জেএনইউ বিবাদ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চত্ত্বর থেকে রাজনীতিকে কী ভাবে দূরে সরিয়ে রাখা যায়?

ছাত্র রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিলে একদিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে

 |  5-minute read |   29-03-2019
  • Total Shares

ব্লগ লিখতে বসলে সাধারণত আমি ইন্টারনেটে প্রচুর ঘাঁটাঘাঁটি করি, আমার ল্যাপটপে সেভ করা ফাইলগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিই এবং গুগল স্কলারে গিয়ে আমি যে বিষয়ের উপর লিখছি সেই বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করে থাকি।

কিন্তু এই ইস্যুটি লিখতে বসে আমার কোনও গবেষণার প্রয়োজন হচ্ছে না। সত্যি বলতে, এই লেখাতে আমি আর কোনও বাইরের সূত্রেরও সাহায্য নেব না।

এর পিছনে অবশ্য একটি কারণ রয়েছে।

কারণ আমি নিজেই এই বিষয়টির প্রত্যক্ষদর্শী।

কলেজ নির্বাচনের সময়ে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজ কী ভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে তা আমার স্বচক্ষে দেখা। সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে এক দল পড়ুয়ারা কী ভাবে কলেজের অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধানদের ঘেরাও করে হেনস্থা ও অপমান করতে থাকে তাও আমার নিজের চোখে দেখা। তাদের দাবি না মানার জন্য পড়ুয়ারা কী ভাবে তাদের অধ্যাপকদের হেনস্থা করে তাও আমি নিজের চোখে দেখেছি।

এই ঘটনাগুলো আমার মনের খুব বাজে প্রভাব ফেলেছিল, তাই আমি আর সেই দিনগুলোর কথা মনে করতে চাইছিলাম না।

কিন্তু সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একটি টুইটে আমার মনের গভীরে থাকা সেই পুরোনো স্মৃতিগুলো আবার ফিরে আসছে।

আমার চোখের সামনে একটি দৃশ্য ভেসে উঠছে - একটি ঘরে একা একজন মহিলা বন্দি হয়ে রয়েছেন। তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগের মরিয়া চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁর স্বামী তখন নিজের কাজে ব্যস্ত। ক্ষুদ্ধ পড়ুয়ারা - সকলের বয়স কুড়ির ঘরে - তাঁর কর্মী আবাসনকে ঘিরে রেখেছে এবং উপাচার্যকে বেরিয়ে আসার জোরালো দাবি তুলে স্লোগান দিচ্ছে।

ছবিটা আজ আমি আবার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা কর্মীবৃন্দ ও অন্যান্য কর্মীদের স্ত্রীরা পিছনের দরজা দিয়ে তাঁর ঘরে প্রবেশ করে তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁকে এক দল ক্ষোভে ফেটে পড়া জনতার হাত থেকে উদ্ধার করতে হচ্ছে, যারা আদতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া।

এই ঘটনাটি অবশ্য প্রথম শ্রেণীর কোনও বামপন্থী নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি - যারা ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে সিদ্ধহস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা, যাঁদের কয়েকজন তখন জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করার মুখে, এই ঘটনাটি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। তাও এমন একটা সময়, যখন উপাচার্য জানালেন যে তিনি পড়ুয়াদের ক্ষমা করে দিচ্ছেন এবং এই ঘটনাটি নিয়ে তিনি পুলিশে অভিযোগ করতে যাবেন না।

মনে রাখবেন এখানে আমি একজন উপাচার্যের কথা বলছি, যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বেসর্বা। তাঁর সঙ্গেই যদি এইরূপ ব্যবহার করা হতে পারে তাহলে গোটা দেশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের কী অবস্থা হতে পারে, তা একবার ভেবে দেখুন।

দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মতো রাজ্যগুলোতে কর্মরত কোনও অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলবেন যে এ ধরনের ক্ষুদ্ধ পড়ুয়াদের লাঞ্ছনার মুখোমুখি হওয়া তাঁদের জীবনের দৈনন্দিন ঘটনা। অনেকে তো মনে করেন যে এই লাঞ্ছনার মুখোমুখি হওয়াটা তাঁদের কাজের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

অধিকাংশ অধ্যাপকের বয়স চল্লিশ কী পঞ্চাশের কোঠায়। সেই বয়সের আর পাঁচজনের মতো তাঁরাও হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়বেটিসের মতো রোগে ভোগেন। তাই এমন বহু অধ্যাপক রয়েছেন যাঁরা যে কলেজগুলো এই ধরনের সমস্যাসঙ্কুল সেই কলেজগুলোতে যোগ দিতে চান না।

তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁদের এই মনোভাবের কথা জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাঁরা বলবেন যে ছাত্র রাজনীতি শালীনতার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাই তাঁরা তাঁদের জীবন বিপন্ন করে কাজে যোগ দিতে চাননা।

তাঁরা কিন্তু ভুল কিছুই বলেন না।

কিছু ক্যাম্পাসে যে ভাবে আন্দোলন করা হয় তা কোনও সভ্য জগতে হওয়ার কথা নয়।

আন্দোলন কী রূপ হতে পারে তা একবার আন্দাজ করে দেখুন - অধ্যাপকদের অফিস ঘেরাও করে দাবি না মানা অবধি তাঁকে সেখানে ঘেরাও করে রাখা, অধ্যাপককে বাড়ি এমনকি শৌচালয়েও যাওয়ার 'অনুমতি' না দেওয়া, কাজে যোগ দিতে যাওয়ার সময়ে অধ্যাপককে উদ্দেশ্য করে স্লোগান দেওয়া, অধ্যাপকের উদ্দেশ্য অশালীন মন্তব্য করে গোটা কলেজ চত্ত্বর জুড়ে পোস্টার লেপে দেওয়া, ক্লাস চলার সময়ে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলে ক্লাস বিঘ্নিত করা এবং কর্মী আবাসন ঘেরাও করে অধ্যাপকের পরিবারকেও ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখা।

এগুলো কি কোনও আন্দোলনের অঙ্গ হতে পারে? কলেজ চত্বরে পড়ুয়াদের এই রূপ আচরণ কি শোভা পায়?

ভারতে এই আচরণগুলো যেন নিয়মে পরিণত হয়ে উঠেছে এবং আমরাও এই আচরণগুলোকে দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হিসেবে ধরে নিয়েছি। বিষয়টি এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে যদি কোনও বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে কলেজ পড়ুয়ারা কোনও অধ্যক্ষকে ঘেরাও করে তাঁকে লাঞ্চিত করছে আমরা সেই আন্দোলনকে বাহবা দিয়ে থাকি।

সত্যিই কী পড়ুয়াদের এই ভাবে প্রতিবাদ করাটা শোভা পায়?

কারুর কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর নেই - কেউই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চান না।

কিন্তু আপনি যদি কলেজে হিংসা ছড়াতে দেন তাহলে সেই হিংসা কিন্তু ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে।

মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আন্দোলনরত পড়ুয়ারা হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

প্রতিবাদরত পড়ুয়াদের হিংসাত্মক হয়ে ওঠার ঘটনা কিন্তু বিরল নয়। কিছু কলেজ চত্ত্বরে এই ঘটনাগুলো তো রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে উঠলে একদিন কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। চোটাঘাত লাগতেই পারে। এই ধরণের ঘটনা থেকে মৃত্যুও পর্যন্ত হতে পারে। পড়ুয়াদের হাতে আক্রান্ত হয়ে শিক্ষক শিক্ষিকাদের আহত হওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষক শিক্ষিকার মৃত্যুও পর্যন্ত হয়েছে। পড়ুয়াদের প্রতিবাদ হিংসাত্মক হয়ে ওঠার পর অধ্যাপক, অধ্যক্ষ কিংবা বিভাগীয় প্রধানদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নজিরও প্রচুর রয়েছে। এই খবরগুলো সংবাদপত্রের পাতায় কিন্তু খুব একটা দেখা যায় না।

body_032919064125.jpgছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করা হলে তা নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাবে [ছবি: রয়টার্স]

এই ভাবেই কি আমরা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালাতে চাই? এই ধরণের ছাত্র নেতাদেরকেই কি আমরা জাতীয় রাজনীতিতে চাই?

এই প্রশ্নটি আমি বর্ষীয়ান নেতা নেত্রীদের উদ্দেশ্যে করতে চাই যাঁরা একদিন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

কমিটি রিপোর্ট, সুপারিশ কিংবা আদালতের নির্দেশ নিয়ে খামোকা গলাবাজি করে লাভ নেই। এই ধরণের প্রচুর রিপোর্ট বা নির্দেশ রয়েছে যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির বাইরে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো শুধুমাত্র কাগজেকলমেই রয়ে গিয়েছে।

শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেও ছাত্র রাজনীতির খবর বেশি শোনা যায় কারণ প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

রাজনৈতিক দলগুলো কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোর থেকে রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাজি আছে?

বর্তমানে, এই সমস্যাবহুল পরিস্থিতি থেকে সুরাহা পাওয়ার এই একটিমাত্রই সমাধান রয়েছে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000
Comment