কর্তারপুরকে আমরা যে ভাবে রঙীন চশমায় দেখছি
ঘটনাবহুল পরিস্থিতির মধ্যেই উদ্বোধন হল কর্তারপুর করিডোর। সিধু এবার কোন ভূমিকায়?
- Total Shares
বিগত কয়েক সপ্তাহে এমন সব ঘটনা ঘটল যাকে বোধহয় জাগতিক ঘটনা বলা চলে না।
জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাস-দমনে সাতটি অভিযান হয়েছে, রাজ্যে দশটি সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে এবং একটি স্নাইপার হামলা হয়েছে। ওই অভিযানে নিরাপত্তারক্ষীরা ২৩জন জঙ্গিকে হত্যা করেছে। শেষ যাকে নিহত করেছে সেই লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গি নাভিদ জাট সাংবাদিক শুজাত বুখারিকে হত্যা করেছিল।
এই সব ঘটনাবলির মাঝেই আমরা দেখলাম যে নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীনগরে হুরিয়তের সঙ্গে বৈঠক করলেন এবং তার পরে বিমানে ইসলামাবাদে গেলেন, নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে তিনি কোনও এক বার্তা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। যখন পুরো দেশ ২০০৮ সালের মুম্বাইয়ের সেই জঙ্গি হামলার কথা স্মরণ করছে, যখন ইন্ডিয়া গেট বাক বাকস্তব্ধ হয়ে রয়েছে তখন সকলের সব নজর ঘুরে গেল কর্তারপু সাহিবের দিকে।
পবিত্র ধর্মস্থানকে রাজনৈতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিণত করেছে পাকিস্তান (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
প্রস্তাবিত ওই করিডোর হবেই, কয়েক সপ্তাহ আগেই সে কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। আচমকা ভারতও সেই প্রস্তাব মেনে নিল যে ২৬ নভেম্বর ভারতের দিকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে এবং পাকিস্তান সরকার সূচনা করবে ২৮ নভেম্বর। আমাদের সব সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় পৃষ্ঠাগুলি ভুলে গেল যে আমরা ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন নতুন পাক প্রশাসনের দিকে ঢলে পড়তে শুরু করেছি।
আমরা পাকিস্তানের সেই প্রচারে ধাক্কায় তাদের বাতাসে গা ভাসালাম যে শিখরা গুরু নানকের মন্দিরে তীর্থযাত্রা করতে পারবেন। একটি অনুষ্ঠানে নির্লজ্জভাবে খলিস্থানি নেতা গোপাল সিং চাওলার সঙ্গে তাদের মাখামাখি দেখিয়েছে পাকিস্তান। লাহোরের দিকে তাকান, পাকিস্তানের সেরা সম্পদ হাফিজ সঈদকে প্রশ্রয় দিয়ে, মূল স্রোতে রেখে দিয়ে সমান্তরাল একটি চরমপন্থী শক্তিতে মদত দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান।
উষ্ণতা! সিধুর বন্ধু কামার বাজওয়ার বিরুদ্ধে খলিস্থানি জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে এবং সে ভারতে হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা (ছবি: স্ক্রিনগ্র্যাব/ ইউটিউব)
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিশাল হৃদয়ের পরিচয় দিতে শুরু করে দিল পাকিস্তান আর তাদের সেই বিপুল ঔদার্য দেখে গণমাধ্যম থেকে পঞ্জাবের শিখরা, সকলে রুদ্ধশ্বাস হয়ে গেল। একই সঙ্গে তারা ভারত সরকার ও খলিস্থানিদের জানিয়ে দিল যে তারা সরকারি ভাবে খলিস্থানি আন্দোলন সমর্থন করে। নভজ্যোত সিধু তখনই ভীষণ ভাবে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলেন – যদিও আমাদের দুই মন্ত্রীর কাউকেই তখন ওখানে দেখা গেল না।
নিমেষেই আমরা অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে ফেললাম এবং পরার্থবিমুখ হয়ে পড়লাম, আমরা ভুলে গেলাম পুলিশকর্মী তুকারাম ওম্বলের আত্মবলিদানের কথা যিনি আজমল কাসবকে ধরেছিলেন যে কাসব ছিল ২৬/১১ হামলার পাকিস্তানের জড়িত থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। যদি তুকারাম ওম্বলের মতো সাহসী ব্যক্তি সে দিন ওখানে না থাকতেন তা হলে হয়তো আমরা কোনও দিনই আজমল কাসবকে জীবন্ত ধরতে পারতাম না আর নিহত কাসবকে দিয়ে পাকিস্তান-যোগ হয়তো কোনও দিনই প্রমাণ করা সম্ভব হত না। আমরা সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম ল্যান্স নায়েক নাজির আহমেদ ওয়ানির কথা যিনি কাশ্মীরে জঙ্গিদের দমন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানিদের আলিঙ্গন করতে গিয়ে আমরা ভুলে গেলাম মুম্বইয়ের সেই পুলিশকর্মী তুকারাম ওম্বলের জীবন উৎসর্গ করার কথা (ছবি: ফেসবুক)
তখন নভজ্যোৎ সিং সিধু সেই জায়গা সফর করছেন, এই কথা শুনে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিংয়ের সক্রোধ জবাব যে তিনি নিজের মতো করে সফর করছেন, তাঁর কথার দুটো অর্থ হতে পারে। তিনি তখন সেই ঘটনার পরিণতির কথা চিন্তা করছেন যার ফল পঞ্জাব তো বটেই, পুরো দেশের ক্ষেত্রেই ভায়াবহ হতে পারে, কারণ বহু খলিস্থান-পন্তীকেই আশ্রয় দিয়েছে পাকিস্তান। এক সপ্তাহ আগে অমৃতসরে খলিস্তানি সন্ত্রাসে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এবং অমরিন্দর সিংয়ের আশঙ্কা কাশ্মীরের জঙ্গিরা এখন জম্মু-কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করছে। হাজার হাজার ভারতীয়র মৃত্যুর জন্য দায়ী পাক সেনাপ্রধানকে সিধু আলিঙ্গন করায় তাতেও দৃশ্যতই ক্রুদ্ধ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
নভজ্যোৎ সিং সিধুর অদ্ভুত আচরণে মোটেই খুশি নন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং (ছবি: পিটিআই)
এ সবের মধ্যেই সেই সফর হয়ে গেল, সেই ঘটনা ঘটে গেল যাতে সকলেই বাকরুদ্ধ, আমারা উদ্বোধন করলাম সেই করিডোর যা কর্তারপুর সাহিব গুরদ্বার থেকে ডেরা বাবা নানক পর্যন্ত বিস্তৃত।
তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?
দীর্ঘ দিন ধরে পাকিস্তানের বিষয়ে দেখতে দেখতে আমরা এখন একটা ব্যাপার পাকিস্তানের থেকে আশা করে থাকি যে তারা অভাবনীয় কিছু একটা করবে – পাকিস্তানের হৃদয়ের কোনও পরিবর্তন হয়নি।
পাকিস্তানের যে এখনও কোনও বদলই ঘটেনি এবং তারা যে এখনও সন্ত্রাসবাদকে নির্লজ্জ ভাবে সমর্থন করে সেই মেকিয়াভেলিয়ান সত্যটি কি ভারত যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পারবে? এ কথা সত্যি যে কিছু কিছু রাজনৈতিক যৌক্তিকতা থাকবে তবে মন্ত্রক এবং গোয়েন্দা সংস্থায় যে সব পেশাদাররা আছেন তাঁরা এটিকে অন্য ভাবে দেখতে পারেন। এর মাধ্যমে কি সচেতন ভাবে কোনও মিশ্র ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে? তাদের পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য আমাদের কি কোনও নির্দিষ্ট পন্থা রয়েছে?
নাকি এটা শেক্সপিয়রীয় একটি কমিক যার মধ্যে সেই হলাহল রয়েছে যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যের সেই চিরকালীন মন্দ সম্পর্ক বয়ে নিয়ে চলবে যেখানে কপিল শর্মার শোয়ে অভিজ্ঞ নভজ্যোৎ সিধু ভাঁড়ের ভূমিকা পালন করেই চলবেন?
আসলে ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া কর্তারপুর নিয়ে সিধুর খুব একটা ভূমিকা নেই (ছবি ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)
তবে সিধু যদি সত্যিই তা করতে যান তা হলে সেই বিনোদনটি হবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ, এবং সত্যি কথা বলতে কি অত্যন্ত মোটাদাগের।
এর চেয়েও খারাপ যা হতে পারে তা হল, আমরা রাষ্ট্র হিসাবে এখনও পাকিস্তানকে বুঝে উঠতে পারিনি এবং তাদের আচরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি বলে আমরা অতি সন্তর্পণে পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। এ থেকে একটা ছোট সিদ্ধানেত আমরা আসতে পারি যে আমরা নীতিগত ভাবে হিসাবে এর সুফলের প্রত্যাশা করব।
হতে পারে যে এর ফলে রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। রাষ্ট্রটি ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল – তবে রাষ্ট্রটি ক্রমেই চরমপন্থী হয়ে উঠেছে এবং সে দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী নাগরিকের মধ্যেও অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে। আরেকটি দিক হল ভারতের, এটিকে হিন্দুদের প্রতিও বলতে পারেন, ঘৃণা পোষণ করা। সারকথা হল পাকিস্তান চিরকালই এই স্বপ্ন ফেরি করে যাবে যে তারা একদিন তারা পুরো ভারত দখল করে নেবে, তারা পাকিস্তানের প্রাধান্য বজায় রাখতে পারবে।
আমাদের শিখতে হবে কী ভাবে এই দেশটির প্রতি উপযুক্ত আচরণ করা যায় যার ফলে রঙীন কাচের মধ্য দিয়েও তাদের দেখব না, তাদের সম্বন্ধে কোনও ভ্রমও হবে না।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে