লোকসভা নির্বাচন ২০১৯: তড়িঘড়ি ঘোষিত অসম্পূর্ণ 'ন্যায়' প্রকল্প কংগ্রেসকে বিপদে ফেলবে
দারিদ্রর উপর শেষ আক্রমণের কথা বলছেন রাহুল, তাহলে 'ইন্দিরা লাও, গরিবি হঠাও' কী ছিল?
- Total Shares
দেখতে দেখতে আরও একটি নির্বাচনের মরসুম চলে এল। এই মরসুমে রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের নেতৃত্ব ভোটারদের খুশি করতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি করে না।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ছলচাতুরি রুখতে আর প্রথমশ্রেণীর কংগ্রেস নেতাদের দলত্যাগের খবর থেকে ভোটারদের দৃষ্টি সরিয়ে দিতে, কংগ্রেস সভাপতি দেশের ২০ শতাংশ দরিদ্রদের জন্য ন্যূনতম আয় যোজনার, সংক্ষেপে 'ন্যায়'-এর কথা ঘোষণা করেছেন। তবে এই ‘ন্যায়’ প্রকল্প নিয়ে রাহুল গান্ধী এখনও পর্যন্ত বিশদে কিছু জানাননি। শুধু বলেছেন, প্রকল্পটি তৈরির কাজ এখনও চলছে।
আমার মতে, এই প্রকল্পের রূপদান করা এখনও অসম্পূর্ণ রয়েছে। আর এই ধরণের অসম্পূর্ণ প্রকল্প তড়িঘড়ি ঘোষণা করে দেওয়া থেকে একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার - এই নির্বাচনে টিআরপি মুখ্য ভূমিকা নিতে চলেছে। এই টিআরপি টিভির টিআরপি বা টার্গেট রেটিং পয়েন্ট নয়, এই টিআরপি হল সময়ানুবর্তিতা (টাইমিং), (ইস্যু সম্পর্কিত) প্রতিক্রিয়া (রেস্পন্সিভনেস) ও ব্যক্তিত্ব (পার্সোনালিটিজ)।
প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই বলেননি রাহুল গান্ধী, কারণ প্রকল্প এখনও তৈরি হয়নি [ছবি: রয়টার্স]
বিশ্বাসযোগ্যতা যখন সঙ্কটে
নির্বাচনের প্রাক্কালে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়া ভারতীয় রাজনীতির দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। একটা সময় ছিল যখন সাধারণ মানুষ, দলীয় ইস্তেহারে লেখা কিংবা জনসভায় ঘোষিত এই সব প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে ভোটদান করত।
কিন্তু, বহু দশক ধরেই এই সব প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। এর ফলে ভোটাররা এখন পাঁচ বছরের শাসন ক্ষমতা তুলে দেওয়ার আগে বিশ্বাসযোগ্যতার উপর বেশি জোর দিয়ে থাকে।
তাই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে কংগ্রেস সভাপতি যখন বারংবার "দারিদ্রের উপর শেষ আঘাত" শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করলেন তখন বিষয়টি বেশ হাস্যকর বলে মনে হয়েছিল।
বিষয়টি হাস্যকর মনে হওয়ার কারণ কী ?
ইন্দিরা লাও, গরিবি হঠাও: ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী দেশ থেকে দারিদ্র্য মুছে ফেলতে তাঁকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০১২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ভারতীয় দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে। সুতরাং একাত্তরের সেই "ইন্দিরা লাও, গরিবি হঠাও" ডাক শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ব্যাঙ্কগুলো 'রাষ্ট্রায়ত্ত' হয়েছিল। মনে করা হয়, ইন্দিরার এই প্রচেষ্টা আদতে দেশের দারিদ্র্যের উপর একটা চরম আঘাত এবং শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্যই এই প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশের ৫০ শতাংশেরও কম নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
ওআরওপি: ২০০৪ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারের কংগ্রেস অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মীদের জন্য "এক পদ এক পেনশন" নীতি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রতিশ্রুতি তাদের নীতিগত বিরোধীদের সুবিধা করে দিল। ইউপিএ আমলে, ২০১৪-১৫ বাজেটে, ওআরওপি-র জন্য মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই আমলে, এই প্রকল্প পুরদস্তুর চালু হয়ে যাওয়ার পরে, প্রকল্পটির জন্য ৩৫,০০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।
২০১৪ সাল অবধি দেশের মাত্র ১১টি রাজ্যে খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু করা হয়েছিল। অথচ ২০১৪ সালের পরে এনডিএ সরকার, ইউপিএ-র মস্তিষ্কপ্রসূত এই প্রকল্প, দেশের সবকটি রাজ্যে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে বলবৎ করে ফেলেছে।
ঋণ মকুব প্রকল্প: দুর্ভাগ্যবশত, ২০০৩ সালে যে ঋণ মকুব প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছিল তা দিয়ে কৃষকদের লাভের লাভ কিছুই হয়নি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পরিস্থিতির সুরাহা না হওয়ায় একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে - এই প্রকল্প শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আর কিছুই নয়।
সম্প্রতি কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিসগড় সহ শেষ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে কাগজে কলমে কংগ্রেস বেশ ভালো ফল করেছে। কিন্তু বাস্তবে বহু বছরের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের স্বভাবের জন্য কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। কর্নাটকে ঋণ মকুবের প্রকল্প কাজে দিলেও, নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দেওয়া বেশ কিছু প্রকল্প এখনও দিনের আলো দেখেনি। এই প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে অন্যতম, তিন বছরের জন্য প্রতি পরিবারের একজনকে ১০,০০০ টাকা করে বেকার ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
দুর্নীতি
অতীতে আমরা স্থানীয় আধিকারিকদের হাতে দরিদ্রদের (যাঁদের জন্য প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে) প্রতারিত হতে দেখেছি।
আমার মতে, রাহুল গান্ধীর 'ন্যায়' আমলাদের হাতে দানগ্রাহীদের প্রতারিত হওয়ার পথটা আরও প্রশস্ত করে দেবে। এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করতে একগাদা নথিপত্রের প্রয়োজন পড়বে। এর ফলে, ঘুষ বা দালালির প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।
ন্যায় কিন্তু আয়ুষ্মান ভারতের মতো কোনও অধিকার-ভিত্তিক প্রকল্প নয়। এটি একটি নথি-ভিত্তিক প্রকল্প। এই প্রকল্পে নথিভুক্ত হতে গেলে পারিবারিক আয় জানাতে হবে এবং সেই আয় সংক্রান্ত নথিপত্র জমা দিতে হবে।
আমি আশঙ্কা করছি যে এক্ষেত্রে কারচুপি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন, একজন কর্মী যদি প্রতি মাসে ৭,০০০ টাকা করে উপার্জন করে, তাহলে এই প্রকল্পে তার আরও ৫,০০০ টাকা করে পাওয়ার কথা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, স্থানীয় আধিকারিকরা তার আয়ে ৬,০০০ দেখিয়ে তার জন্য ১,০০০ হাজার টাকা বেশি বরাদ্দ করার ব্যবস্থা করে দেবে। পরে, এই অতিরিক্ত ১,০০০ টাকা সেই স্থানীয় আধিকারিক দালালি হিসেবে নিয়ে নেবে। এই প্রকল্পে দুর্নীতির সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে।
রাজীব গান্ধী একবার স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে কেন্দ্রের দেওয়া প্রতি এক টাকার শুধুমাত্র ১৫ পয়সা 'ঠিক' লোকের হাতে পৌঁছায়। আমার মতে, এই স্বীকারোক্তি সম্পূর্ণরূপে ধৃষ্টতা, কারণ তিনি নিজে এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিকারের কোনও চেষ্টা করেননি। প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংশোধন করার চেষ্টা তিনি কোনও দিনও করেননি। তার জন্যে, বফর্স দিয়ে তাঁকে মূল্য চোকাতে হয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারতের কচ্ছপের গতিতে, মাত্র ৩.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হয়েছিল।
আয়করের সর্বোচ্চ হার ছিল ৯৮.৭৫ শতাংশ। এর ফলে ব্যবসায়ীদের কোনও সুবিধা তো হয়নি বরঞ্চ লোকের মধ্যে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কর ফাঁকি দিয়ে কালো টাকা জমানোর প্রবণতা বেড়েছিল।
২০০৩ সালের ঋণ মকুব প্রকল্পে কৃষকদের কোনও লাভ হয়নি [ছবি: পিটিআই]
দান বনাম ভর্তুকি
কোনও ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে শেষ ল্যাপটা কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জিং। আগের সরকার রাজনীতিতে দুর্নীতির অস্তিত্ব প্রয়োজনীয় বলেই মনে করত। অথচ এনডিএ সরকার ভর্তুকি প্রক্রিয়ার সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে তা প্রতিরোধ করতে নতুন প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছে।
জন আধার মোবাইল পরিষেবা চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে ভর্তুকির টাকা সরাসরি গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে। এই প্রতিবেদনটি লেখার সময়ে, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ৫৫টি মন্ত্রকের ৪৪০টি প্রকল্পের ৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি পৌঁছে গিয়েছে।
এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর মাধ্যমে সরকারের ১.২ লক্ষ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। যা 'ন্যায়' প্রকল্পে প্রত্যাশিত বরাদ্দ অর্থের চেয়েও বেশি।
প্রধানমন্ত্রী কিষান নিধি যোজনার মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা বছরের তিনটি কিস্তিতে ৬,০০০ টাকা পেয়ে থাকে, যা দিয়ে তারা কাঁচামাল কিনতে পারে।
একই ভাবে, প্রধানমন্ত্রী মাত্রু বন্দনা যোজনার মাধ্যমে একজন মহিলা প্রথম সন্তানের জন্মের পর কাজে যোগ দিতে না পারলে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পায়। এই প্রকল্প শুধু মাত্র সময়ের উপর নির্ভরশীল। এই প্রকল্পে পারিবারিক আয়ে কোনও নির্ণায়ক মূল্য নয়।
অন্যদিকে, 'ন্যায়' প্রকল্পে শুধুমাত্র পারিবারিক আয়ের উপর নির্ভর করেই টাকা পাওয়া যাবে।
গত পাঁচ বছরে ভারতের দরিদ্ররা স্বাস্থ্য পরিষেবা (আয়ুষ্মান ভারত), সরকারি ঋণ পরিষেবা (মুদ্রা), মহিলাদের নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন (উজ্জ্বলা) ও তরুণদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি দেখতে পেয়েছে।
'ন্যায়' প্রকল্প চালু হলে এই ধরণের সামাজিক সুরক্ষা কবচগুলোর কী অবস্থা হবে সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত নয়।
কংগ্রেসের কিন্তু এবারও দেশের আর্থিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কোনও দূরদর্শিতা দেখাল না। অর্থের অপচয় না করে কী ভাবে অর্থনীতির উন্নয়ন করা যায় সে নিয়েও কংগ্রেস নির্বিকার। সব মিলিয়ে, আমি যারপরনাই মর্মাহত।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে