২৬/১১ হামলার পর পুলওয়ামা জঙ্গি হামলা ভারতের সর্ববৃহৎ গোয়েন্দা ব্যর্থতা
পুলওয়ামার শহিদদের জন্য বদলা নিতেই হবে কিন্তু অঙ্ক কষে, যাতে জঙ্গিরা জোর ধাক্কা খায়
- Total Shares
অধিকাংশ ভারতীয়র রাতের ঘুম উবে গেছে।
গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ঘটে যাওয়া আত্মঘাতী হামলার ছবিগুলো কিছুতেই স্মৃতি থেকে সরতে চাইছে না। এই ঘটনায় - যা ঠান্ডা মাথায় করা হয়েছিল এবং গত দু'দশকে সশস্ত্র বাহিনীর উপর ঘটে যাওয়া হামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বস্ত বলে মনে করা হচ্ছে - একজন আত্মঘাতী হামলাকারী সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্সের (সিআরপিরেফ) দুটি কনভয়ের মাঝে ঢুকে পড়ে। বিস্ফোরণের পরে আধাসামরিক বাহিনীর বাসটি একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। চল্লিশ জনেরও বেশি সিআরপিএফ জওয়ান এই ঘটনায় প্রাণ হারান।
ঘটনার পরে এক ক্রুদ্ধ সিআরপিএফ অফিসারের বক্তব্য, "৪৪টির মধ্যে ৩৯টি দেহ যে ভাবে দলা পাকিয়ে গিয়েছে তাতে সেই দেহগুলো আর শনাক্তই করা যাচ্ছে না। তীব্র বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। দেহগুলোকে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।" এই সিআরপিএফ আধিকারিক একজন চিকিৎসক যিনি একটি সাহসিকতা পুরস্কার নেওয়ার জন্যে সম্প্রতি দিল্লি গিয়েছিলেন। এক সন্ত্রাসবাদী হামলায় আহত সিআরপিএফ জওয়ানদের সেবা শুশ্রূষার জন্য তিনি এই এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আর আজ এই ঘটনায় আহত জওয়ানদের চিকিৎসা করার সময়ে তিনি শুধুমাত্র কোনও 'অলৌকিক' ঘটনার প্রতীক্ষা করে রয়েছেন।
পুলওয়ামার যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে সেই জায়গাটির বর্তমান অবস্থা বেশ শোচনীয়।
হামলায় সিআরপিএফের বাসটি চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]
পুড়ে যাওয়া গাড়িটির ধ্বংসাবশেষের পাশে নিহত জওয়ানদের দেশের অংশ, জুতো ও জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। জায়গাটির ছবি গত দেশ জুড়ে হোয়াটস অ্যাপে ভাইরাল হয়েছে আর ক্রুদ্ধ জনগণ এই ছবিগুলো শেয়ার করে ঘটনাটির তিব্র নিন্দা করে চলেছে। লোকে এতটাই ক্রুদ্ধ যে শুধুমাত্র জম্মুতে নয়, লখনউ, দিল্লি ও দেশের অন্যান্য শহরে এই ঘটনার প্রতিবাদে লোকে পথে নেমেছেন।
ঘটনার কয়েক মুহূর্ত পরেই পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জৈশ-এ-মহম্মদ এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। জঙ্গি সংগঠনটির তরফ থেকে একটি বিবৃতি পেশ করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করা হচ্ছে যেখানে আত্মঘাতী হামলাকারীর ছবি দেখা যাচ্ছে। এই হামলাকারীর বাড়ি দক্ষিণ কাশ্মীরে এবং সে একাদশ শ্রেণী অবধি পড়াশোনা করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, বছর কুড়ির আদিল আহমেদ ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জঙ্গি সংগঠনটিতে যোগ দেয় এবং সংগঠনের আফগান কমান্ডারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। এই চক্রান্ত ফলপ্রসূ করার জন্য সম্প্রতি এই আফগান কমান্ডারকে কাশ্মীরে পাঠানো হয়েছিল।
কিন্তু এই চক্রান্তের চক্রী যে ব্যক্তি সে আবার পাকিস্তান নিবাসী এক 'মোস্ট ওয়ান্টেড' সন্ত্রাসবাদীর ভাইপো। শুধু পাকিস্তান নয়, চিনও এই 'মোস্ট ওয়ান্টেড' সন্ত্রাসবাদীকে আগাগোড়া সমর্থন করে আসছে। এর আগে বিশ্বের ভয়ঙ্করতম জঙ্গিদের তালিকায় তার নাম তুলতে গিয়ে চিনের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ভারতকে।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে জৈশ নেতা তথা একজন 'মোস্ট ওয়ান্টেড' সন্ত্রাসবাদী মৌলানা মাসুদ আজহারের এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের একটি ভিডিয়ো পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর থেকে পাওয়া গিয়েছিল।
এই অডিয়োটি সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছিল যেখানে মাসুদ জানিয়েছিলেন যে শ্রীনগর বিমানবন্দরের ঠিক বাইরে অবস্থিত বিএসএফের একটি শিবিরে হামলা করার চক্রান্ত করেছিলেন তিনি। যদিও সেই হামলার ছক নিরাপত্তারক্ষীদের তৎপরতায় আটকে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই ভিডিয়োটিতে চিরাচরিত ভঙ্গিমায় মাসুদ আজহারকে ভারত বিরোধী কথা বলতে শুনা গিয়েছে। কোনও এক অজানা সমাবেশ তিনি তরুণ সম্প্রদায়কে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। এই ভিডিয়োয় তিনি দাবি করেছেন যে প্রচুর সংখ্যক লোক আত্মঘাতী হামলায় অংশগ্রহণ করবে বলে তাঁর কাছে আবেদন করেছে।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গোয়েন্দারা মাসুদ আজহারের ভাই রউফ আসগরের একটি ২০ মিনিট ব্যাপী ভিডিয়ো উদ্ধার করেছিল। এই ভিডিয়োটিতেও আসগর একদল ফিদায়েঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তারা যেন সীমান্ত টপকে ভারতে প্রবেশ করে আত্মঘাতী হামলা করে। এই আসগর আবার পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জৈশের দায়িত্বে রয়েছে। এই ভিডিয়োটিতে আসগার জানিয়েছিলেন, মৌলানা মাসুদ আজহার ও সৈয়দ সালাউদ্দিন এই ফিদায়েঁদের সঙ্গে দেখা করতে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে গিয়েছেন।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছিলেন, ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ঝিলম উপত্যকায় মাসুদ আজহার ও সৈয়দ সালাউদ্দিন ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিলের কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন। সেই বৈঠকেই ছোট ছোট দলে কাশ্মীর জুড়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা করার সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই বৈঠকে বোঝা যায় যে জৈশের সঙ্গে হিজবুল মুজাহিদিনের যোগসাজশ রয়েছে। এই যোগসাজশ এমন একটা সময়ে গড়ে উঠছে যখন পাকিস্তানের উপর লস্কর নেতা হাফিজ সৈয়দকে নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ থাকার জন্য লস্কর নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে ফেলেছে।
বছর কুড়ির আদিল আহমেদ দার মার্চ ২০১৮তে জৈশের দল যোগ দেন [সৌজন্যে: টুইটার]
দুর্ভাগ্যবশত গোয়েন্দাদের ইনপুট সুনজুয়ান মিলিটারি স্টেশনের হামলা আটকাতে পারেনি। জম্মুর এই মিলিটারি স্টেশনের হামলায় একজন সাধারণ নাগরিক ও ১১জন সৈনিক নিহত হয়েছিল। সুপ্রশিক্ষিত ও জৈশ জঙ্গিদের সঙ্গে দক্ষিণ কাশ্মীরের কিন্তু তৃণমূল স্তরের কর্মীরা এই হামলা করেছিল।
এই হামলার তদন্তে নেমে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ও গোয়েন্দারা মুফতি ওয়াকাসের নাম জানতে পারে যে কাশ্মীরে জৈশদের দায়িত্বে রয়েছে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে অবন্তীপোরাতে একটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে ওয়াকাসকে গুলি করে মেরে ফেলে সশস্ত্র বাহিনী।
জৈশ কিন্তু মুফতি ওয়াকাসের মৃত্যুকে তেমন আমল না দিয়ে উপত্যকায় একের পর এক ছোটখাট হামলা চালিয়ে গিয়েছে। গোয়েন্দারা অবশ্য এই ধরণের হামলা সম্পর্কে ক্রমাগত সচেতন করে গিয়েছেন নিরাপত্তারক্ষীদের।
মাসুদ আজহার, যিনি আবার জিহাদি পত্রিকা আল-কালামে সাংবাদিকতা করে থাকেন, অন্য ছক কষছিলেন।
এ বার তাঁর নিজের ভাইপো ১৮ বছরের আবু উসমানকে এম-৪ কার্বাইন নিয়ে স্নাইপার আক্রমণে পাঠানো হয়েছিল। উসমান অবশ্য তাঁর দাদা তালহা রাশিদের থেকে বয়সে ছোট যাকে ২০১৭ সালের নভেম্বরে পুলওয়ামায় নিরাপত্তারক্ষীরা হত্যা করেছিল। এই এম-৪ কার্বাইন হাতে জঙ্গির ছবি দেখে আবার বিনিদ্র রজনী যাপন করা শুরু করে দিলেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। গত বছর অক্টোবরে থেকে চেষ্টার পরে দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রালে আবু উসমানকে মেরেছিল নিরাপত্তা রক্ষীরা।
এই হত্যার দু'দিনের মধ্যে মাসুদ আজহার একটি তিন মিনিটের ভিডিয়ো প্রকাশ করেন। সেই সময়ে তাঁর দুই ভাইপোর মৃত্যুতে তিনি স্পষ্টতই ভেঙে পড়েছিলেন।
পুলওয়ামা আক্রমণ ২৬/১১র পর সর্ববৃহৎ গোয়েন্দা ব্যর্থতা [ছবি: রয়টার্স]
এই ভিডিয়োতে নিজের ভাইপোর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার পাশাপাশি তিনি সাধারণ কাশ্মীরীদের তাঁর আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানান। এই প্রথমবারের তাঁর আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য মাসুদকে কাশ্মীরিদের কাছে ভিক্ষে চাইতে দেখা গেল। তিনি যে বদলা নেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন তা বলাই বাহুল্য।
গোয়েন্দাদের দেওয়া খবর অনুযায়ী, একজন বর্ষীয়ান আফগান যুদ্ধবিশেযজ্ঞ উপত্যকায় এসেছিলেন জৈশ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। আর এই বদলা নেওয়ার খেলায় এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল যাকে ২৬/১১-এর পরে ভারতের সর্ববৃহৎ গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলা যেতেই পারে।
গোটা বিশ্ব থেকে যখন শোকবার্তা আসছে আর ভারত যখন গোটা বিশ্বের কাছে পাকিস্তান বিরোধিতার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে তখন কাশ্মীরের এই ঘটনার প্রত্যুত্তরে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।
পাঠানকোট ও উরিতে আক্রমণের পর সংবাদমাধ্যমে কূটনৈতিক চাপানউতোর বিষয়ক বহু খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনাটি তো উপত্যকায় জঙ্গি হামলার সংজ্ঞাটাই বদলে দিল। এই প্রথমবার আত্মঘাতী হামলার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হল যা সাধারণত আফগানিস্তান ও প্যালেস্তাইনে হয়ে থাকে। সাধারণ ফিদায়েঁ আক্রমণ আর এই ঘটনাটির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এখানে একজন আত্মঘাতী হামলা করল যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর যথাসম্ভব বেশি ক্ষতি করা যায়।
Strong statements pour in from across the globe against Pakistan sponsored dastardly terror attack in Pulwama, Kashmir in which 37 CRPF men have been martyred. UN, USA, UK, UAE, France, Australia, Nepal, Bhutan, Afghanistan, Bangladesh, Srilanka among others have condemned it. pic.twitter.com/qvAroSjMYp
— Aditya Raj Kaul (@AdityaRajKaul) February 14, 2019
তদন্তকারী সংস্থা ও গোয়েন্দারা এখন ব্যর্থতা খোঁজের চেষ্টা করে চলবে এবং ভবিষ্যতের জন্য সাবধানতা অবলম্বন করবে। কিন্তু এখন দুই দেশের কূটনৈতিক ব্যাপারগুলোর উপর সকলের চোখ থাকবে।
ক্রোধ বা আবেগকে সংবরণ করে এখন সেনাবাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) ও প্রথম সারির কূটনীতিকদের পরামর্শ মেনে পরবর্তী স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা উচিত।
এর সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হতে পরে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে কমিয়ে দেওয়া যা করলে ভারতের খুব বেশি ক্ষতি হবে বা। "সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত" দেশের তকমা পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়ে ভারত একেবারে ঠিক পথেই হাঁটা শুরু করেছে।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের হাতের পুতুল তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী সৈয়দ আলি শাহ গিলানি, মিরওয়াইজ উমর ফারুক ও ইয়াসিন মালিককে হয় প্রোফাইল নিরাপত্তা প্রদান বন্ধ করতে হবে ভারতকে। তাঁদের নিরাপত্তা বন্ধ করে দিলে ও তাঁদের ফান্ডের সূত্র বন্ধ করে দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর অনেকখানি চাপ দেওয়া সম্ভব হবে।
Pakistan Govt issues fresh statement on Pulwama terror attack in Kashmir within 30 minutes of the first statement at 12:16am IST with changes in language. Indian Occupied Kashmir becomes Indian Occupied Jammu & Kashmir. Here are both statements of 12:16am and 12:44am. pic.twitter.com/XO68pwhOrF
— Aditya Raj Kaul (@AdityaRajKaul) February 14, 2019
এই ঘটনাটি ঘটার কিছুদিন আগে সিন্ধু জল পরিদর্শরণের জন্য একটি পাক দল ভারতে এসেছিল এবং ভারত সেই দলের সদস্যদের যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। ভারত কেন সিন্ধু নদীর চুক্তি নিয়ে আরও কঠোর হচ্ছে না?
সাউথ ব্লকের মাথায় সামরিক আক্রমণের বিষয়টি রয়েছে। যেখান থেকে ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে প্রত্যাঘাতের দিনক্ষণ ও সময়ে নিরাপত্তাবাহিনীগুলো যেন স্থির করে নেয়।
দিল্লি যদি এখনও ইসলামাবাদকে ছেড়ে দেয় তা হলে ভবিষ্যতে ভারতকে চরম মূল্য চোকাতে হবে।
কাশ্মীর নীতি না থাকা কিংবা শহিদদের জন্য বদলা না নেওয়ার মানসিকতা আমাদের অনেকদিন ধরে ধাওয়া করে বেড়াবে - বিশেষ করে যদি না আমরা এখনই বিশ্বকে এই উদ্বেগের কথা জানাতে না পারি।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে