ভারত কি এখন কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে?
রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে জোট বাঁধতে গিয়ে মার্কিন একঘরে নীতি-প্রিয় যুক্তরাষ্ট্রের রোষে পড়ছে?
- Total Shares
চুক্তি হয়ে গিয়েছে, এখন দেখতে হবে এর পরে কী হতে চলেছে। ভারত যখন রাশিয়ার থেকে এস৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে যাচ্ছিল তখনই ভারত ভালোভাবে জানত যে এর সম্ভাব্য ফল কী হতে পারে—এর ফলে মার্কিং কংগ্রেসে পাস হওয়া কাউন্টারিং অ্যামেরিকাজ অ্যাডভার্সারিজ থ্রু স্যাংকশনস অ্যাক্ট (সিএএটিএসএ)-এর কোপে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। যখন এ নিয়ে সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কার কথা নিয়ে ভারত দুশ্চিন্তা করছে – অর্থাৎ সিএএটিএসএ-র জেরে ভারতের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে তখন আশা বলতে ছিল, কিছুদিন ধরে দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক যে ভাবে পরিস্ফূট হচ্ছে তাতে ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো ভারতকে ছাড় দেবে।
ভারসাম্য রক্ষা: দু’পক্ষের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রেখে চলছে ভারত (ছবি: রয়টার্স)
কিন্তু কে নিশ্চিত করে বলতে পারে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এটাই করবেন? যতই হোক, তিনি আমেরিকার জোটে থাকা ইউরোপীয় দেশগুলিকে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করতে পারেন, তিনি চিন রাশিয়া ও ইরানকে এক হাত নিতে পারেন, বহু বছর ধরে চলা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে ইতি টানতে পারেন, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভারতের কল্পনাপ্রসূত ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশায়ন’কে বাস্তবে জুয়া ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। বিষয়টি স্প্ট হয়ে গিয়েছে যখন ২+২ বৈঠকের ফাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিকারিকদের এস৪০০ চুক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা জানান যে ট্রাম্প যে কী করবেন সে ব্যাপারে তাঁদের কোনও ধারনাই নেই!
ওঁরা জানেন কারা অ্যাজেন্ডা স্থির করছেন (ছবি: রয়টার্স)
ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাঠামোকে যখন আরও পোক্ত করতে এস৪০০ কেনার পক্ষে প্রচুর সওয়াল করা হচ্ছে এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ফাঁকফোকর মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে তখন অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্ট কোনও কিছুকে ভিত্তি করে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর কোনও অর্থই হয় না। হতে পারে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য দেওয়ার জন্য আমেরিকা যে ভারতের উপরে অল্প দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে হয় সেই বিষয়টিকে লঘু করে দেখা হয়েছে অথবা বিষয়টিকে তেমন ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ঘটনা হল, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে রাশিয়ার উপরে ভারতের দীর্ঘদিন যাবৎ নির্ভরশীল হয়ে থাকা এখনও একই ভাবে রয়ে গিয়েছে, আর এ ক্ষেত্রে চিরকালই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের যুক্তি ও ভাবনা উপেক্ষা করে আসা হয়েছে।
এটাই কি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নাকি ভারত আরও বেশি পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়ছে (ছবি: পিটিআই)
এটাকে অন্য ভাবে দেখানোর জন্য কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নিরিখে ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রুশ সরবরাহকে নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখা হচ্ছে।
অযৌক্তিক কথাবর্তা বন্ধ করে বলা যায় যে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন যে একটা শ্লোগান ছাড়া আর কিছু নয় তা আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, সহজ কথায়, ভারতের মাতো মাঝারি মানের শক্তিকে অস্ত্র সংক্রান্ত প্রযুক্তি, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সমর্থন, প্রযুক্তি ও বাজারের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিগুলির উপরে নির্ভর করে থাকতে হবে।
তবে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলিরও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
একটা বিষয় বলতেই হবে যে নীতিনির্ধারণের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন হল নিজেকেই নিজে বোকা বানানো এবং একই সঙ্গে গণমাধ্যমের থেকে বাহবা কুড়নো। বহু নীতি ও আদর্শকে অনেক সময়ই বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয় না বা তা ঠিকমতো বোঝানোও যায় না। নীতিনির্র রাজনীতি নয়, বাস্তবধর্মী রাজনীতি হল এমন একটা জিনিস যে একবার কোনও নীতি বা আদর্শের কথা জনসমক্ষে বলে দেওয়ার পরে – বর্তমানে যেমন কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন – দেশের অবস্থান যেন এমন হয় যে তা নমনীয় দেখায় এবং লোকের মনে এ কথা গেঁথে যায় যে যা কিছু হচ্ছে তা তাঁদের জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখেই হচ্ছে।
কোনও নীতিকে দিশাহীন বলে ঘোষণা করা অত্যন্ত নির্বোধের পরিচায়ক এবং তা দেশকে প্রতিশ্রুতির ফাঁদে আটকে দেবে।
অন্য ভাবে বলা যায় যে, তারা একমাত্র রাষ্ট্রপুঞ্জের আনা নিষেধাজ্ঞাকেই পরোয়া করে, একটা বা দুটো দেশের নিজের মতো করে চাপিয়ে দেওয়া কোনও নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্ব দেয় না – তবে এই ধরনের ঘোষণা করে ফেললেই বাস্তবতাকে এড়ানো যাবে না, এর জন্য বিপুল অঙ্কেরল বোঝা বহন করতে হবে যে মূল্য চোকানো মোটেই খুব একটা ভালো নয়।
সিএএটিএসএ-র বিষয়টি থাকা সত্ত্বেও ভারত যখন এস৪০০ নিয়ে চুক্তি করার ব্যাপারে এগিয়েছে তখন স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়টি হিসাব কষেই ভারত এগিয়েছে। কৌশলগত ভাবে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন গভীরতার দিকে তাই এ ক্ষেত্রে ভারত ছাড় পেতে পারে বলে হয়তো মনে করার কারণ রয়েছে। এমনটা যদি না করে তা হলে এই দুই দেশের সম্পর্ক পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। ভারত যে তিনটি মৌলিক চুক্তি করেছে তার মধ্যে এলইএমওএ এবং সিওএমসিএএসএ নামে দুটি চুক্তি নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে, বাতিলও হতে পারে। অন্য বেশ কয়েকটি দেশের যেমন বিশেষ কয়েকটি পন্থা রয়েছে সিএএটিএসএ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য ভারতের তা নেই বলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এস৪০০ নেওয়া হচ্ছে ভারতীয় বায়ুসেনার জন্য। যদি ভারতীয় বায়ুসেনা বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মধ্যে কোনও একটি ক্ষেত্র নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে তা হলে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা চরম পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
জটিল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও এস৪০০ কেনার সিদ্ধান্তের মতো ঝুঁকি নেওয়ায় ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার মতো গা ছামছমে সিদ্ধান্ত নেওয়া একেবারেই অপ্রয়োজনীয় – বলা যেতে পারে যে এই চুক্তি খুবই কম প্রয়োজনীয় ছিল, এমনকী তখন এমন খবরও খুব শোনা যাচ্ছিল যে ট্রাম্পকে খুশি করার জন্য ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও বড় অঙ্কের কোনও চুক্তি সম্পাদন করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে। বস্তুত ভারত যদি তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সমঝোতাই না করবে, তা হলে আমেরিকাকে তোষণ না করে ট্রাম্প প্রশাসন কী ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারত।
এখন কি আরও বেশি অর্থের অস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে কিনতে হবে? (ছবি: রয়টার্স)
হয়তো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হাততালি কুড়ানোই লক্ষ্য, দেশের মানুষের কাছে এ কথা প্রমাণ করা যাবে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও চাপের কাছেই তারা নতি স্বীকার করে না এবং দেশের যাতে মঙ্গল হবে বলে মনে করে ভারত সেই মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। তবে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের ঢক্কানিনাদ না করেও তা করা যেতে পারে যেটা বাস্তবে কার্যকর হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে ভারত ইরানের থেকেই তেল কিনে যাবে, এ ব্যাপারে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে পাত্তা দেবে না। এস৪০০ চুক্তি চূড়ান্ত করার পরেই এ কথা বলার অর্থ হল আগুনে ঘৃতাহুতি দেওায়া।
এস ৪০০ চুক্তির পরে ইরানের থেকে ভারতের জ্বালানি তেল কেনা ছিল আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার মতো (ছবি: রয়টার্স)
এটা আচমকা ঘটে যাওয়া কোনও কূটনীতি নয়, বরং বাস্তব বিচার করে বলা যায় যে এর একটি অর্থনাতিক দিকও রয়েছে।
সত্যিটা হল যে মনে করা হচ্ছে ইরানের থেকে তেল কেনার ব্যাপারে ভারত কোনও ছাড় পাবে না। যদি কোনও ছাড়ই না পাওয়া যাবে – কয়েকজন বিশ্লেষক আছেন যাঁরা মনে করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো রাশিয়ার থেকে এস৪০০ কেনার ব্যাপারটিতে ভারতকে ছাড় দিতে পারে তবে ইরান থেকে তেল কেনার ব্যাপারে সেই ছাড় দেবে না – সে ক্ষেত্রে ভারতের মনমতো হোক বা না হোক, ইরান থেকে তেল কিনতে পারবে না ভারত। তখন যদি কোনও ভারতীয় সংস্থা আমেরিকাকে যথেষ্ট গুরুত্বও দেয় সে ক্ষেত্রেও পরিবহণ, পরিকাঠামো, আর্থিক ও অন্য সমস্যার জেরে তেল কেনা মুশকিল হয়ে যাবে যে সমস্যা ইরানের থেকে তেল কেনার ক্ষেত্রে হয় না।
স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে, কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন দেখাতে গিয়ে ভারত তার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে যে ভাবে নাড়িতে দিতে চলেছে তার কোনও অর্থ হয় না।
ভারত যখন মুখে বহুমেরুকরণের বুলি আওড়াচ্ছে এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের মতো কূটনৈতিক ভাবে বিশাল বিশাল কথা বলছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের মতো বিষয়গুলির সঙ্গে রাশিয়া ও অন্য দেশের ক্ষেত্রে সেই একই বিষয়গুলোর তুল্যমূল্য বিবেচনা করা দরকার।
তবে এ কথাও ঠিক যে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে তা বিচার করে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া যায় না।
আগে কী হয়েছে সেই ভাবনার উপরে নির্ভর না করে বাস্তবতা বিচার করেই ভারতের বিদেশনীতি নির্ধারণ করা উচিত।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে