দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে বিরোধীরা কী ভাবে সাহায্য করছেন নরেন্দ্র মোদীকে

মোদীর দুর্বলতা দুর্নীতি নয়, বিরোধীরা ভুল খেলছে

 |  6-minute read |   19-03-2019
  • Total Shares

“চৌকিদার চোর হ্যায়।”

বালাকোটে জৈশ-ই-মহম্মদের জঙ্গি ঘাঁটিতে আকাশপথে হামলা করার পরে দলের বর্ষীয়ান নেতারা কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীকে সুপরামর্শই দিয়েছিলেন – অন্তত কিছুদিনের জন্য “চৌকিদার চোর হ্যায়” বলা বন্ধ রাখুন। এটা উল্টে আমাদের দিকেই দেয়ে আসবে। লোকের ক্রোধ প্রশমিত হতে দিন। তার পরে আবার না হয় ‘চৌকিদার’কে আক্রমণ করবেন।

রাহুল যথাযোগ্য ভাবেই সেই পরামর্শ মেনে চলছিলেন।

কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিটি জনসভাতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে তাঁর অতি পছন্দের কথা “চৌকিদার চোর হ্যায়” বলতে শুরু করে দিলেন।

01narendra-modi-rahu_031919065405.jpg শেষ হাসিটি কে হাসবেন? প্রধানমন্ত্রী নিজেই #ম্যায়ভিচৌকিদার বলে প্রচার শুরু করায় রাহুলের “চৌকিদার চোর হ্যায়” বুমেরাং হয়ে গেছে। (ছবি: রয়টার্স)

তাঁর বিদ্রুপ আরও বাড়িয়ে রাহুল তাঁর পছন্দের অন্য অভিযোগগুলিও তুলতে শুরু করেছেন: “ভারতীয় বায়ুসেনার ৩০,০০০ কোটি টাকা চুরি করে অনিল আম্বানিকে দিয়েছেন মোদী।”

ইতিমধ্যেই জেলখানার বাইরে থাকার জন্য ৪০০ কোটি টাকার চেষ্টা শুরু করেছেন অনিল আম্বানি। সুইডেনের টেলিকম নেটওয়ার্ক সংস্থা এরিকসনকে এই টাকা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য অনিল আম্বানিকে চার সপ্তাহ সময় দিয়েছে সু্প্রিম কোর্ট, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওই টাকা মেটাতে না পারলে তাঁকে জেলে যেতে হবে। যদি রাহুল গান্ধীর অভিযোগ মতো নরেন্দ্র মোদী ৩০,০০০ কোটি টাকা “দিয়ে থাকেন” অনিল আম্বানিকে, তা হলে তাঁকে এই অবস্থায় পড়তে হত না।

তাই রাহুল গান্ধীর আনা #চৌকিদারচোরহ্যায় অভিযোগকে কৌশলে বিশাল ভাবে #ম্যায়ভিচৌকিদার স্লোগান তুলে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী।

মোদীর প্রতি রাহুলের আক্রমণ থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তিনি দেশের মানুষের মেজাজ কতটা কম বোঝেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতে পারে দুটি বড় বিষয়ের উপরে: জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতি। পুলওয়ামায় জৈশের সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে ভারতের বিমান হামলার ফলে চাকরি, কৃষকদের সমস্যার মতো অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে পিছনের সারিতে সরিয়ে দিয়ে ভোটের বাজারে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি করে সামনের সারিতে চলে এসেছে।

02mamata_031919065427.jpg বধিরের নৈঃশব্দ: দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বার করার বদলে বিরোধীরা ব্যক্তিগত ভাবে নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করছেন। (ছবি: রয়টার্স)

রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এমন যে কোনও কুশলী ব্যক্তিই এই সময় অর্থনৈতিক বিষয়গুলিতে লোকের নজর কাড়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেই সব পথ না মাড়িয়ে রাহুল গান্ধী আবার রাফাল ফাইটার জেট চুক্তি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে নরেন্দ্র মোদীকে অভিযুক্ত করে সেই পথে নতুন করে আক্রমণ করছেন। নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল দুর্নীতিহীনতা – আর তা সত্ত্বেও তাঁর দুর্বলতার দিকে আক্রমণ না করে তাঁর যে দিকটা শক্তপোক্ত, সেই দিকেই আক্রমণ করে চলেছেন রাহুল গান্ধী।

রাহুল গান্ধী যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে পর্যালোচনা করেন, তা হলে তিনি অনেক ফাঁকফোকরই খুঁজে পাবেন। ২০১৮ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে ৬.৬ শতাংশে নেমে এসেছিল। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন এখন ৭ শতাংশ স্পর্শ করার জন্য রীতিমতো লড়াই করছে।

উপযুক্ত প্রশাসন হল মোদীর আরেকটা দুর্বল জায়গা যে জায়গায় আঘাত হানতে পারেন রাহুল গান্ধী – তিনি তিনি তা করছেন না। প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ যখন প্রায় শেষ, তখন লোকপাল নিয়োগ করা হল। তথ্যের অধিকার আইন দুর্বল করে দেওয়া হযেছে। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনারে (সিআইসি) শূন্যপদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে পর্বতপ্রমাণ হয়ে গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে যে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মতো অগ্রণী প্রতিষ্ঠানে সরকারি হস্তক্ষেপ হয়েছে।

কিন্তু রাহুল গান্ধী কি এই সব বিষয়ের উপরে জোর দিচ্ছেন? যথোপযুক্ত ভাবে দিচ্ছেন না।

বাদবাকি বিরোধীদের অবস্থা আরও করুণ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন বালাকোটে সঠিক লক্ষ্যে ভারতীয় বায়ুসেনা আঘাত হানতে পেরেছে কিনা। সেই সংশয় দূর হয়েছে ইন্ডিয়া টুডের বিশ্বব্যাপী এক্সক্লুসিভ তদন্তে যা ১১ মার্চ সম্প্রচারিত হয়।

কোনও দেশ যখন যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে এবং সাধারণ নির্বাচনের মাত্র এক মাস বাকি তখন বিরোধীদের আবার নতুন করে প্রচার শুরু করতে হবে। বালাকোট পরবর্তী অবস্থায় রাফালের মতো ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খোঁচা দেওয়া যেখানে আর্থিক লেনদেন দেখা যাচ্ছে না (যা বফর্স ও অগস্টাওয়েস্টল্যান্ডের ক্ষেত্রে হয়েছে) – তাতে উল্টো ফল হতে পারে।

দুর্নীতি হল বিরোধীদের দুর্বল জায়গা – আর মোদীর শক্তি। যে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে (যার মধ্যে রয়েছে সারদা, রোজ ভ্যালি ও কয়লা কেলেঙ্কারি) তারা যদি কোনও রকম ভিত্তি ছাড়া নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন এবং বালাকোটে বিমান হামলার নিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাহলে তাঁরা নিজেরাই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।

এখন সমস্ত নজর অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও কৃষিসমস্যার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে? হাতে সময় খুবই অল্প।

দেশে প্রথম দফায় ভোটগ্রহণ হবে ১১ এপ্রিল এবং এখনও পর্যন্ত লোকের মনোভাব জাতীয়তাবাদী, তাই জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বিরোধীদের (এর মধ্যে রাহুল গান্ধীও রয়েছেন যিনি জৈশের প্রধান মাসুদ আাজহার জি বলে সম্বোধন করেছেন) মন্তব্য রাজনৈতিক ভাবে আত্মঘাতী হওয়ার সামিল। বিরোধীরা এবং গণমাধ্যমের একাংশ এখন অর্থনৈতিক সমস্যার কথা দূরে সরিয়ে “জাতীয়তাবাদ”-এর সংজ্ঞা কী হতে পারে তাই নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছে। তারা জাতীয়তাবাদকে উদার-বামপন্থা হিসাবে দেখাতে চাইছে।

বাস্তব তা নয়।

03unemployment_031919065451.jpg যাওয়ার পথ নেই – কেন বেকারত্ব নিয়ে কোনও কথা বলছে না বিরোধীরা? (ছবি: রয়টার্স)

ভারত ও ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দুটি ধারা দেখা যাবে। ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি লেখায় আমি এই দুইয়ের ফারাক দেখিয়েছিলাম। তাতে লিখেছিলাম:

“১৯৩০ সালে জার্মান জাতীয়তাবোধের অর্থ ছিল আক্রমণ করা ও জয়যুক্ত হওয়া। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতে জাতীয়তাবাদের অর্থ ছিল অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করা যেখানে জার্মানির জাতীয়তাবোধের অর্থ ছিল আক্রমণ, হিংসা এবং দেশের সীমা বৃদ্ধি করা। জার্মান ও ব্রিটিশ দেশাত্মবোধকে দেশাত্মবোধ না বলে উগ্র দেশপ্রেম বলাই শ্রেয়। ইউরোপীয় দেশপ্রেমের কথা নৈপুণ্যের সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়ে ভারতীয় দেশাত্মবোধকে খানিকটা খেলো করে দিতে চাইছে বামপন্থীরা। সত্যিকারের দেশাত্মবোধ সত্যিই ভালো, উদার এবং তা বহুত্বকে জায়গা করে দেয়। তা দেশকে সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করতে চায়, দেশের অর্থনীতির বিশ্বায়ন ঘটিয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থকে তুলে ধরতে চায় এবং সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে তাদের ক্ষমতায়ন ঘটায়।”

যথোপযুক্ত জাতীয়তাবোধের দিকে পদক্ষেপ করা হল উদানৈতিক বামপন্থার মতোই অন্তঃসারশূন্য একটা ব্যাপার। তবে সেটা আবার অন্য ব্যাপার।

সব দিক বিবেচনা করে আমার কাছে সত্যিকারের উদারপন্থার সংজ্ঞা হল: “ধ্রুপদী ভাবনায় উদারপন্থা হল বিরোধীদের বক্তব্যের প্রতি সহনশীল হওয়া। ভারতে বামপন্থীরা নিজেদের উদারপন্থী বলে মনে করে। বস্তুত তা নয়। কংগ্রেস নিজেদের উদারপন্থী সংগঠন হিসাবে ভাবতে ভালোবাসে। তবে তারা উদানীতির গুরুত্বপূর্ণ শর্তটাই মানে না: ভিন্ন মত পোষণকারীদের প্রতি সহনশীলতা। কংগ্রেসের রাজবংশ কোনওদিনও ভিন্ন মত পোষণকারীদের মেনে নেয়নি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে রাহুল গান্ধীর নির্বাচিত হওয়াকে কোনও প্রবীণ কংগ্রেস নেতাই চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখাতে পারেননি। উদারপন্থার আদর্শ উদাহরণ কখনোই আরএসএস নয়। তারা তাদের মূল সংগঠনে কোনও মহিলাকে সদস্য করে না। মহিলাদের জন্য তাদের আলাদা শাখা রয়েছে। তবে সেটিও উদারপন্থা নয়। এটা স্রেফ একটা প্রতীকি ব্যাপার। যতদিন পর্যন্ত কোনও মহিলা তাদের শরসঙ্ঘচালক হচ্ছেন ততদিন তাদেরও উদারপন্থী বলা যাবে না।”

* * *

নির্বাচনের শেষ লগ্নে এসে বিজেপি এখন তিনটি পন্থা অবলম্বন করতে পারে।

প্রথমত, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যা চলছে তাতে উগ্র দেশপ্রেম যোগ না করে তাকে নিজের মতো করে বইতে দেওয়া – এটা খুবই সূক্ষ্ম ভাবে পরিচালনা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ভোটদাতাদের মেরুকরণ করার ব্যাপারে মাথা না ঘামানো। গত পাঁচ বছরে যথেষ্ট মেরুকরণ হয়েছে, এর চেয়ে বেশি কিছু করতে গেলে তা বিজেপির পক্ষে হিতে বিপরীত হতে পারে।

তৃতীয়ত, গত পাঁচ বছরে তারা যে সব ভালো কাজ করেছে – যেমন পরিকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যবিমা, আর্থিক সংযুক্তকরণ এবং সরাসরি ভর্তুকি প্রদান করা – তার উপরে মনোনিবেশ করা।

সব মিলিয়ে, তাদের কাজের খতিয়ান ভালোই, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীকে চোর বলে সম্বোধন করা থেকে বেরিয়ে এসে কাজের মধ্য থেকে ফাঁকফোকর খুঁজে বার করতে হবে বিরোধীদের।

প্রধানমন্ত্রী অনেক কিছুই, ভালো মন্দ মিশিয়ে – তবে তিনি চোর নন।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MINHAZ MERCHANT MINHAZ MERCHANT @minhazmerchant

Biographer of Rajiv Gandhi and Aditya Birla. Ex-TOI & India Today. Media group chairman and editor. Author: The New Clash of Civilizations

Comment