লোকসভা নির্বাচন: ২০১৪ থেকেও আসন্ন নির্বাচনে 'মোদী হাওয়া' বেশি দরকারি কেন
২৩০টির মতো আসনে কৃষি সঙ্কট চলছে, ক্ষমতা দখলের চাবিকাঠি এই আসনগুলিই
- Total Shares
বৈষম্যের রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক ক্যারিশমার বাইরেও বেশ কয়েকটি তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেই একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে - কেন ২০১৪ সালের চেয়েও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে 'মোদী হাওয়া' অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
ভারত কী জাত-ধর্মের ভিত্তিতে কিংবা আবেগতাড়িত হয়ে ভোট দেবে, নাকি সরকারের অধীনে তারা কতটা সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছে তার উপর নির্ভর করে ভোট দেবে - রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বরাবরই এই দু'টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নির্বাচনী হিসাবনিকাশ করে এসেছেন। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র এতটাই জটিল যে নির্বাচনী ফলাফল দেশের পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদদের সর্বদাই অবাক করে এসেছে।
শেষ দু'দশক ধরে ঘটে চলা দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও আয় বৃদ্ধির উত্তর চোখ রাখলে সেই সময়কার ভোটদানের পদ্ধতিটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
তবে এই পদ্ধতি মোদী-শাহের নির্বাচনী পদ্ধতির পরিপূরক নয়।
নির্বাচন ও অর্থনীতির যোগসূত্র নিয়ে কথা বলার আগে বেশ কয়েকটি গুতুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর চোখ রাখাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
২০১৪ সালে মোদী হাওয়া কাজ দিয়েছিল, এ বার মোদী হওয়ার প্রয়োজন আরও বেশি [ছবি: রয়টার্স/পিটিআই]
- সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলোর ফলাফল। যে সব রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে সেই রাজ্যগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার তফাৎ আকাশ পাতাল। গুজরাট, ছত্তিসগড় ও কর্নাটক মূলত শিল্পপ্রধান রাজ্য। অন্যদিকে, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও তেলাঙ্গনার অর্থনীতি অনেকেটাই কৃষি নির্ভর।আবার রাজস্থানের অর্থনীতিতে কৃষি ও শিল্পের মিশ্রণ রয়েছে।
বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার ঠিক আগের বছরে গুজরাট, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থানের জিডিপি রাজ্যগুলোর শেষ পাঁচ বছরের গড় জিডিপির চেয়ে কম ছিল।
- গুজরাটে বিজেপি বেশ কষ্ট করেই ক্ষমতায় ফিরেছে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় ও রাজস্থানে শাসক দল ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি। কংগ্রেস ও অকালি দলকেও কর্নাটক ও পাঞ্জাবের ভোটাররা বাতিল করেছে। এই ফলাফলগুলো থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার - জনতা শাসক দলের কাজ দেখে ভোট দিয়েছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি শুনে নয়।
- ২০১৫-১৬ সাল থেকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, কৃষি শিল্পেরও কোনও বৃদ্ধি হয়নি এই রাজ্যগুলোতে। এই চার বছরে গ্রামাঞ্চলের আয় কমেছে এবং কৃষি ও শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। এর ফলে শাসক দলের উপরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন ভোটাদাতারা।
- তেলাঙ্গনা, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য এই ধারা লক্ষ করা যায়নি। এই রাজ্যগুলোর শেষ পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এক হয় একই ছিল, নয়তো কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলোর চেয়ে এই রাজ্যগুলোতে কৃষি-শিল্পের বিকাশ অনেকটা বেশি হয়েছে।
ভারতীয় অর্থনীতি বেশ বিচিত্র, যার প্রভাব নির্বাচনেও পড়ে [ছবি: রয়টার্স/পিটিআই]
এই ধারাগুলোর উপর চোখ রাখলে লোকসভা নির্বাচনগুলোর পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে?
- রাজ্যের জিডিপি, কৃষি সঙ্কট ও গ্রামাঞ্চলের আয় দেখলে রাজগুলোর অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের একটি আভাস পাওয়া যায়।
- একটা কথা উল্লেখ করতে হবে, লোকসভার আসনগুলোর ৭০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। যে সব আসনের কিছুটা অংশ গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত, সেই সব আসনকে যোগ করলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
আমরা যদি এই রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক হাল, কৃষি সঙ্কট ও গ্রামাঞ্চলের আয়ের সঙ্গে রাজ্যগুলোর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষণ করি, তা হলে ভোটদানের পদ্ধতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।
১) বিভিন্ন সরকারি নথি ঘাটলে দেখা যাচ্ছে যে দেশের ১১টি রাজ্য কৃষি সঙ্কট চলছে। এদের মধ্যে হরিয়ানা, গুজরাট, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে শেষ তিন থেকে পাঁচ বছরে আংশিক খরা চলছে। বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কৃষিসঙ্কটের প্রভাব অনেকটাই কম।
২) কৃষি সঙ্কট কমানোর একটি উপায় রয়েছে - গ্রামীণ অর্থনীতি রূপায়ণের জন্য মোটা টাকা বরাদ্দ করা। ২০০৪ সালের পরে ইউপিএ যা করেছিল। কিন্তু মোদী জমানার বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কেন্দ্রের বাজেটে গ্রামাঞ্চলের জন্য বরাদ্দ অর্থ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের বরাদ্দ হওয়া অর্থের থেকে অনেকটাই কম।
৩) এখন বিজেপি ও অ-বিজেপি রাজ্যগুলোতে যে কৃষি ঋণ মকুবের ও নগদ অর্থদানের প্রকল্প শুরু হয়েছে তা কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিচার করে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে চালু করে হয়েছে।
সার্বিক উন্নয়নের উপর নির্ভর করেই শাসক দল পুনরায় ক্ষমতা দখল করেছে [ছবি: পিটিআই]
১৯৯৫ সাল থেকে, কয়েকটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া, যে সব রাজ্যগুলোতে অর্থনৈতিক ও কৃষি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে সেই সব রাজ্যগুলোতে শাসকদলের প্রাপ্ত ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১২ দেশের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল। আর, সেই সময়েই দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকদলগুলোতে পুনরায় ক্ষমতা দখল করতে দেখা গিয়েছে।
শাসন প্রক্রিয়ায় কোনও সমস্যা না থাকলেও, মূলত কৃষিসঙ্কটের জন্য ২০০৪ সালে এনডিএ হেরেছিল। ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকারে ফিরলেও, ২০১৪ সালে তাদের হেরে যাওয়ার পিছনে দু'টি কারণ রয়েছে - ইউপিএ জমানায় হওয়া একের পর এক কেলেঙ্কারি ও কৃষিসঙ্কট।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে রাজ্যগুলোতে কৃষি সমস্যা চলছে সেই রাজ্যগুলোতে ২৩০টির মতো লোকসভা আসন রয়েছে।
ক্ষমতা দখলের চাবিকাঠিটা এই আসনগুলোতেই রয়েছে। যে সব আসনগুলো নিয়ে বেশি আলোচনা চলছে সেগুলোতে নয়।
মোদী কি ধারার পরিবর্তন করে গ্রামীণ অর্থনৈতিক সঙ্কট মেটাতে পারবেন?
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে