হিন্দু মহাসভা গান্ধীকে আধুনিক রাবণ ও গডসেকে রাম প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে চলেছে
গান্ধীর প্রয়াণদিবসে তাঁর কুশপুতুলকে গুলি করে হিন্দু মহাসভা নেতৃত্ব, জানিয়েছেন এ ভাবেই চলবে
- Total Shares
কার্ল মার্ক্স একবার বলেছিলেন, "প্রথমে একটি দুঃখজনক ঘটনার মাধ্যমে ও পরবর্তীকালে প্রহসন রূপে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।"
তা আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার ধরা পড়ছে।
সচিব পূজা শাকুন পাণ্ডের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার সদস্যরা মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কুশপুতুল লক্ষ করে গুলি করলেন। কুশপুতুল থেকে যাতে রক্তের মতো রঙ বেরিয়ে আসে তারও ব্যবস্থা তাঁরা করেছিলেন। এর পরে হাততালি দেওয়া হল এবং সদস্যদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে দিনটি উদযাপন করা হল।
শাকুন ও তাঁর স্বামীকে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু যে ভাবে গান্ধীর মৃত্যুদিনের স্মৃতিরোমন্থন করা হল তা থেকে সংস্থাটির মানসিকতার পরিচয় মেলে।
মহাত্মা গান্ধীর কুশপুতুলকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ছেন পূজা পান্ডে [সৌজন্যে: ইউটিউব]
৩০ জানুয়ারিকে তাঁরা শৌর্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সে দিনেই গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে রাম ও গান্ধীকে রাবণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। জানানো হয়েছে, প্রতি ৩০ জানুয়ারি গান্ধীর কুশপুতুলকে এই ভাবে গুলি করা হবে এবং গান্ধীর মৃত্যবার্ষিকীর তাঁরা মহাসমারোহে উৎসবের আয়োজন করবেন। অনেকটা যেমন দশেরার দিন রাবণের কুশপুতুল পোড়ানো হয়ে থাকে।
সারা জীবন ধরেই আমি গান্ধীর সমালোচনা করে এসেছি, কিন্তু এই ঘটনার পর গান্ধী সম্পর্কে আমার ধারণা বদলেছে।
বিজেপি যদি দিল্লি বা লখনউতে ক্ষমতায় না থাকত তাহলে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ও প্রহসনের মাধ্যমে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটত না।
তিনি যায় আধুনিক যুগের রাবণ হতে চলেছেন [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
তাঁরা অতীতের সত্যগুলোকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে মরিয়া এবং তাঁরা দেখিয়ে দিলেন যে সেই সত্যিগুলো কী ভাবে ভবিষ্যতে প্রহসনে পরিণত হতে পারে।
আরএসএসের সমর্থন পাওয়া হিন্দু মহাসভা ও তার সঙ্গে যুক্ত দলগুলো যদি প্রতিবছর গান্ধীকে এ ভাবে হত্যা করে চলে তা হলে নাথুরাম তো দেশনায়কের মর্যাদা পাবেন। অর্থাৎ ভারতের নৈতিকতার পথটাই তো বদলে যাবে।
শাসক দল এই নিয়ে কোনও দুঃখ প্রকাশ করেনি, এই বিষয়ে তারা যে বিচলিত, তাও নয়।
প্রতি বছর ধরে যদি এ জিনিস চলতে থাকে তাহলে একটি জনশ্রুতি কালক্রমে সত্যিকারের ইতিহাস হয়ে দাঁড়াবে।
এই সংস্থাগুলো বরাবরই দাবি করে এসেছে রাম রাবণকে হত্যা করেছে মানে ধর্ম অধর্মকে হত্যা করেছে। রামায়ণে কাহিনি পড়ে লোকে এই ধারণাতেই বিশ্বাস করে। তাই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ রামের নামে নিজেদের সন্তানদের নাম রাখেন, কিন্তু রাবণের নামে নয়।
গান্ধীকে যদি এই ভাবে আক্রমণ করা হয়, তাহলে যে কেউই আক্রমণের শিকার হতে পারেন [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
মর্যাদা পুরুষোত্তমের আসনে বসানো হয়েছে শ্রীরামকে। উল্টোদিকে, রাবণকে রাক্ষস বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই তো রাম ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন অযোধ্যায় যাঁর মন্দির হিন্দু ধর্মের মধ্যমণি হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হিন্দু মহাসভা এখন নাথুরামায়ণ লেখার পরিকল্পনা করছে যেখানে গান্ধীকে আধুনিক কালের অধর্ম এবং নাথুরামকে সেই অধর্মের বিনাশকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। তারা যদি প্রতিবছর গান্ধীর কুশপুতুল লক্ষ করে গুলি ছুড়তে শুরু করে তা হলে কয়েক বছর পর পরবর্তী প্রজন্ম সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে গান্ধী সত্যিই 'মন্দের' প্রতীক আর নাথুরাম 'ভালোর' প্রতীক।
এই সংস্থাটি গান্ধীকে 'মুসলমান সমর্থক' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে চলেছে। রামমন্দিরে করা তাঁর প্রার্থনাগুলো, ভগবদগীতা, তাঁর অহিংসার তত্ত্ব, তাঁর নিরামিষাশী জৈন জীবনযাপন সব কিছুই ভারতীয়দের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে।
আমরা অবশ্য নাথুরামের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না। শুধু এইটুকুই জানি যে তিনি পুনেতে থাকতেন, হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলেন এবং মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু এখন হিন্দু মহাসভার লেখকরা তাঁর সম্পর্কে নানান ভালো ভালো তথ্য দিচ্ছেন যা আদতে নাথুরামায়ণ রচনা করার প্রাথমিক চেষ্টা।
কোনও একজন সম্পর্কে এই ধরণের নতুন কাহিনি সৃষ্টি করা মানে মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তনের চেষ্টা।
যদি সরকারি সমর্থনে গান্ধীর মতো একজন মহান ব্যক্তিকে, যাঁকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হয়, হেয় করার চেষ্টা হয় তা হলে এদেশে সবকিছুই সম্ভব।
একটি মিথ্যাকেও সত্যি করে তোলা সম্ভব। সত্য ও অসত্য যে কোনও সময়ে বদলে দেওয়া সম্ভব। আপনার মতাদর্শ কতটা শক্তিশালী ভাবে প্রচার করা হচ্ছে তার উপরই সত্য ও মিথ্যা নির্ভর করে থাকে।
আরও একটি নিদর্শন তুলে ধরা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ভারত বিশ্বের দুর্বলতম দেশ ছিল। এই কথাটি তারা বারংবার ২০১৪ নির্বাচনের আগে বুঝিয়েছিল। পাঁচ বছরের মধ্যে সরকার ও কর্পোরেটের সান্নিধ্যে থাকা সংবাদমাধ্যম একটা কথাই বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছে - এই মুহূর্তে ভারত এশিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী দেশ।
১৯৯৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার ভারত অন্ধকারচ্ছন্ন ছিল। অথচ বাজপেয়ী ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছরের মধ্যে, "ভারতের সূর্যোদয় হয়েছিল"। এটা তো 'অহম্ ব্রহ্মস্মিন্' (আমিই সব)-এর তত্ত্ব। এটা কোনও ছোটখাট গোষ্ঠীর দর্শন। মূল দলটিই এই দর্শনে বিশ্বাস করত।
গান্ধীর নিদর্শন থেকে বোঝা যায় যে একটি রাষ্ট্র কী ভাবে একটি 'ভালো' কাহিনিকে 'খারাপে' পরিণত করতে পারে। বিদেশে গৌতম বুদ্ধ ও আম্বেদকরের পাশাপাশি গান্ধীর নামও ব্যবহার করে থাকেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু তা দিয়ে তাঁর দলের আদর্শ বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু শ্রীমতি পাণ্ডে যা করলেন তা আসলে সেই দলের প্রকৃত আদর্শ।
এর আগে এই দলের লোকেরা কমিউনিস্টদের সম্পর্কে খারাপ কাহিনির প্রচলন করেছে। যেমন পুচালাপল্লি সৌন্দর্য্যের মতো একজন সাধারণ মানুষ। তাঁর সম্পর্কে এমন কথা প্রচলন করা হয়েছিল যাতে মনে হয়েছিল তিনি বোধহয় কোনও লাল-দানব।
নাথুরাম গডসে যদি রাম হয়ে যান তাহলে দেশাত্মবোধের সংজ্ঞাটাই বদলে যাবে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
ধর্মন্ধতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের চাপে পড়ে মধ্যবিত্তরা সহজেই এই মিথ্যeগুলোকে বিশ্বাস করে ফেলেন। এই ধরণের নির্বাচনী পন্থা বিজেপিকে হয়তো পুনরায় ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করবে, কিন্তু গান্ধীকে নিয়ে তারা যা করছে তা কিন্তু সভ্যতার জন্য মোটেও ভালো নয়।
যদি গান্ধীর বিরুদ্ধেই এই ধরণের শক্তি প্রদর্শন করা হয় তাহলে সকলের বিরুদ্ধেই তারা এই ধরণের শক্তি প্রদর্শন করতে পারে।
ধনতান্ত্রিকরা এমন একটা বাজার খোঁজেন যেখানে সকলে তাদের কথা বিশ্বাস করবে। বিভিন্ন সময়ে তারা সংবাদমাধ্যমের একাংশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। যদি বিভিন্ন ধরণের অদ্ভুতুড়ে কর্মকাণ্ড দেখিয়ে প্রমাণ করা চেষ্টা হয় যে গান্ধী সত্যিই খারাপ ছিলেন তা হলে অচিরে মানুষ তাই বিশ্বাস করতে শুরু করে দেবে। মধ্যবিত্তরা গান্ধী হত্যার জন্য নাথুরামকে পুজো করতে শুরু করে দেবে।
এই সংস্কৃতি মোটেই আধুনিক গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো নয়, যা অসংখ্য মানুষের আত্মবলিদানের ফলে অর্জন করা গেছে।
গান্ধীর বলিদান যদি 'দানবের মৃত্যু' হয়ে যায় আর নাথুরাম গডসে যদি পূজিত হতে শুরু করেন তা হলে দেশাত্মবোধের সংজ্ঞাটাই বদলে যাবে।
তা কিন্তু আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে