প্রথম পর্ব: সুকৌশলে তৈরি করা "হিন্দু সন্ত্রাসের" ধারণা
বেশ কয়েক বছর ধরে তৈরি হওয়া ধারণাটির নামকরণ হয়েছে ইউএপিএ এক ও দুইয়ের আমলে
- Total Shares
বেশ কয়েক বছর ধরে একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে, দেশের মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে "হিন্দু সন্ত্রাস"।
কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউএপিএ এক ও দুই সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এই ধারণাটির একটি নামকরণও করা হয়েছিল - "গেরুয়া সন্ত্রাস"।
বেশ পারদর্শিতার সঙ্গেই এই ধারণাটি তৈরি করা হয়েছিল।
লস্কর-ই-তৈবার জঙ্গি নুসরাত জাহান, যাকে গুজরাট পুলিশ হত্যা করেছিল, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক রূপে সেলিব্রিটি হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তখন ফলাও করে খবর প্রকাশিত হয়েছিল - মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট মন্ত্রী অমিত শাহের নির্দেশে এই নিরপরাধ কলেজ ছাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। কিছু সংবাদমাধ্যমও এই বিশ্লেষণে সায় দিয়েছিল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাটিল সংসদ ভবনে "হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদ" নিয়ে একটি সুদীর্ঘ বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।
নির্বাচনের প্রাক্কালে হটাৎ করেই হিন্দু হয়ে উঠেছিলেন রাহুল গান্ধী [ছবি: পিটিআই]
তৎকালীন অর্থ মন্ত্রী পি চিদম্বরমও গেরুয়া সন্ত্রাস নিয়ে সকলকে সাবধান করেছিলেন। বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসবাদের কোনও ধর্ম হয় না, কিন্তু নির্দিষ্ট রঙ হয়।
রাহুল গান্ধীও এই বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন। এক মার্কিন দূতকে তিনি বলেছিলেন, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের থেকে ডানপন্থী সন্ত্রাসবাদ নাকি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। সেই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে রাহুল গান্ধীর কথোপকথন উইকিলিকস প্ৰকাশ করে দিয়েছিল।
কতকটা রাহুল গান্ধীর এই মন্তব্য নিয়ে উপহাস করতেই, ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে লস্কর জঙ্গিরা মুম্বাইয়ের দুটি হোটেল, একটি ইহুদি কেন্দ্রে ও মুম্বাইয়ের বৃহত্তম রেলস্টেশনে নির্মম হামলা চালিয়ে ১৬৬জনকে হত্যা করেছিল। প্রায় সাড়ে তিন দিন ধরে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই চলেছিল।
সমঝোতা এক্সপ্রেস সহ আরও তিনটি "হিন্দু সন্ত্রাসবাদ' মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন স্বামী অসীমানন্দ সহ আরও বেশ কিছু লোক। এর থেকে একটা বিষয়ে প্রমাণিত - বেশ রঙ মাখিয়েই হিন্দু সন্ত্রাসকে 'ভারতের বিপদ' হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছিল।
অবশ্য, স্বামী আসিমানন্দের মুক্তি নিয়ে, আদালত নয়, পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে কংগ্রেস। "গেরুয়া সন্ত্রাস" সম্পর্কে কংগ্রেসের মনোভাবটা দলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বেশ পরিষ্কার। কংগ্রেস কিন্তু ইতিহাসের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর পরামর্শদাতা স্যাম পিত্রোদা পুলওয়ামা জঙ্গিহামলায় জৈশ-ই-মহম্মদের ভূমিকা নিয়ে এবং ভারতীয় বায়ুসেনার বালাকোট এয়ার স্ট্রাইকের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কংগ্রেস দলের মধ্যে যে বড় একটা ফল্টলাইনের সৃষ্টি হয়েছে, তা এই ধরণের মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার।
Watch my answer. @ANI What major flaws do you see in the current government claim that it has been delivering to the last men, whether it is direct transfer of money or Ujjvala Yojana OR health insurance for poor even direct subsidy Aadhaar card. Where do you see the red lines? pic.twitter.com/xEMa2yR8xe
— Sam Pitroda (@sampitroda) March 23, 2019
"গেরুয়া সন্ত্রাস" যে "হিন্দু সন্ত্রাসের" চাইতে আলাদা তাই প্রমান করতে এখন একটি কুটির শিল্পের জন্ম হয়েছে। এই শিল্পের জন্মের কারণ, কংগ্রেস ও তার বন্ধুবর্গরা - যেমন সমাজবাদী পার্টি (এসপি), রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) ও বাম দলগুলো - বুঝতে পেরেছে যে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মকে মিলিয়ে দিলে প্রচুর সংখ্যক ভোট হারাতে হতে পারে।
আর, তাই তারা এখন "হিন্দু সন্ত্রাসকে" "গেরুয়া সন্ত্রাস" থেকে আলাদা করতে চাইছে।
এদিকে, হটাৎ করে হিন্দু হয়ে ওঠা, হিন্দু মন্দিরে প্রার্থনা করতে যাওয়া, গঙ্গার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা নিবেদন করা ও সাধুদের সঙ্গে সাখ্যাত লাভ করতে যাওয়ার যে প্রবণতা রাহুল গান্ধীর মধ্যে তৈরি হয়েছে তা কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের তরফ থেকে মেনে নেওয়া হয়েছে।
রাহুল কার পক্ষে সে সম্পর্কে মুসলমানরা সম্যক ওয়াকিবহাল। তারা জানে, রাহুলের এই মন্দির প্রীতি শুধুমাত্র ভোটযুদ্ধ জয়ের জন্যই। এমনিতে, তিনি "আমাদেরই" লোক।
তাঁর এই ছলচাতুরি দেখে বিদেশী সংবাদমাধ্যমও বেশ হতবম্ব হয়ে পড়েছে।
দ্য ইকোনোমিস্ট বেশ করুন সুরে লিখেছে, কংগ্রেস আর 'ধর্মনিরপেক্ষ' নয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ কাহিনীতে লেখা হয়েছে, "বিজেপির প্রধান বিরোধী কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছে। ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশ জয় করার পর, গোরক্ষা ইস্যুতে বিজেপিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। দলের তরফ থেকে অবসরপ্রাপ্ত গরুদের জন্য কয়েক'শ কোটি টাকা খরচ করে আস্তানা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। দলের জাতীয় নেতা রাহুল গান্ধীও এখন নিয়ম করে মন্দির দর্শন শুরু করে দিয়েছেন"।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ভারতকে সংখ্যা গরিষ্ঠদের দেশ বলে মনে করে, অনেকটা ইজরায়েল কিংবা পাকিস্তানের মতো। উল্টোদিকে যারা রয়েছে, তারা মনে করে যে ভারতের বিশাল বৈচিত্রই ভারতের মূল শক্তি। শেষ সাত দশকের অধিকাংশ সময়তেই দেশজুড়ে ধর্ম নিরপেক্ষতা লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু এখন 'গেরুয়া বসনধারী' হিন্দুত্ব ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মোদীর নেতৃত্বে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে"।
যতটা আশা করা গিয়েছিল হিন্দুত্ব নিয়ে ততটা মাতামাতি মোদী করেনি [ছবি: পিটিআই]
দ্য ইকোনোমিস্ট কোনও দিনও ভারতের জটিলতাকে বাস্তবতার সঙ্গে বিচার করেনি।
মোদীর অনুগামী ও বিরোধীরা যতটা আশা করেছিল, মোদী কিন্তু তার চাইতে অনেকটাই কম 'হিন্দুত্ব' নিয়ে মাতামাতি করে থাকেন। মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে নিজেদের মন্তব্যের বিপরীতে গিয়ে দ্য ইকোনোমিস্ট লিখছে, "অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের দাবি খুব বেশি দূর এগোয়নি। এই ইস্যুটি আদালতে অনেকদিন ধরেই আটকে রয়েছে। যা মোদীকে সাহায্য করেনি। এ বছরের কুম্ভমেলার এই বিষয়টি নিয়ে অনেক হিন্দু ব্যক্তিত্বই নিজেদের ক্ষোভ উজাড় করে দিয়েছে। স্বরূপানন্দ সরস্বতী যেমন বলেছেন - এত বছর ধরে আমাদের শুধু 'রাম' নাম করতে বলা হয়েছিল। আর, এখন আমাদের চুপ থাকতে বলা হচ্ছে। কপালে হলুদের টিকা লাগানো আর একজন হিন্দু যোগী জানিয়েছেন যে পবিত্র গঙ্গাকে সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে কোনও কাজ না করে বিজেপি ও আরএসএস আদতে তাদের বিশ্বাসকে অপহরণ করার চেষ্টা করছে"।
হিন্দুত্বে বিশ্বাসীরা যা আশা করেছিল মোদী কিন্তু ঠিক তেমনটা নয় - এই তথ্যটি একমাত্র দ্য ইকোনোমিস্ট ছাড়া আর কাউকেই অবাক করেনি।
প্রায় এক দশকের উপর মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর শাসনকালে তিনি সেই রাজ্য থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে (ভিএইচপি) প্রায় মুছে ফেলেছিলেন, বেআইনি ভাবে জবরদখল করে গড়ে ওঠা মন্দিরগুলো ভেঙে দিয়েছিলেন এবং ভিএইচপির দোর্দন্তপ্রতাপ সভাপতি প্রবীণ তোগাড়িয়াকে প্রায় বিস্মৃত করে দিয়েছিলেন।
১০০ কোটির উপর হিন্দু রয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। এছাড়া, আরও দুটি প্রধান ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টান ও মুসলমান ধর্ম। বিশ্বজুড়ে খ্রিস্টান ও মুসলমান অনুগামীদের সংখ্যা যথাক্রমে ২০০ কোটি ও ১৬০ কোটি।
এর মধ্যে প্রায় ২.৫ কোটি হিন্দু (২.৫ শতাংশ) একটি দেশেই বসবাস করে, ভারতে।
উল্টোদিকে, খৃস্টান ও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবচাইতে বেশি খ্রিস্টান থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ কোটি মুসলমান মানে গোটা বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জনসখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ। ইসলাম তো আরও বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ইসলামের দুটি পবিত্র স্থান মক্কা ও মেদিনা যে দেশে রয়েছে সেই সৌদি আরবে ৩.৩ কোটি মুসলমানের বাস। তার মানে বিশ্বজুড়ে ১৬০ কোটি মুসলমানের মাত্র ২ শতাংশ।
এর কারণ অবশই তলোয়ার ও বন্দুক।
ইসলাম তলোয়ার দেখিয়ে ধর্মান্তরে বিশ্বাসী। তাই তো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা সম্মিলিত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ৬০ কোটি মুসলমানের বাস, যা গোটা বিশ্বের মুসলমান জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ।
আর হিন্দু ধর্ম? এই ধর্ম কোনও দিনও ধর্মান্তরে বিশ্বাস করেনি। হিন্দু সন্ন্যাসীরা চিন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে গিয়েছেন। কিন্তু ধর্মান্তরের জন্য নয়, শিক্ষা প্রসারের জন্য। কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মন্দিরগুলোর আজও হিন্দু ধর্মের প্রভাব বহন করে চলে।
১০০ কোটি হিন্দুর এখন জাত-পাত কিংবা বর্ণ ভেদাভেদের উর্ধে উঠে হিন্দু ধর্মকে সত্যিকারের মাতৃতান্ত্রিক ধর্ম করে তোলা উচিত, যা হিন্দুধর্ম সর্বদা ছিল।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে