কর্নাটকে নরম হিন্দুত্ব রাজনীতি কাজে এল না কংগ্রেসের
ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে আবার বিপাকে পড়ল দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল
- Total Shares
কর্নাটকে এখন পিছনের দরজা দিয়ে সরকার গঠন করা হবে। তা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে অন্য একটা বিষয় মনোনিবেশ করা যাক। কর্ণাটক নির্বাচন থেকে সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষা কী পাওয়া গেল? ইতিহাস অস্বীকার করবার খেসারত কিন্তু মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে সভাপতি রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে নির্বাচন লড়াইয়ে নেমেছিল কংগ্রেস। অতীতে রাহুলের বাবা রাজীবও এই একই ভুল করেছেন। কিন্তু কংগ্রেস সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে নারাজ।
ভুলের মাসুল অবশ্য নির্বাচনের ফলাফলে গুণতে হয়েছে কংগ্রেসকে।
কংগ্রেস এই হিন্দুত্ব প্রচার গোটা নির্বাচন জুড়েই চালিয়েছে। এর আগে গত বছর গুজরাট নির্বাচনেও রাহুল হিন্দুত্ব প্রচারকে হাতিয়ার করতে নিজেকে শিব ঠাকুরের ভক্ত হিসেবে দাবি করে রাজ্যের বিভিন্ন মন্দিরে দর্শন করেছিলেন। কিন্তু এই প্রচার করতে গিয়ে রাহুল গুজরাটের দরগা বা মসজিদ দর্শনে খুব একটা সময় ব্যয় করতে পারেনি। তাও এমন একটা সময়ে যখন ওই রাজ্যে মুসলমানদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে।
কংগ্রেস এই হিন্দুত্ব-প্রচার গোটা নির্বাচন জুড়েই চালিয়েছে
হিন্দুদের উপর বিজেপির প্রভাব কমাতে বেশ কয়েকটি কৌশলী উপায় অবলম্বন করেছিল কংগ্রেস। কিন্তু কংগ্রেস শুধুমাত্র লিঙ্গায়তদের কিছুটা প্রভাবিত করতে পেরেছে। কর্নাটক জুড়ে মোট ১৮ শতাংশ লিঙ্গায়ত ভোট রয়েছে। এর মধ্যে ১০০টির বেশি কেন্দ্রে তারা বেশ শক্তিশালী।
কংগ্রেসের এই স্ট্রাটেজি থেকে অন্য একটি সমস্যার সূত্রপাত ঘটল। লিঙ্গায়ত ও বীরশৈবদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলেন যে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারে থাকার সময় লিঙ্গায়তকে আলাদা ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত। কংগ্রেসের এই পদক্ষেপে হিন্দু ধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলো ক্ষিপ্ত হয়ে বিজেপির সমর্থন শুরু করে দিল।
মুসলমান সমাজকে খুশি করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও পাত্তা দেননি
এর থেকে আরও একবার প্রমাণিত হয়ে গেল যে অন্যান্য দলগুলোর মতো কংগ্রেস ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, যা সকলেই জানত কিন্তু খুব কম লোক প্রচার করত। ভাবতে পারেন, জওহরলাল নেহরু-সহ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী এই দলটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যাঁরা বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবে সমাজতন্ত্র নিয়ে বড় বড় ভাষণ দিতেন।
কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের এই বক্তৃতা কর্নাটক নির্বাচনে যে বিফলে গেল, তার প্রতিফলন ঘটল ব্যালট বাক্সে।
কংগ্রেসের উচিৎ ছিল অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া। ১৯৮৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে মুসলমানরাও বিবাহবিচ্ছিনা স্ত্রীকে খোরপোষ দিতে বাধ্য। কিন্তু মুসলমান সমাজকে খুশি করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও পাত্তা দেননি।
সেই বছরেই কেন্দ্র মুসলমান মহিলা (বিচ্ছেদ সুরক্ষা) আইন পাস করল। এই আইনে বলা হল, বিবাহবিচ্ছিনা মুসলমান মহিলারা শুধুমাত্র বিচ্ছেদের পরের ৯০ দিনের জন্য খোরপোষ পাবে। এই আইন প্রণয়নের প্রতিবাদে আরিফ মহম্মদ খান মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেন। এক বয়স্কা বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা শাহ বানো অবিচারের শিকার হলেন। এত কিছুর পরেও রাজীব গান্ধীকে টলানো গেল না।
এক বয়স্কা বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলা শাহ বানো অবিচারের শিকার হলেন
এর ফলে দেশ জুড়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেখা গেল।
১৯৮৬ সালে আবার ক্ষিপ্ত হিন্দুদের মন জয় করবার চেষ্টা করলেন রাজীব গান্ধী। বাবরি মসজিদ-রামমন্দির সমস্যার সমাধান হিসেবে ওই ভূমিতে মন্দির শিলান্যাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু রাজীবরা যা ভেবেছিলেন তার উল্টো পরিণাম দেখা দিল। হিন্দু দল হিসেবে জাহির করতে কখনোই পিছপা হয়না বিজেপি। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ল।
অযোধ্যার উপর ভর করেই ৯০ সালে রথ যাত্রা বের করলেন এলকে আডবাণী। ১৯৯২ সালে ধ্বংস হল বাবরি মসজির এবং দেশ জুড়ে দাঙ্গা লাগল। সেই দাঙ্গার ছায়া আবার ২০০২ সালেও দেখা গেল।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তো কংগ্রেসের অজানা নয়। ১৯৮৪ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার সময় তো হাজারখানেক শিখকে খুন হতে হয়েছিল। কিন্তু রাজীব গান্ধী তাও আঁচ করতে পারেনি যে এর থেকেই ভবিষ্যতে ভারতে পদ্মফুল ফুটে উঠবে।
আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল।
অযোধ্যার উপর ভর করেই ৯০ সালে রথযাত্রা করলেন এলকে আডবাণী
কর্নাটকে আবার লিঙ্গায়তদের নিয়ে রাজনীতি শুরু করে দিলেন রাহুল গান্ধী। নিজেকেও হিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি মন্দির দর্শন শুরু করে দিলেন, মাথায় তিলক কেটে প্রচার করলেন এমনকি নির্বাচন শেষে কেদারনাথ দর্শনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিলেন। উনি বুঝতেও পারলেন না যে তাঁর এই ব্যবহার তাঁকে সাম্প্রদায়িক করে তুলল।
কাঠুয়া ধর্ষণ কাণ্ড দেখুন। কংগ্রেস এই নিয়ে খুব একটা শব্দ খরচ করেনি।
কংগ্রেস কেন প্রতিবাদ জানাল না? তারা শুধু মধ্যরাতের দিল্লিতে একটি মিছিল আয়োজন করল যেখানে কংগ্রেসের মহিলা কর্মী ও সাংবাদিকরা নির্যাতিত হলো।
জম্মু-কাশ্মীরের কংগ্রেস নেতৃত্ব রাজ্যের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের বিরাগভাজন হতে চাননি
উত্তরটা সহজ। জম্মু কাশ্মীরের কংগ্রেস নেতৃত্ব রাজ্যের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের বিরাগভাজন হতে চাননি।
কংগ্রেসের হিন্দুত্ব রাজনীতি শুধুমাত্র কর্নাটকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কাশ্মীরেও কংগ্রেস একই খেলা খেলে। কংগ্রেস বিজেপির তফাৎ একটাই। বিজেপি বলে করে, কংগ্রেস ঘোমটার আড়ালে করে। কংগ্রেসকে কিন্তু এই রাজনীতিতে মানায় না। উল্টে, দুর্বল দেখায়।
কার্ল মার্ক্স একবার বলেছিলেন কংগ্রেস ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছে, প্রথমটা দুঃখজনক আর দ্বিতীয়টা প্রহসন।
কংগ্রেসের এই ফলাফলের পরে শুধুমাত্র বিদ্বজ্জনেরা চোখের জল ফেলছে। যাঁদের বাস্তবের সঙ্গে পরিচিতি নেই। তাঁরা শুধু টুইট করতেই পছন্দ করেন।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে