এক বছর পার, আন্দোলন নিয়ে মতপার্থক্য পাহাড়ে
মুখ্যমন্ত্রী এখন আবার পাহাড়ে, এক বছর আগে সেই ঘটনার অভিজ্ঞতা
- Total Shares
এক বছর পর আজ আবার পাহাড়ে এসেছি অ্যাসাইনমেন্টে। বর্ষার পাহাড়ের আলাদা আকর্ষণ আছে। গত বছর দার্জিলিং এসেছিলাম ৩০ জুন। ইস্যু ছিল গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন। আমি আন্দোলনের শুরুর দিকে ছিলাম না। সেই সময় কী ঘটেছিল সকলেরই পড়া-জানা। মুখ্যমন্ত্রী সপার্ষদ পাহাড় ছাড়তেই বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম পাহাড় ছেড়েছে। এমন সময় ঠিক করলাম দার্জিলিংয়ে থেকে রিপোর্ট করব। কারও কোনও অ্যাসাইনমেন্ট ছিল না। আগে তো পৌঁছাই, পরে প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে ভাবা যাবে।
দার্জিলিংয়ে পরিচিতরা কেউই নেই। আর সবাই যেতে বারন করছে। থাকব-খাব কোথায় জানি না। ৩০ জুন সকাল সকাল বাগডোগরায় নামলাম। আমার পরিচিত হোটেল মালিক দার্জিলিং ছেড়ে শিলিগুড়িতে থাকছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তার কাছে গেলাম, কিছু একটা ব্যবস্থা চাই। আমার মতো ফ্রিল্যান্সারের পক্ষে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া অসম্ভব। একেই দার্জিলিং যাওয়ার কোনও গাড়ি নেই। আর প্রেস পরিচয়ে গেলেও বারো থেকে পনেরো হাজার টাকা প্রতিদিন দিতে হবে। অগত্যা উপায়! রাতের দিকে কয়েকটি ট্রাক নাকি উপরে উঠতে পারে, তার মধ্যে ঢুকে যেতে হবে। শিলিগুড়িতে সেদিন সকলেই বলেছিল যাওয়া অসম্ভব।
আমি দার্জিলিং যাবই। সোজা দার্জিলিং মোড়ে চলে গেলাম। খুব কম গাড়ি। একের পর এক পুলিশের, সেনার গাড়ি যাচ্ছে। হাত নেড়ে অনুরোধ করলেও দাঁড়ায়নি। অ্যাম্বুল্যান্সও চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউই নিয়ে যেতে রাজি নয়। শেষ মুহূর্তে একটা গাড়ি দাঁড়াল। সঞ্জয় কুমার, অবাঙালি। আত্মীয়কে বিমানবন্দরে ছেড়ে দিয়ে কার্শিয়াংয়ে ফিরছেন। আমার পরিচয় পেয়ে নিতে রাজি হলেন।
গাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ বেঁধে রওনা হলাম। সুকনার রাস্তা ধরতেই একদল লোক গাড়ি দাঁড় করাল। চালককে ধমক। আমাকে নিতে উনি এসেছেন, এ কথা বলায় ছাড়া পাওয়া গেল। আমরা যখন রাস্তায় নেমে কথা বার্তা বলছি, একদল লোক খাবারের আশায় গাড়ি তল্লাশি করছে। আমাদের সঙ্গে অবশ্য কিছুই ছিল না। এ সব পর্ব শেষ করতে না করতেই বৃষ্টি নামল। চারদিক সাদা হয়ে গেছে, কিছু দেখা যাচ্ছে না। দুপুর দুটো নাগাদ কার্শিয়াংয়ে জিরো পয়েন্ট পৌঁছলাম। আমি নেমে পড়লাম। সঞ্জয় নীচে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। অঝোর ধারায় বৃষ্টি, জিরো পয়েন্টে কেউ নেই। পুলিশ ফাঁড়িতে কয়েকজন সিআরপিএফ জওয়ান আর দুজন দার্জিলিং পুলিশ কনস্টেবল।
আমি ফাঁড়ির ভিতরে ঢুকে দাঁড়ালাম। দার্জিলিংয়ে মিছিল থাকায় সেদিন কোনও গাড়ি উপরে উঠছিল না। শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াংয়ে কয়েকটি গাড়ি আসছে। আন্দোলনকারীরা প্রত্যেকটা গাড়িতে তল্লাশি করছে। খাওয়ার জিনিস কেড়ে নিচ্ছে। চালের বস্তা থেকে ডিমের কার্টেন— সব কেড়ে নিচ্ছে। মহিলারা কেঁদে পায়ে ধরছেন, লাভ হচ্ছে না। আমি সব দেখেও ক্যামেরা বের করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। অপেক্ষা করছি, যদি কোনও গাড়ি পাওয়া যায়। না হলে উপায় একটা আছে, রাতে সিআরপিএফের ডিউটি বদলের সময় ওদের গাড়ি করে দার্জিলিংয়ে ঢুকব। দু’ঘন্টা কেটে গেছে দার্জিলিং যাওয়ার উপায় নেই দেখে হাঁটতে শুরু করলাম। এখনও ৩৪ কিলোমিটার বাকি। হেঁটে কার্শিয়াং স্টেশনে গেলাম।
হঠাৎ একটা হর্নের আওয়াজে পিছনে ফিরতেই দেখলাম একজন বাইক নিয়ে আসছেন। থামিয়ে কথা বলতেই বললেন, উল্টোডাঙার কোয়ার্টার্স থেকে বাইক নিয়ে দার্জিলিংয়ের বাড়ি যাচ্ছেন। বিএসএফে চাকরি করেন। নির্ণয় ছেত্রী। আমায় আর সেদিন হেঁটে দার্জিলিংয়ে যেতে হয়নি। নির্ণয়ের বাইকে করে চকবাজারে নামলাম। সন্ধ্যা প্রায় ছ'টা বাজে। রাস্তা শুনশান, পুলিশ আর সিআরপিএফ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। হেঁটে হেঁটে রকভিল রোডের পরিচিত হোটেলে পৌঁছলাম। সাটার ধাক্বিয়ে বহু কষ্টে দরজা খোলালাম। মালিক শিলিগুড়িতে আছেন, দু'জন ছেলে হোটেল পাহারা দিচ্ছে। আমার চেনা, তাই থাকতে দিল। রাজু আর মুন্না দুজনে দিনরাত হিন্দি সিনেমা দেখে কাটাত।
আমি ঢুকতেই চা দিল। চিনি দুধ কিছুই ছিল না সেই চায়ে। আর জানাল, চাল স্টকে বেশি নেই তাই দিনে ভাত আর রাতে রুটি দেবে। আর একই ডাল দুবেলা দিত। আমার কোনো আপত্তি নেই ওদের সাথে রোজ খাওয়া দাওয়া করতাম। কেউই ভরপেট খেতাম না, পরের দিনের জন্য ভাবতাম। গোটা পাহাড়ে তখন হাতে গোনা সাংবাদিক রয়েছেন। আমি ছাড়া ২৪ ঘণ্টা, এবিপি আনন্দ, নেটওয়ার্ক ১৮ ও টাইমস মিলিয়ে আরও ছ’জন। সবাই হোটেল সেভেন সেভেন্টিনে থাকত। সেই সময় একমাত্র এইটাই খোলা ছিল। আমি থাকতাম হোটেল অ্যালপাইনে। মাত্র এই ক’জনের মাধ্যমে খবর পৌঁছাত গোটা রাজ্যের কাছে। এক সপ্তাহ এ ভাবেই কেটে গেছে। রোজ সকালে বেরিয়ে বিকেলের মধ্যেই হোটেলে ফিরতাম। আমার যেহেতু কোনও গাড়ি ছিলনা তাই হেঁটে হেঁটেই রোজ খবর খুঁজতাম। আন্দোলনের ধরণ অনুযায়ী সকালে মিছিল হত আর রাতে পুলিশ ফাঁড়ি, লাইব্রেরি, রেল স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দিত। খবর খুঁজতে চকবাজার, সদর পুলিশ স্টেশন থেকে ঘুম রেলস্টেশন, হ্যাপি ভ্যালি চা বাগান হেঁটে ঘুরেছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু বড় সমস্যা স্টোরি ফাইল করব কী ভাবে? ইন্টারনেট শাটডাউন চলছে। এই অবস্থায় দ্য কুইন্ট, হাফিংটন পোস্ট, দ্য সিটিজেনে স্টোরি প্রকাশিত হল। মহাকাল মন্দিরের পিছনের দিকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেশ কিছুটা জঙ্গল পথ গেলে শুধু মাত্র সিকিমের জিও নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত। এ ভাবে মোবাইল ফোন থেকে ছবি, রিপোর্ট পাঠাতাম।
রোজ হোটেলে ফিরলে ছেলে দুটো জিজ্ঞেস করত, দাদা বনধ কবে উঠবে? উত্তরটা কেউই জানে না। আন্দোলনের ভয়ানক রূপ দেখেছি। ছোট বাচ্চা কাঁদছে, ঘরে বিস্কুট নেই। তার বাবা ওষুধের দোকানে যাচ্ছে বিস্কুটের খোঁজে। আন্দোলনকারীরা কোনও গাড়ি নীচে সমতলে যেতে দিত না। পরীক্ষা, অসুস্থতা প্রমাণিত হলে আন্দোলনকারীরা পাস ইস্যু করত, তবে যাওয়া যেত শিলিগুড়িতে। বাঙালি, হিন্দিভাষীদের পাহাড় ছাড়তে হবে, বললেন বিমল গুরুং। পাহাড়বাসী দিশাহারা, সমতলের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের। মিছিলে ছবি তুলতে গিয়ে লাথি খেয়েছি বহু। কোথাও একটা বার্তা ছিল, “বাংলার মিডিয়া ফিরে যাও।”
বনধ ওঠার কোনওরকম সম্ভাবনা নেই। সংবাদ মাধ্যমের বাকিরাও ঠিক করল তারাও ফিরবে। প্রতিদিন আধপেটা খেয়ে কাজ করা অসম্ভব। শেষের কদিন ডাল টা শুধু হলুদ জল হয়ে গেল। ২৪ ঘণ্টার সাংবাদিক দিদি অনেক বার ওঁদের হোটেলে ডেকেছেন। ওখানে ডিম পাওয়া যাচ্ছিল। যাইনি, আমার হাতে তখন সীমিত টাকা, কলকাতায় ফিরতে হবে।
৭ই জুলাই সকাল বেলা বেরলাম, কিছু না পেলে ৭৭ কিমি হেঁটে নামব। হাল্কা বৃষ্টি পড়ছে, হেঁটে হেঁটে ঘুম স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। হঠাৎ একটা সাদা সুমো সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভারকে চেনা লাগল। আমায় গাড়িতে তুলে নিলেন, বললেন এ ক’দিন উনি ২৪ ঘণ্টার গাড়ি চালিয়েছেন, তাই আমায় চেনেন। ওঁরাও ওঁকে ছেড়ে দিয়েছেন বাকি সব রিপোর্টাররা এক গাড়ি করে ফিরবে তাই ও শিলিগুড়ি ফিরে যাচ্ছে। পরের দিন বাকি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা ফিরে এল। ৮ই জুলাই কলকাতা ফিরলাম।
আমরা ফিরে গেলেও ১০৪ দিন চলেছিল বনধ। এবার এসে পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করলাম। সবাই বলছে ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গেছে। নতুন করে সব শুরু করেছি। অনেকের চোখে জল। গোর্খাল্যান্ড দাবিতে একমত হলেও আন্দোলনের ধরন নিয়ে পাহাড় জুড়ে মতপার্থক্য রয়েছে।