কেন ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মোদীকে হারাতে পারবে না বিরোধীরা
কংগ্রেস যেখানে মূল প্রতিপক্ষ, সেখানে স্থানীয় দলগুলি তাদের সঙ্গে জোটে যাবে না
- Total Shares
সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে যদিও বিজেপির পরাজয় ঘটেছে এবং এনডিএ-তে ভাঙন ধরেছে, কিন্তু এ থেকেই ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর ভাগ্য নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা মারাত্মক ভুল হয়ে যেতে পারে।
উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের কয়েকটি আসনে পরাজয় এবং এনডিএর কয়েকটি সহযোগী দলের অসন্তোষ দেখে আগামী বছরেই মোদীরাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে, এ কথা আগেভাগে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
তাক লাগানো ফল করে ক্ষমতার আসার চার বছর পরে মোদীঝড় অনেক স্তিমিত হয়ে পড়েছে, তিনি দুর্বল হয়েছেন। কিন্ত এর পরেও বিরোধী নেতাদের তুলনায় তাঁর প্রভাব এতটাই বেশি যে চ্যালেঞ্জ জানানোর জায়গায় কেউ নেই।
সিপিএম, যারা অন্তর থেকে মোদী ও তাঁর দর্শনের বিরোধী, তারা বর্তমান অবস্থার একটা সত্যিকারের আন্দাজ দিতে পেরেছে। দলের পাক্ষিক মুখপাত্র পিপলস ডেমোক্র্যাসির সম্পাদকীয়তে সিপিএম স্বীকার করে নিয়েছে যে, মোদীকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার প্রশ্নে বিরোধীরা শোচনীয়ভাবে বিভক্ত।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে বিজেপির বিরুদ্ধে অকংগ্রেসি দলগুলোকে একজোট করার সময় বিরোধীদের ফাঁকফোকরগুলো ধরিয়ে দিয়েছে সিপিএম-ই। সিপিএমের মুখপাত্র তিনটি ব্যাপার তুলে ধরেছে— প্রথমত, মোদীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে ইউপিএ৩ সফল হতে পারবে না। তারা বলেছে, “গ্রহণযোগ্যতা হারানোয় আরও একটা ইউপিএ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে সফল হতে পারবে না কংগ্রেস এবং আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে হলে সব রাজ্যের বিজেপি বিরোধী ভোটকে এক জায়গায় আনতে হবে।”
এ হল কংগ্রেসকে নিয়ে খোলাখুলি ও কঠোর মন্তব্য।এই মন্তব্যের মাধ্যমে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের পুনরুত্থানগাথা একেবারে চুপসে দিয়েছে সিপিএম।
পিপলস ডেমোক্র্যাসি, যাতে সিপিএমের দলীয় অবস্থান প্রতিফলিত হয়, সেখানে জানানো হয়েছে, দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এখন কার্যত একঘরে, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে তিনি কংগ্রেসের হাত ধরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ত্রিপুরায় দলের পরাজয়ের পরে ইয়েচুরি এখন সংযত।
দ্বিতীয়ত, সিপিএম মনে করে, টিডিপি (তেলুগুদেশম পার্টি), টিআরএস (তেলাঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি)এবং বিজেডির (বিজু জনতা দল) মতো দলগুলো এখনও কংগ্রেস নেতৃত্বের অধীনে যেতে প্রস্তুত নয়। সিপিএম নিজেও মেনে নিয়েছে যে তারা বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলোকে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হবে না। এক্ষেত্রে তাদের অন্তরায় কেরল, কারণ সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।
যুক্তিটা খুব সোজাসাপটা। যে সব রাজ্যে স্থানীয় দলগুলোর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস, সেই সব রাজ্যে সেই রাজনৈতিক দলগুলি কংগ্রেসের সঙ্গে জোটও বাঁধবে না, আসন সমঝোতাও করবে না।তবে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের কথা সিপিএম বলেনি, কারণ, বাংলার এই নেত্রীর এখনও কংগ্রেসপ্রীতি শেষ হয়ে যায়নি। বাংলায় তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীই হল সিপিএম। তবে কংগ্রেস-সিপিএম জোট তাঁর মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
তৃতীয়ত, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে টিআরএস নেতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ফেডেরাল ফ্রন্টের ভাবনাকেও ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে সিপিএম।কংগ্রেসকে বাইরে রেখে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখন উৎসাহী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ গোপন করেননি মমতা। সে জন্যই ২০১৯ সালে মোদীর বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে আলোচনার জন্য সোনিয়ার ১৯ দলকে দেওয়া নৈশভোজে যোগ দেননি মমতা।
সিপিএম মনে করে, আরজেডি (রাষ্ট্রীয় জনতা দল)এবং ডিএমকে (দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগম)কংগ্রেসের সঙ্গে থাকায়, বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ করেই ফেডেরাল ফ্রন্টের যাত্রা শেষ হবে।
অল্প কথায়, বিজেপি বিরোধী দলগুলির এবং মোদী-বিরোধী জোটের অন্যতম দলই ভোটের আগে বিরোধী জোটের সম্ভাবনা খারিজ করে দিচ্ছে। যারা উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পরে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছিল, সেই সব বিরোধীদের কাছে এই বার্তা মোটেই সুখকর নয়।
সিপিএম মনে করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে হলে রাজ্যভিত্তিক জোট দরকার। এ ব্যাপারে তারা গোরক্ষপুর ও ফুলপুরে এসপি-বিএসপির জোট বেঁধে বিজেপিকে হারানোকে মডেল করতে চাইছে। তাদের কথায়, “বিজেপিকে হারানোর নির্বাচনী কৌশলের নিরিখে উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচন থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। উত্তরপ্রদেশে যদি তারা একগুচ্ছ আসন হারায়, তা হলে লোকসভায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছিও আসতে পারবে না।”
যদিও সিপিএমের নিজের যুক্তি হল, যদি মোদীর বিরুদ্ধে স্থানীয় দলগুলো জোটবদ্ধ না হতে পারে তা হলে অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর মতো সুন্দর, চাপমুক্ত যৌথ ফ্রন্ট ধাক্কা খাবে উত্তরপ্রদেশে।
রাজনীতির কলাকুশলীরা ও বক্তারাও বলছেন, এই দুই আসনে যে মডেলে ভোট হয়েছে, উত্তরপ্রদেশর ৮০টি আসনেই সেই মডেল অনুসরণ করতে। তাঁরা হয়তো ভুলে গিয়েছেন, এসপি এবং বিসএপি চূড়ান্ত ভাবে জাতপাত-নির্ভর দল হওয়ায় রামধনুরঙা জোটে তারা সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। বেশিরভাগ গ্রামে, যেখানে অনগ্রসর শ্রেণী (ওবিসি) এবং দলিতরা যথেষ্ট সংখ্যায় রয়েছে, সেখানে তাদের মধ্যে যথেষ্ট দ্বন্দ্ব-বিবাদ রয়েছে। যাদব পরিচালিত এসপির অনুগামীরা হল অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত এবং দলিতরা বিএসপির সমর্থক।
একই সমস্যা রয়েছে জেডিইউ এবং আরজেডির। যদিও মহাগটবন্ধন বা মহাজোট গড়ে তারা বিহারে বিজেপিকে হারিয়েছিল, কিন্তু তাদের সেই ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শেষ হাসি হেসেছিলেন মোদী ও শাহই।
বেশিরভাগ নির্বাচন বিশ্লেষকই বলছেন, এসপি এবং বিএসপির ভোট যোগ হলে উত্তরপ্রদেশে তারা পারে ৫০টি আসন, বাকি ৩০টি পাবে বিজেপি।এটা অবাস্তব ভাবনা।
ভারতে দীর্ঘ দিন ধরেই শাসকদলের বিরুদ্ধে সব বিরোধীরা জোট বেঁধে আসছে সেই ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে। সিপিএমের বক্তব্য অনুযায়ী, ঐক্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়ায় মোদী ও শাহ এখন ২০১৯ সালের দৌড়ে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে মোড় ৬৫টি আসনে বিজেপির সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুযোগ নিয়ে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে কংগ্রেস। কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার পাল্টা হিসাবে মোদীকে তারা ভোটের প্রচারে পেয়ে যাবে, যার উল্টোদিকে দাঁড়ানোর মতো কোনও কংগ্রেস নেতা নেই।
অনৈক্য ছাড়াও স্থানীয় স্তরে বিবাদ এবং মারাত্মক ইগো – যার ছোট্ট দুটি উদাহরণ হল মমতা ও মায়াবতী—এমন সমস্যারও মোকাবিলা করতে হবে বিরোধী দলগুলোকে।
এক, মোদীর মেকিয়াভেলিয়ান কৌশলের মুখোমুখি হতে হবে, ভারতে তিনিই একমাত্র নেতা যিনি ভোট নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারেন। দুই, বিজেপি নেতা অমিত শাহের ভোট-মিশনারি এবং আট কোটি আরএসএস ক্যাডার রয়েছেন তাঁর পিছনে।
বিরোধীদের কোনও সুযোগই নেই।