ব্রিটিশদের দেশদ্রোহিতা আইন এখন কতটা প্রয়োজনীয়
রাষ্ট্রদ্রোহিতা নিয়ে কী বলেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ?
- Total Shares
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তাঁরা মাওবাদী সমর্থক এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও নাকি খুনের ছক কষেছিলেন তাঁরা! যদিও নিম্ন ও উচ্চ আদালত পুলিশের এই পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেনি।
সর্বোচ্চ আদালতের মতে, গণতন্ত্রে বিরোধী মত নিরাপত্তা কপাটিকা বা সেফটি ভালভের কাজ করে। এর অন্যথা হলে বিস্ফোরণ ঘটে। আমরা যদি এই রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক আইনের উৎস খুঁজে দেখি তা হলে দেখা যাবে ভারতে ইংরেজশাসনে এই আইন প্রথম চালু হয় মূলত ভারতীয়দের কণ্ঠরোধ করার জন্য।
১৮৯১ সালের ৭ অগস্ট বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারতে প্রথম এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরে আরও অনেকে যেমন লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক তিন তিনবার (১৮৯৭, ১৯০৯ ও ১৯১৬) এই আইনের শিকার হন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সমর্থনে এবং মজফফরপুরে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর সমর্থনে তাঁর পত্রিকায় লেখার জন্য তিলকের ৬ মাস কারাদণ্ড হয়। তাঁর পক্ষে ওকালতি করেন মহম্মদ আলি জিন্না। কিন্তু তিলক অব্যাহতি পাননি।
বালগঙ্গাধর তিলক (ইন্ডিয়া টুডে)
হরিজন পত্রিকায় সরকারবিরেধী নিবন্ধ লেখার জন্য মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধের ১২৪ (ক) ধারা প্রয়োগ করা হয়। সেই সময় গান্ধীজি মন্তব্য করেছিলেন it’s a rape on law অর্থাৎ এই ধারার মধ্য দিয়ে আইনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এমনকি ১৯২৪ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি জনমত গড়ে তোলার কর্মসূচি নেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীন ভারতে সাবেকি গান্ধীবাদী ও নয়া গান্ধীবাদীরা এই আইনকে বর্জন করেননি। অথচ যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথ-ভুক্ত অনেকগুলি দেশ যেমন নিউজিল্যান্ড, কিনিয়া, উগান্ডা এই কালাকানুন প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আইন মূলত সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমন করার জন্য রাখা হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের দেশের আইন কমিশন এই আইনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সংসদে এবং দেশের বিভিন্ন মহলে এই আইন প্রত্যাহারের জন্য জোরালো দাবি উঠেছে কিন্তু কোনও শাসকদল তাতে কর্ণপাত করেনি। প্রশ্ন উঠতে পারে এই আইন প্রত্যাহার করে নিলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ রোধ করা কী ভাবে সম্ভব। এই প্রশ্ন অমূলক এই কারণে যে, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ তথা জঙ্গি দমনের জন্য ভারতে অন্য আইন রয়েছে যে আইনে রাষ্ট্রের হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
ফৌজদারি আইনের ১২৪ (ক) ধারা (যেখানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে) না থাকলেও সন্ত্রাসবাদ দমন আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যেতেই পারে এবং নেওয়া হচ্ছেও।
পরিশেষে যে প্রশ্নটি বিভিন্ন মহলে আলোড়ন ফেলেছে তা হল মাওবাদী সমর্থক হওয়া মানেই কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র? মাওবাদ বা মার্ক্সবাদ বা গান্ধীবাদকে যদি আদর্শ হিসাবে ধরা হয় তা হলে সেই আদর্শে কেউ বিশ্বাসী হতেই পারেন। সুতরাং কেউ এমন কোনও ‘বাদ’-এ বিশ্বাসী হলেই তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন এমন অভিযোগ হাস্যকর। যদি হিংসার বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি লিপ্ত হন তা হলে একটা মানে বোঝা যায়।
গ্রেপ্তারির পরে ভারাভারা রাও (ফাইল চিত্র)
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ব্রিজক্রফ্টের এজলাসে শ্রীঅরবিন্দের বিরুদ্ধে যখন একই ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল তখন তাঁর আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাশ সমস্ত অভিযোগ খারিজ করে দেখিয়েছিলেন, অরবিন্দ ঘোষের কাছ থেকে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র তো দূরের কথা, স্ত্রীকে লেখা কয়েকটি ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ছাড়া পুলিশ বিশেষ কিছু উদ্ধার করতে পারেনি। অথছ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছিল।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ
চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর অসামান্য সওয়ালে বলেছিলেন, “আপনাদের চোখে যিনি আজ রাষ্ট্রদ্রোহী আগামী দিনে তাঁকে দেশের জনগণ দেশপ্রেমের কবি হিসাবে গণ্য করবেন।”
সম্প্রতি যে ভাবে দলিত-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মাওবাদী-সমর্থক রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হল, তা প্রকারান্তরে অঘোষিত জরুরি অবস্থা ছাড়া অন্যকিছু নয়।