ক্রিকেটার ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হলে কেমন হবেন
ক্রিকেট মাঠ থেকে রাজনীতিতে এসে ‘তালিবান খান’ তকমা কেন?
- Total Shares
কমতে কমতে সময় আজ বছর থেকে মাসে, মাস থেকে সপ্তাহে, সপ্তাহ থেকে দিনে এবং এখন দিন থেকে কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছে গেছে। পাঁচ বছর পর বুধবার পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। এ বারে নির্বাচনী হাওয়াটা অন্যরকম। এতদিন যাঁর রাজনৈতিক সত্ত্বার চেয়ে ক্রিকেটীয় সত্ত্বার প্রভাব বেশি ছিল, সেই ইমরান খান এ বার অন্য নজরে। পাকিস্তানের আমজনতার মনে কী আছে জানা নেই, তবে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে এ বার দেশের নেতৃত্বে দেখতে চান অনেকেই।
১৯৯২ সালে পাকিস্তান বিশ্বকাপ জিতেছিল, নেতা ছিলেন ইমরান খান। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের মানুষের জন্য রাজনৈতিক দল গড়লেন। তার নাম পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইসলাম বা পিটিআই। ৬৫ বছরের আকর্ষণীয় ক্রিকেট নেতা আজ জননেতা হয়ে উঠেছেন। ২০ বছর হল পিছনে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন লন্ডনের গ্ল্যামার-সর্বস্ব জীবন। খসিয়ে ফেলেছেন ‘নাইট ক্লাবের নাইস সেলেব্রিটি’ ইমেজ।
বুধবার পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। যেখানে সভা করছেন সেখানেই ভিড়। লোকে শুধু ইমরান খানকে দেখছেনই না, ওঁর কথাও শুনছেন। ইমরান দুটো ব্যাপার সকলের মনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। “এবারই সুযোগ পাকিস্তান বদলে ফেলার। বার বার এ সুযোগ আসবে না।”
ইমরান প্রচারের মাত্রাটাই বদলে দিয়েছেন। যেখানে সভা করছেন সেখানে তাঁর দলের যুব সংগঠন ‘ব্র্যান্ড ইমরান’কে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বকাপে খেলার সময় তাঁর বোলিং অ্যাকশন ছাপা গোল গলার গেঞ্জি কিংবা মোবাইল কভার আর চমৎকার ডিজাইনের ফ্ল্যাগ – যেখানে ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জয়ী দলনেতা ইমরান খানের ছবি।
নির্বাচনে লড়ার একটাই ট্যাগলাইন: দুর্নীতি দূর হঠাও। ১৯৯৬ সালে তৈরি হওয়া পিটিআই ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত একটি মাত্র আসন জিতেছিল। এ বার দেশের পরিচালনার সম্ভাব্য দৌড়ে তাঁর দল সামিল।
ইমরান খানের রাজনৈতির জীবনের গ্রাফটা চড়তে শুরু করে যখন থেকে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে হাজির হন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। চলতি মাসের শুরুতেই ইমরানের আনা দুর্নীতির অভিযোগকে মান্যতা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট শরিফের ১০ বছরের সাজা ঘোষণা করে। পিটিআই-এর এক কর্মীর থেকে শোনা গেছে, জেলের ভিতরে শরিফকে টিভিতে ইমরান খানের নির্বাচনী মিছিল-জনসভা দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে।
১৯৯২ সালে পাকিস্তান বিশ্বকাপ জিতেছিল, নেতা ছিলেন ইমরান খান। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের মানুষের জন্য রাজনৈতিক দল গড়লেন
ইমরান মাঠে যেমন বুক চিতিয়ে লড়তেন, একই মেজাজ রাজনীতির ময়দানেও। নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ – নওয়াজের (পিএমএল-এন) সমর্থকদের ইমরান খান জনসমক্ষে ‘গাধার দল’ বলে কটাক্ষ করে চলেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ইমরান। ১৩ জুলাই বালুচিস্তানের পূর্বভাগে যে ‘সুইসাইড অ্যাটাক’ (আইসিস এর দায় স্বীকার করে) হয় তা নাকি শরিকের বিচারের বাণী শোনানোর রাস্তা রোখার পরিকল্পনায় সাজানো। ১৪৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়। ইমরানের চোয়াল শক্ত করা প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল: “যখনই নওয়াজ শরিফ কোনও না কোনও ব্যাপারে কোণঠাসা হয়, তখনই কেন সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে? কেন দেশর মধ্যে উগ্রপন্থীদের উগ্রতা বেড়ে ওঠে? এ সব কি শুধুই কাকতালীয় নাকি এ সবের মধ্যে অন্য কিছু জড়িয়ে?”
এখন কান পাতলে শোনা যায়, ইমরান নাকি এত বুক চিতিয়ে ‘রাজনীতির লড়াই’ লড়তে পারছেন – কারণ দেশের সেনাবাহিনীর মদত পাচ্ছেন। ৭১ বছরের স্বাধীন পাকিস্তানের ইতিহাসে অর্ধেক সময়ই সেনারাজই দেখেছে এই দেশ। ইমরানও দেখেছেন। নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে যত সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে এই দুই পার্টি আসন দখলের বিচারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আছে। কিন্তু কোথাও যেন শরিফের পিএমএল-এন দল বেকায়দায়। আর তা হবে নাই বা কেন? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিনি, তাঁর মেয়ে ও জামাই যে জেলে বন্দি। এই প্রথমবার নির্বাচনে শরিফ তাঁর যাবতীয় ক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছেন না, এমনটাই দাবি ইমরান খানের।
ইমরান দলও সাজিয়েছেন সব নতুন মুখ নিয়ে। নির্বাচনী স্লোগান: “নয়া পাকিস্তান লাও।” ভালো স্কুল, ভালো হাসপাতাল, দুর্নীতি নিপাত যাক, দেশের সম্পদ বাইরে আর দেওয়া নয়। ইমরানের লক্ষ্য পাক-পঞ্জাবের আসনগুলো। ২৭২-এর অধিকাংশই এই অঞ্চলের।
নওয়াজের সমর্থকদের ইমরান খান জনসমক্ষে ‘গাধার দল’ বলে কটাক্ষ করে চলেছেন।
১৯৫২ সাল। দে.শের সন্মের ৫ বছর পর ইমরানের জন্ম। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করে বড় হওয়া ইমরানকে দেশে এক সময় ‘অন্য নজর’ও ছিল। বেশিরভাগ সময় লন্ডনে থাকায় ইমরানকে ‘বিদেশি পাকিস্তানি’ তকমাও দেওয়া হয়েছিল। ইমরানের ব্যক্তিগত জীবনও জনতার দরবারে ভিন্ন মত পোষণ করে। প্রথমে জেমাইমা খান – ব্রিটিশ সুন্দরী ও ধনবতী কন্যা তাঁর স্ত্রী ছিলেন। এ বছর গোপনে তাঁর আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা বুশরা মানেকা নিকাহ করেন। কিন্তু হঠাৎই তাঁর ইমেজে কলঙ্ক লেপে দেন দ্বিতীয়া পত্ন রেহান খান। একটি বই প্রকাশ করেন রেহান যেখানে ইমরান সম্পর্কে লেখা আছে বহু বিতর্তিক বিষয়। পাকিস্তানে এই বই বিক্রি বন্ধ। কিন্তু সেই বইয়ের বক্তব্য পিডিএফ থেকে জানা যায়, তা হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হয়ে যায়।
বইয়ে দাবি: রাতে ইমরান ৬ গ্রাম করে কোকেন নিতেন। তাঁর প্লেবয় ইমেজে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ‘ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ’ সন্তানরা আছে। নারীসঙ্গ নাকি ইমরানের আরেক নেশা। ইমরানের দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নির্বাচনের আগে বই প্রকাশ করার পিছনে রয়েছে শরিকের দল পিএমএল-এন।
ঘটনা হল, এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন জনসমীক্ষায় ইঙ্গিত মিলেছে পাকিস্তানে এ বার একক দলের সরকার হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে ইমরানের দল পিটিআই হবে সরকার গড়ার চাবিকাঠি। পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেনাবাহিনীর দাপট – এ সব সামলাতে এক যোগ্য নেতাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু খেয়ালও রাখতে হবে নিজেদের উইকেটটি যেন না খোয়াতে হয়।
ইমরান প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের লাভ, নাকি ক্ষতি? একটা ছবি স্পষ্ট, নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় নেই, সেনার হাতে পাকিস্তান চলবে না। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) হয়ে লড়ছেন বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি। পিএমএল-এন এবং পিপিপি-র সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা এর আগে ভারতের হয়েছে। কিন্তু পিপিপি-র জারদারির পাকিস্তানের মাটিতে হালে পানি পাওয়া দুষ্কর।
হাফিজই পাকিস্তানের ভারত-বিরোধী শক্তি
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুডবুকে আছেন একমাত্র ইমরান খান। তাঁর দলের কাণ্ডারী হয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় জেহাদি গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার রাস্তা খুলে রেখেছেন। তাই ইমরানের বিপক্ষশিবির তাঁর নাম দিয়েছে ‘তালিবান খান’।
দুনিয়া জানে এখন পাকিস্তান চলছে (সাময়িক সরকার) পাক সেনাপ্রধান নাসিরুল মুলকের তত্ত্বাবধানে, নেপথ্যে আছে আইএসআই। ৩৪২ আসনের লড়াইয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইমরান পেলে ভালো, অন্যথায় কাছাকাছি পৌঁছালে অন্য কারও সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়বে।
এক দিকে বিশ্বের উগ্রপন্থী আতঙ্ক হাফিজ সঈদ, লস্কর-ই-তৈবা (এলটিই), জামাত-উদ-দাওয়া (জেইউডি) চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানের এই নির্বাচন লড়তে। গড়ে ফেলেছিল রাজনৈতিক দল – মিল্লি মুসলিম লিগ (এমএমএল)। হাফিজই পাকিস্তানের ভারত-বিরোধী শক্তি। ২০০৮ সালে ২৬/১১ জঙ্গি হানায় এই নাম জড়িত। কিন্তু এমএমএল-কে ফরেন টেরটিস্ট অর্গানাইজেশন (এফটিও) লস্করের আরেক দল বলে কালো তালিকাভুক্ত করে দেয়। এমএমএল স্বীকৃতি না পেলে কী হবে, হাফিজ ২৬৫ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আল্লহ আকরব তেহরিক (এএটি) মঞ্চ থেকে। এ সব কীর্তি জানাজানি হওয়ার পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারনা, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হয়তো ইমরানকে পরামর্শ দেবেন হাফিজের জয়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গড়তে, যাতে শরিকের দল ক্ষমতায় আসতে না পারে।
তা হলে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী! তিনি ক্রিকেট দলের দায়িত্ব পেয়ে যা যা করেছিলেন তাই তো আজ নজরকাড়া ইতিহাস। দলনেতা হয়ে ইমরান প্রাক্তন অধিনায়ক মজিদ খানকে (আত্মীয়ও বটে) বাদ দিয়ে তরুণ প্রতিভাবানকে দলে সুযোগ দিয়েছিলেন। দল আগে, ব্যক্তি নয়—এই মানসিকতা দেখিয়ে ট্রিপল সেঞ্চুরি থেকে সামান্য দূরে থাকা মিয়াঁদাদের কথা না ভেবে ইনিংস ডিক্লেয়ার করেছিলেন। পাকিস্তান জয়ের স্বাদ পেয়েছিল।
১৯৯২ বিশ্বকাপের সময় বুকিরা দারুণ তৎপর ছিল এবং তাঁর দলের দিকে নজর আছে আঁচ পাওয়ায় সতর্ক করেছিলেন সতীর্থদের। প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল তাতে: “বুকিদের কথায় চলেছ এমন সত্যতা পেলে দলে তো বটেই দেশেও টেঁকা মুশকিল হবে।” যে পাকিস্তান অধিনায়ক বিশ্বকাপ জিতে সেই ট্রফি তাঁর মায়ের নামে তৈরি ক্যানসার হাসপাতালকে উৎসর্গ করেন, তিনি কি এ বারও পারবেন মাথা উঁচু করে আপসহীন ভাবে দেশের মানুষকে ভরসা দিতে?
১৯৯৯ সালে পাক-হিরো ইমরানকে ভিটেছাড়া করেছিলেন পারভেজ মোশারফ। ২০০২ সালে মোশারফ চাননি ইমরানের সঙ্গে হাত মেলাতে, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে। ২০০৩ থেকে ২০১৮ – ইমরান শাসনের সুফল দেখল খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চল। এই ইমরান যেন নতুন চেহারার নওয়াজ শরিফ। পাকিস্তানের নয়া ‘মসিহা’ হয়ে কি উঠতে পারবেন ইমরান?