ব্রিগেডে বামফ্রন্টের সমাবেশ: কী দিশা দেখাল সমর্থকদের?
লড়াই, সংগ্রাম, অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিপ্লব, জাতীয় সংহতি – বামফ্রন্টের ক্লিশে হয়ে যাওয়া শব্দ
- Total Shares
৩ ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্টের ব্রিগেডে যে ক’জন মানুষ এসেছিলেন, লেখার প্রথমে তাঁদের প্রতি কুর্নিশ জানানোটা অবশ্য কর্তব্য। তাঁরা এই বাজারেও দল এবং হয়তো বা আদর্শের প্রতি এখনও অবিচল – এটা স্বীকার করে নিতে কোনও দ্বিধা নেই। কিন্তু বামফ্রন্টের ব্রিগেড সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ এবং দেশকে কী দিয়ে গেল বা আগামী দিনে কী দিতে পারে এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
দেবব্রত বিশ্বাস বা ক্ষিতি গোস্বামী বা সুধাকর রেড্ডি বা আমন্ত্রিত অতিথি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এবং সর্বোপরি সীতারাম ইয়েচুরি – এই সমস্ত ব্যক্তিত্ব রাজ্য ও দেশকে দিশা দেখাবেন, এমনটা ভাবারও কোনও কারণ নেই।
কানহাইয়া কুমারের অনুপস্থিতিতে হতাশা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে বৃদ্ধ এবং অসুস্থ কিন্তু নিষ্ঠাবান বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ব্রিগেডের ময়দানে এনে বেলুনে কিছুটা হাওয়া ভরার চেষ্টা করেছে বামফ্রন্ট নেতৃত্ব।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গাড়ি ঘিরে ভিড়। (ছবি: সুবীর হালদার)
বার বার যে প্রশ্ন আমি তুলছি যে ভারতে বামপন্থীদের লড়াইটা কোন দিক দিয়ে সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ – কংগ্রেসের বিরোধিতা করা নাকি আরএসএস-বিজেপির বিরোধিতা করা?
নেতারা বলার চেষ্টা করলেন, তাঁদের লড়াই কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, নীতির বিরুদ্ধে। তাই যদি হয়, তা হলে অটলবিহারী বাজপেয়ী ও জ্যোতি বসু যখন এই ব্রিগেডে বসতে পারেন, তখন সীতারাম ইয়েচুরি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বসতে পারেন না কেন?
সারা পৃথিবীব্যাপী বামপন্থীরা চিরকাল নীতির দোহাই দিয়ে কৌশলগত রাজনীতি করেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতের বামপন্থীদের নীতি বা কৌশল কোনওটাই স্পষ্ট নয়। আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মতোই ২০১৯ সালে তাঁরা তাঁদের সংখ্যা বাড়ানোর মরিয়া চেষ্টায় চারিদিক হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
ব্রিগেডে লালঝান্ডার সারি। (ছবি: সুবীর হালদার)
পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে বামপন্থীদের ৩৪ বছরের রাজ্য শাসনের কলঙ্কময় স্মৃতি যত দিন না সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের মন থেকে বিস্মৃত হচ্ছে ততদিন এ রাজ্যে কোনও ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন এই দলগুলির পক্ষে বেশ কষ্টকর এবং রবিবারের ব্রিগেড আরও একবার প্রমাণ করে দিল যে, এই রাজনৈতিক গোষ্ঠী কতটা নেতৃত্বহীন ও দিশাহীন।
- পশ্চিমবঙ্গের ৪২, কেরলের ২০ এবং ত্রিপুরার ২ – সাকুল্যে এই ৬৪টি আসন ২০১৯-এর নির্বাচনে বামপন্থীদের লড়াইয়ের জায়গা।
কেরলের মানুষ কী ভাবেন সেটা একান্তই তাঁদের ভাবনা, ত্রিপুরার দু’টি আসন লোকসভার বিচারে নেহাতই নগণ্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনে বামপন্থীদের অন্তত এই বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে যে লোকসভায় রাজ্যের মানুষ বামপন্থী সাংসদ পাঠাবেন কেন। অন্তত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যে ভাবে সাম্প্রতিক কালে দু’বার প্রতারিত হয়েছেন – একবার জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে এবং একবার ইউপিএ ১ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের প্রশ্নে – তার স্মৃতি এখনও দগদগে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদাতাদের মনে। ইদানীংকালে অন্তত একটা বিষয় ভারতের ভোটদাতাদের মনে নিশ্চিত হয়েছে যে তাঁরা নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার নষ্ট করতে চান না। এবং সেই কারণেই তাঁরা একটা নির্দিষ্ট ভাবনার ভিত্তিতে ভোট দেন। লোকসভা নির্বাচনে বমপন্থীদের স্বপক্ষে এমন কোনও ইতিবাচক ভাবনা অন্তত রবিবারের ব্রিগেড তৈরি করতে পারল না।
২০১৯-এর নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায়। লড়াই, সংগ্রাম, অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিপ্লব, জাতীয় সংহতি – ইত্যাদি শব্দগুলো বামপন্থীদের গলায় একেবারেই ক্লিশে হয়ে গেছে। তাঁদের আদর্শ এবং তত্ত্ব যাই বলুক না কেন, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বামপন্থীরা আর পাঁচটা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মতো আরেকটা ক্ষমতালোভী এবং সংখ্যালোভী রাজনৈতিক গোষ্ঠী। সংসদীয় গণতন্ত্রের যাবতীয় অপগুণ তাঁদের মধ্যে বিদ্যমান।
ব্রিগেডের মঞ্চে বামফ্রন্ট নেতারা। (ছবি: ডেইলিও বাংলা)
পাঁচ বছর আগে দিল্লির আমআদমি পার্টির যে আবেগ অথবা ৫০ বছর আগে ভারতের বামপন্থীদের নিয়ে যে আবেগ – সেই যাবতীয় আবেগ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের গড্ডলিকা প্রবাহের নোংরা নর্দমা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে। এই জায়গা থেকে ফিরে আসা বা ঘুরে আসা – এই শব্দগুলো সাময়িক ভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢেউ তুলতে পারে অবশ্যই, কিন্তু ভোটে কতটা দৃঢ় ভাবে প্রতিফিত হবে, কী ভাবে হবে এবং কেনই বা হবে, আরও একবার বলছি, রবিবারের ব্রিগেড তার কোনও পথনির্দেশ করতে তো পারলই না, বরং মোদী-দিদির তত্ত্বে আরও কঠিন ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে গেল তথাকথিত নীতি এবং কৌশল।