কাশ্মীর ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা: বিভ্রান্তি ঠিক কোথায়
কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার কোনও প্রশ্নই ওঠে না
- Total Shares
এক দিকে চোখ ভরা জল, আরেক দিকে মুষ্টিবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। একদিকে দেশপ্রেমের ঢেউ, অন্য দিকে নাশকতার সময় এবং কারণ নিয়ে বিতর্ক। এমনকি প্রশ্ন এমন জায়গাতেও পৌঁছেছে যে শহিদ কে এবং কারা।
বিতর্ক বাড়াতে শুরু করলে কাল হয়তো এমন প্রশ্নও উঠবে যে ক্ষুদিরামের দল আদৌ শহিদ ছিলেন নাকি ছিলেন না।
ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকায় ঢাকা পুলওয়ামায় শহিদদের কফিন। (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এবং রাজনৈতিক নেতাদের বেপরোয়া মানসিকতায় এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, আজকের লেখা কোথা থেকে শুরু করা উচিত, কিই বা লেখা উচিত আর কেনই বা লেখা উচিত, এই সিদ্ধান্তে আসাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে চেষ্টাটা একটু অন্য ভাবে করা যেতে পারে। চেষ্টাটা এমন করা যেতে পারে যে লেখার শুরুটা হোক: রবি ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা আর কাশ্মীরের শালওয়ালা নিয়ে।
আমার ৫০ পেরিয়ে গেছে। জীনের একটা বড় সময় সময় কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের মফসসল শহরে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক ছাত্রছাত্রীদের মতো প্রাথমিক ভাবে কাশ্মীর নামক জায়গাটাকে জেনেছিলাম ভূগোল ও ইতিহাসের বই থেকে। কিন্তু প্রায় ৪০ বা ৪৫ বছর আগে সেই অজানা-অচেনা ভূস্বর্গ কাশ্মীর বোধহয় আমাদের সকলের জীবনেই অন্য ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল পাড়ায় পাড়ায় সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়ানো কাশ্মীরি শালওয়ালাদের উপস্থিতিতে।
শহরে শহরে ঘুরে বেড়ানো নাম না জানা সেই প্রবীণ কাশ্মীরি শালওয়ালারা সকলেই ছিলেন সকলের কাছে চাচা। আমাদের মতো ছোট্টরা প্রায় কেউই জানতাম না যে তিনি ইমরানচাচা না ফারুকচাচা নাকি অন্য কোনও চাচা, তিনি নির্ভেজাল চাচা।
এই চাচাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল বাড়ির মায়েদের একেবারে রান্নাঘর পর্যন্ত। এই চাচারা তাঁদের সামগ্রী রেখে যেতেন এমনকি একবছরের ধারেও – পরের বছর পুজোর পরে এসে পয়সা নেবেন, এমন বিশ্বাসের জায়গা থেকেও।
একটা সময় এমনও হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ চাকরির সুবাদে পাওয়া এলটিসি ব্যবহার করে অথবা অন্য কোনও ভাবে জম্মুতাওয়াই এক্সপ্রেস বা হিমগিরি এক্সপ্রেসে জম্মু থেকে শ্রীনগর পৌঁছাতেন শুধু সেই চাচার নাম ও বাড়ির ঠিকনাকে সম্বল করে।
প্রতিবছর পুজোর পরে, শীত আসার আগে চাচাদের আখরোটের অপেক্ষায় থেকেছে আমাদের মতো বালক-বালিকারা। আজও হয়তো এইরকম কিছু চাচা বা ভাতিজা পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে শহরে সেই একই সময় পৌঁছে যান। কিন্তু বুকে হত দিয়ে সত্যি করে বলা যায় কি, বিশ্বাসের সেই গভীরতাটা আজও বর্তমান?
কে কোন দলতে ভোটের দিন ভোট দিচ্ছেন সেটা বড় কথা নয়, কিন্ত আজ ভারতের চায়ের দোকানের প্রতিদিনের আলোচনায় একটা অবিশ্বাসের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে।
১৯৮০ সালে যখন প্রথম কাশ্মীরে পৌঁছেছিলাম তখন একবারের জন্যও শুনতে হয়নি যে আমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছি। কিন্তু আজকে যে কোনও মানুষ যে কোনও কারণে উপত্যকায় পৌঁছচ্ছেন, তাঁকে পৃথক ভাবে ইন্ডিয়ান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, এই বাস্তবকে যদি কেউ অস্বীকার করেন তবে সেটিকে বালিতে মুখ গুঁজে থাকা ছাড়া কিছু বলা যায় না।
এই হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসটাকে ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি।
তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন ওঠে যে কাশ্মীর কী চায়? কাশ্মীর কী এবং কেন – ইতিহসের সেই দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে ঢুকতে গেলে কোনও দিনও সেই লেখা শুরুও করা যাবে না। উপসংহার একটাই, সেটি হল – কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কাশ্মীর কী ভাবল, এটা যদি বিচার্য বিষয় হয়, তা হলে হায়দরাবাদ কী ভাবল, সেটাও তো বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত, অথবা দন্তেওয়াড়া কী ভাবল বা ঝাড়গ্রাম কি ভাবল, অথবা ব্রহ্মপুত্র বা বরাক উপত্যকা কী ভাবল, এই সবকিছুই ভাবতে হয়!
আমি আবার বলছি, ইতিহাসের পাহাড়প্রমাণ এখানে আলোচনার বিষয় নয়। কাশ্মীর কী চায়? কাশ্মীর কি স্বাধীনতা চায়? কাশ্মীর কি স্বায়ত্তশাসন চায়? কাশ্মীর কি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ চায়? কাশ্মীর কি চায় এটা কেন ভাবব? যেখানে উপসংহার একটাই যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেখানে এই প্রশ্নগুলো আসে কী ভাবে? তবে এটাই ঠিক যে উপত্যকার মানুষের মধ্যে এই ভাবনাটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ভাবনাটা আমাদের সেই চাচা শালওয়ালা কোনও দিন ভাবেননি।
তপন সিংহ পরিচালিত রবি ঠাকুরের কাবুলিয়ালা: আস্থা কমছে শালওয়ালা, কাবুলিওয়ালাদের প্রতি? (ছবি: ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)
ধীরে ধীরে বিষাক্ত করে হয়েছে উপত্যকার সমাজকে। আজকে কাশ্মীরের যুবসমাজ সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। তারা নিজেই জানে না যে তারা কী চায়। কাশ্মীরের হিংসা কিছু মানুষের ব্যবসার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের কোনও হরিপদর চায়ের দোকানে যখন কোনও উত্তেজিত মানুষ প্রশ্ন তোলেন যে কেন ৩৭০ ধারা – কোনও জবাব নেই তার কাছে। অথচ কাশ্মীরের মানুষ মনে করছেন যে এটা তাঁর জন্মগত অধিকার, অথবা অন্যভাবে বলা যায় যে তাঁকে বোঝানো হয়েছে, এটা তাঁর জন্মগত অধিকার।
এই যে একটা ভাবনার বিস্তর ফারাক, এর মাঝে সেতুবন্ধন করবে কে? কাশ্মীরে যদি গণভোট নিতে হয় কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিতে হয় কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ জানতে তা হলে ভারতের যে করদাতারা কর দিয়ে এসেছেন ৭০ বছর ধরে তাদেরও মধ্যে গণভোট হোক যে ৩৭০ ধারা থাকবে কি থাকবে না।
কিন্তু এটা ঝগড়ার সময় নয়, পাকিস্তান কী করল বা না করল সে নিয়ে উত্তেজনা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু কাশ্মীরের যে যুবসমাজ, তাদের যে মস্তিষ্কপ্রক্ষালণ ঘটেছে সেই অবস্থা থেকে তাদেরকে কী করে বের করে আনা যায় তার চেষ্টা কোথা থেকে এবং কী ভাবে শুরু হবে? উপত্যকায় কি একটা নবজাগরণের প্রয়োজন নেই?
টেলিভিশনের পর্দায় অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় অথবা অন্য সংবাদমাধ্যমে অদ্ভুত সব যুক্তি দেখা যায়। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে রিগিংয়ের পর থেকেই নাকি কাশ্মীরের সমাজ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তাই যদি হয় তা হলে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন একবার করে বিদ্রোহ ঘোষিত হবে!
পুলওয়ামায় বিস্ফোরণস্থল। (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
হাতে বন্দুক তুলে নেওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না, সেটা অসমই হোক, সেটা মণিপুরই হোক, সেটা নাগাল্যান্ডই হোক, সেটা লালগড়ই হোক, সেটা বস্তারই হোক অথবা সেটা কাশ্মীরই হোক। আমারও তো সমাজের বিরুদ্ধে প্রচুর ক্ষোভ। আমার হাতে পয়সা নেই, আমার চারপাশে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেদের ভিড়, আমাকে একটা কাজ করতে গেলে ঘুষ দিতে হয়, আমি ভোটকেন্দ্রে গেলে কোনও কোনও বার ভোট দিতে পারি না – এটা কোনও কারণ হতে পারে বন্দুক হাতে তুলে নেওয়ার? এবং এই বন্দুকের রাস্তা থেকে যে একটা চূড়ান্ত শান্তির পরিবেশে ফিরে আসা যায়, তার তো বড় উদাহরণ মিজোরাম ও পঞ্জাব, এবং বেশ কিছুটা অসমও, এবং ইদানীংকালের মণিপুর ও নাগাল্যান্ড। এবং অবশ্যই আমাদের ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরা। পশ্চিমবঙ্গেও তার উদাহরণ রয়েছে।
সম্ভব যে নয়, তা তো নয়। তাহলে কাশ্মীরেও সম্ভব। কিন্তু সেটা অবশ্যই অভ্যন্তরীণ ভাবে। অরুণাচলপ্রদেশ নিয়ে যেমন চিনের সঙ্গে কোনও আলোচনা হতে পারে না, কাশ্মীর নিয়েও পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনা হতে পারে না। কেন আলোচনা হবে? কোন বিষয় নিয়ে তারা কাশ্মীরের সঙ্গে সংযুক্ত? তাহলে তো আগে মেনে নিতে হবে যে কাশ্মীর একটা বিতর্কিত ভূখণ্ড। অথবা মেনে নিতে হবে যে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের কোনও একটা নির্দিষ্ট অসৎ উদ্দেশ্য আছে।
অরুণাচলে কি চিনের কোনও চেষ্টা নেই? আজকাল তো পশ্চিমবঙ্গের বহু পর্যটক দলে দলে তাওয়াং বেড়াতে যাচ্ছে। কোনও দিন কি মনে হয়েছে যে তাওয়াং একটা বিচ্ছিন্ন অংশ? অরুণাচলেও তো যুবসমাজ আছে। তা হলে কোন যুক্তিতে কাশ্মীর উপত্যকায় যুবসমাজের মস্তিস্কপ্রক্ষালন ঘটে গেল?
আমি আবার বলছি সমস্ত আন্তর্জাতিক ইন্ধনকে উপেক্ষা করে কাশ্মীর উপত্যকায় সামাজিক নবজাগরণের প্রয়োজন আছে, সেটা কোথা থেকে কী ভাবে হবে , শুরুটা কেই বা করেন, তা ঈশ্বর জানেন। কিন্তু রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডা অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লব কোনও ভাবেই এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না।