক্তিকর ভাবে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রসঙ্গ টানবেন। যা ভাবা হচ্ছে তাই-ই তিনি করবেন।

তবে মনে করা হচ্ছে যে যারা জাতপাতের রাজনীতি করে তাদেরকেই শেষ পর্যন্ত বোকা বানানো হবে। অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠতার তাস খেলে আবার বিপথে চালিত করা হবে। আসল কথাটি হল অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মান। ভারতীয়রা ব্যাপারটা বোঝেন।

ভারতীয়রা একথাও জানেন যে সংখ্যা কখনও মিথ্যা বলে না।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANJAY JHA SANJAY JHA @jhasanjay

National Spokesperson of the Indian National Congress party. Co-author, The Superstar Syndrome.

Comment