ইন্দিরাই ভারত, তিনি আরও বেশি সম্মানের অধিকারী

জর্জ বুশ বা বিল ক্লিন্টনের ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ করা হয় না

 |  6-minute read |   20-11-2017
  • Total Shares

তখন আমার বয়স বছর দশেক। এক কনকনে শীতের সকালে বাবা আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিলেন। সেদিন গণেশ খিন্ড রোড ধরে একটি হুড খোলা গাড়ি পুনের রাজভবনে ঢুকবে আর গাড়িতে থাকবেন দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী  ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং। আমি এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে শীতের পরোয়া না করে তক্ষুণি বিছানা থেকে উঠে তাড়াতাড়ি স্কুল বাস ধরবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। আমরা বন্ধুরা ইন্দিরা গান্ধীকে দেখার সুযোগ থেকে কোনও ভাবেই বঞ্চিত থাকতে চাইনি।

এই উত্তেজনার পিছনে অবশ্য অন্য একটা কারণ ছিল। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই দেশের পরিবেশ ভয়াবহ ছিল। সন্ধ্যার সময় সাইরেনের আওয়াজ শুনতে শুনতে অন্ধকার ঘরে বসে জীবনটা এক ঘেঁয়ে হয়ে উঠেছিল। রাতের আকাশ থেকে যুদ্ধবিমানের শব্দ কান ঝালাপালা করে দিত। আসলে সেই সময় ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছে। অবশেষে যুদ্ধ শেষ হল। চির-প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে পরাজিত করে শেষ হাসিটা হাসল ভারত। পূর্ব পাকিস্তানকেও স্বাধীন করা সম্ভব হল।

তখন আমাদের হৃদয়ে দেশাত্মবোধ। দেশের জন্য গর্বে বুক ফুলে উঠছে। আর এমন পরিবেশ যাঁর জন্য তৈরি হয়েছে সেই ইন্দিরা গান্ধীই স্বয়ং আজ পুনের রাস্তায়। আমাদের মধ্যে বাড়তি উত্তেজনা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।

বুঝতেই পারছেন, ১৯৭১ সালের কথা।

body_112017080546.jpg

সেই সময় টেলিভিশন আসেনি। আকাশবাণীর একছত্র আধিপত্য। তাই চাইলেই ইন্দিরা গান্ধীকে দেখা সম্ভব নয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সেদিন ইন্দিরা গান্ধীকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। মনে হল বুঝি স্বপ্ন দেখছি। দু'দিকে সারি দিয়ে দাঁড়ানো জনতার উদ্দেশে হাত নাড়তে নাড়তে যাচ্ছিলেন তিনি, কখনও আবার দুটি হাত জোড় করে নমস্কার জানাচ্ছিলেন। প্রত্যুত্তরে, আমরাও হাত নাড়ালাম। ইন্দিরা গান্ধীর নামে জয়ধ্বনি দিলাম।

গাড়ি চলে যেতেই একটা মজার ব্যাপার ঘটল। উপস্থিত প্রত্যেকেরই মনে হল যে ইন্দিরা গান্ধী শুধুমাত্র তাঁর দিকেক তাকিয়েই হেসেছেন। শুধুমাত্র তাঁর উদ্দেশেই হাত নেড়েছেন। আমারও তাই ধারণা হয়েছিল এবং এই ধারণাটা আজও আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।

এর তেরো বছর পরে আমি জামসেদপুরে এক্সএলআরআই-তে এমবিএ পড়ছি। একদিন সকালে স্টাফ কোয়ার্টার্স থেকে একজন ছুটে এসে খবর দিল, "ইন্দিরা গান্ধী গুলিতে নিহত হয়েছেন।" খবরটা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। আসলে ওঁর মৃত্যুর খবর বা ইন্দিরা ছাড়া ভারত আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। আমার ধারণা ছিল ভারতের মত ইন্দিরা গান্ধীও শাশ্বত।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা আকাশবাণী সরকারি ভাবে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর খবর ঘোষণা করল। তার কিছুক্ষণ বাদে কংগ্রেসের গোঁড়া সমর্থক, আমার মায়ের ফোন পেলাম। উল্টোদিকে মা অঝোরে কেঁদে চলেছেন যেন কোনও নিকট আত্মীয়ের জীবনাবসান ঘটেছে। মাকে আর কী বলব, গোটা দেশ জুড়েই তো একই অবস্থা। মনে হচ্ছিল ভারতের একটি অধ্যায় যেন আজ ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।

দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াণের পর ৩৩ বছর কেটে গেছে। কিন্তু এখনও ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিটেফোঁটাও কমেনি।

সমালোচনায় জর্জরিত

ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে ১৯৭৫ থেকে ৭৭, সংবাদমাধ্যমকে সেন্সর করে দেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই, দেশের সংবাদমাধ্যম জরুরি অবস্থার দিনগুলোর কথা তুলে আজীবন ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করে এসেছে। অনেকেই আবার তার অর্থনৈতিক নীতিগুলো নিয়ে সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তারপর আবার কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে। আমার ব্যক্তিগত মত হল, এসব কিছু মাথায় রেখেও ইন্দিরা গান্ধী কিন্তু আরও বেশি সম্মান পাওয়ার অধিকারী।

জওহরলাল ও কমলা নেহরুর একমাত্র সন্তান ছিলেন ইন্দিরা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্ধকার সময়ে এবং পরবর্তী কালে দেশভাগের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তাঁর বেড়ে ওঠা। অল্প বয়সেই মাকে হারিয়েছিলেন তিনি, যা তাঁর জীবনের একাকিত্বের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার তো মনে হয় ইন্দিরা ও জওহরলালের সম্পর্ক এমন একটি পিতাপুত্রীর সম্পর্ক, যা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন ছিল। এর পর ইন্দিরা তাঁর স্বামী ফিরোজ গান্ধী ও বাবা জওহরলালকে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে জোর ধাক্কা খেয়েছিলেন। নিকট আত্মীয়দের হারানো এখানেই শেষ হয়নি ইন্দিরার। পুত্র সঞ্জয় গান্ধীও অল্প বয়েসে মারা গেলেন।

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু আর মোরারজি দেশাইয়ের প্রধামন্ত্রী হয়ে ওঠার বাসনা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিটাই বদলে দিয়েছিল। এর ফলেই ভারতীয় রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধীর মতো একটি মস্তিষ্ক উদয় হয়েছিল। ৭১ এর যুদ্ধ দিয়ে পথ চলা শুরু। বাকিটা তো ইতিহাস।

body1_112017080601.jpg

ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের সব চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা খুব সম্ভবত এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়। আদালত তাঁকে নির্বাচনে অন্যায় পদ্ধতি অবলম্বনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিল।পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় খারিজ করে দেয়। আজকের দিনে নির্বাচনী প্রচারে যে ভাষার ব্যবহার হয়, যে ভাবে কালোটাকা ওড়ে এবং যে ভাবে ছাপ্পা ভোট দেওয়া হয় তার তুলনায় ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তো নস্যি।

বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ১৯৭১ সালে বিরোধীদের একেবারে পর্যদুস্ত করে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। ইন্দিরা গান্ধী দেশের যে কোনও নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে দাঁড়ালেই হাসতে হাসতে জিততেন। তিনি তাঁর পরিবারের দুর্গ হিসেবে চিহ্নিত রায়বরেলী লোকসভা আসন থেকে লড়লেন এবং বিপুল ব্যবধানে জয় পেলেন। কিন্তু আদালতে সেই নির্বাচনের ফলাফল খারিজ হয়ে গেল, পুরোটাই ছিল বিরোধী প্রার্থী রাজ নারায়ণের কারসাজি।

নির্বাচনে মাইক্রোফোনের ব্যবহার, উঁচু মঞ্চ থেকে বক্তৃতা কিংবা তাঁর নির্বাচনী প্রতিনিধি (এজেন্ট) যশপাল কাপুরের চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা নয়, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে এ সব হাতিয়ার করে এই বিষয়গুলো নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল বিরোধীরা। পরবর্তী কালে অবশ্য আদালত সব অভিযোগই খারিজ করে দেয়।

এর পরে বিরোধীরা ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগ দাবি করেন এবং দাবি আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ইন্দিরা গান্ধীও জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হন। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন সামাজিক পরিবর্তনের জন্যে নয়, শুধুমাত্র তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে।

জরুরি অবস্থা

আমার মনে হয়ে সেই সময় জরুরি অবস্থা নিয়ে অহেতুক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছিল। বরং ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী একার সিদ্ধান্তে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করার যে সাহসিক দেখিয়েছিলেন তা নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হওয়ার কথা। জরুরি অবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে সুখের নয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সেই সময় অনেক বিদ্বজন, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধ ও আমজনতার একাংশ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, জরুরি অবস্থার সময় দেশ অনেক বেশি সুসংহত ছিল। এর ঠিক তিন বছরের মধ্যে আবার নির্বাচনে জিতে সরকার গড়েন ইন্দিরা। তাঁর পূর্ণ আস্থা দেখিয়েছিল ভারতের জনতা।

পরিবারতন্ত্র নিয়ে সমালোচনা প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। পণ্ডিত নেহরু যদি তাঁর কন্যাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন তার মানে সেটা কি পরিবারতন্ত্র হয়ে গেল? এই বিজেপিকে দেখুন, ওদেরও প্রচুর নেতানেত্রী বংশ পরম্পরায় রাজনীতি করছেন। এদের মধ্যে আবার দুজন তো গান্ধী পরিবারের।  বুশ বা ক্লিনটন পরিবার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যম তো খুব বেশি শব্দ খরচ করে না! হিলারি ক্লিনটনের যোগ্যতা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, তাঁর স্বামীকে নিয়ে নয়। বুঝতে হবে নির্বাচনে জিতে আসা প্রার্থীদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে গণতন্ত্রে জনগণের পছন্দকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা।

ইন্দিরা গান্ধীও প্রথমে সঞ্জয়কে বেছেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীকে। কারণ এঁদের তিনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন। সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর মানেকা গান্ধী যে ভাবে জনসমক্ষে ইন্দিরার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তারপর এটাই স্বাভাবিক। ভারতীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসটাই আসল। ইন্দিরা গান্ধীরও বিশ্বাসভাজন লোকেদের উপর আস্থা রাখার অধিকার আছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই দশকের মধ্যে যখন ভারতকে তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে গণ্য করা হত এবং চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঠান্ডা লড়াই লেগে থাকত তখন যিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হন না কেন তাঁর পক্ষে দু-একটা ভুল করে ফেলা স্বাভাবিক ছিল। ইন্দিরা গান্ধীও কিছু ভুল করে ফেলেছিলেন। সেই ভুলগুলোর অন্যতম পঞ্জাবে অচলাবস্থা। যার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের জীবন দিতে হল।

body2_112017080617.jpg

দৃঢ়তা ছিল লৌহকঠিন 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্দিরা গান্ধী কে লৌহমানবী বলে আখ্যা দিয়েছিল। এটা সত্যি যে ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্র বড়ই জটিল ছিল। সেটা হয়তো তা একাকিত্ব থেকে এসেছে। কিন্তু তা বলে তার দেশাত্মবোধ কিংবা কাজের প্রতি নিষ্ঠা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তার ৬৭তম জন্মদিনের ১৯ দিন দিন আগে তিনি ভয় পেতে শুরু করেছিলেন। ওড়িশায় একটি জনসভায় তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা, যা শেষ পর্যন্ত সত্যি হল।

আমি বলতে পারব না সমগ্র ভারতই ইন্দিরা কিনা। কিন্তু ইন্দিরা নিঃসন্দেহে ভারত।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANJAY JHA SANJAY JHA @jhasanjay

National Spokesperson of the Indian National Congress party. Co-author, The Superstar Syndrome.

Comment