ডোকলাম থেকে পুলওয়ামা, ভারত কেঁপে গিয়েছিল: জঙ্গি দমনের জন্য প্রস্তুতি দরকার
পুলওয়ামা জঙ্গি হামলায় ভারতের গোয়েন্দা ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল
- Total Shares
পরিবেশ পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত হয়েছে। ঘরের ছেলে উইং কমান্ডার অভিনন্দনও ঘরে ফিরে এসেছেন। জম্মু ও কাশ্মীরে গত তিন দশক ধরে চলতে থাকা সন্ত্রাসবাদী সমস্যাকে কী ভাবে উৎখাত করা যায় তা নিয়ে এখন আমাদের চিন্তাভাবনা করতে বসতে হবে।
সৌভাগ্যবশত, বড় ধরণের ছোট আঘাত না পেয়েই অভিনন্দন ঘরে ফিরেছেন। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীরে প্রায় প্রতিদিনই আমরা কোনও না কোনও 'ঘরের ছেলেকে' হারিয়ে চলেছি। মৃত্যের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর, আইএসআই ও সেনাবাহিনীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে হাফিজ সঈদ ও মাসুদ আজহারের মতো জঙ্গি নেতারা বিলাসবহুল জীবন যাপন করে চলেছেন।
পুলওয়ামা জঙ্গিহামালায় চল্লিশের অধিক সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু থেকে শুরু করে অভিনন্দন যখন ওয়াঘা সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের মাটিতে প্রবেশ করলেন - এই মধ্যবর্তী সময়কার ঘটনাপ্রবাহগুলোর উপর চোখ রাখলে আমরা বুঝতে পারব যে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করতে আমাদের ঠিক কী কি পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুলওয়ামা হামলার জন্য গোয়েন্দা ব্যর্থতা দায়ী [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]
পুলওয়ামা জঙ্গিহামলায় কত পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল তা নিয়ে কোনও সরকারি হিসেব এখনও অবধি পাওয়া যায়নি। কারণ, এই ধরণের হিসেবে কষা সব সময়ে সম্ভবপর নয়। তবে প্রকৃত ঘটনাটা হচ্ছে, স্থানীয় অঞ্চল থেকে একটি গাড়ি জোগাড় করে তার ভিতরে প্রচুর পরিমাণ বিস্ফোরক মজুত করা হয়েছিল। সেই বিস্ফোরণের পরিমাণ এতটাই ছিল যে আস্ত একটি বাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। খুব সম্ভবত, এই বিস্ফোরক এই দেশ থেকেই জোগাড় করা হয়েছিল এবং অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে সেই বিস্ফোরককে গাড়ির চারিপাশে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্যেও কোনও বিশেষ ধরণের প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল। এই প্রতিটি কাজের জন্য কোনও বিশেষজ্ঞের মাথার প্রয়োজন পড়ে। এর উপর আবার গাড়িটির জন্য একজন চালক জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল যিনি স্বর্গে যাবেন বলে ফিদায়েঁ হতে রাজি হয়েছিলেন। সিআরপিএফের কনভয়টি যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে সেই পথটিকে বারংবার পরিদর্শন করা হয়েছিল, যাতে বিস্ফোরণ ঘটানোর আদর্শ জায়গাটি খুঁজে বের করা যায়। রাস্তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের কার্যকলাপ সম্পর্কেও 'খবর' সংগ্রহ করা হয়েছিল।
আমাদের দেশের গোয়েন্দারা জঙ্গিদের এই কার্যকলাপগুলোর খবর জানতেই পারেননি, যার খেসারত দিতে হল চল্লিশেরও বেশি সিআরপিএফ জওয়ানকে।
এই ঘটনায় দেশের গোয়েন্দা বিভাগ সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে - যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তা স্বীকার করে না নিচ্ছি ততক্ষন কিন্তু এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা রয়ে যাবে। ঘটনা ঠিক কোথায় কখন ঘটবে তা হয়ত জানা ছিল না। কিন্তু এত বড় মাপের নাশকতার ছকের কিছু খবর তো গোয়েন্দাদের কাছে থাকা উচিত ছিল।
ঘটনার পরে অবশ্য খুব খুব দ্রুত এবং সঠিকভাবে আমরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি। জৈশ-ই-মহম্মদ খুব দ্রুত এই ঘটনার দায়ে স্বীকার করে নিয়েছিল। অর্থাৎ, দোষীদের খুঁজে চিহ্নিত করার চ্যালেঞ্জটা আর আমাদের নিতে হল না।
কূটনৈতিক চালগুলোও আমরা পুরোদমে চালু করে দিলাম আর গোটা বিশ্ব থেকেই আমাদের জন্য সমবেদনার বার্তা আসতে শুরু করে দিল। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ কখনও সরাসরি আবার কখনও পরোক্ষভাবে এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করতে শুরু করে দিল। আর, ঠিক এই সময়তেই, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স পাকিস্তানের প্রতিবাদ লঙ্ঘন করে ভারতকে ওআইসি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভেঙে দিল। ভারতও সেই মঞ্চ ব্যবহার করে গোটা বিশ্বের কাছে নিজেদের বার্তা পাঠালো।
ওআইসির বৈঠকে সুষমা স্বরাজ [ছবি: এএনআই]
পাকিস্তানকে দেওয়া 'মোস্ট ফেভারড নেশন’ তকমা আমরা প্রত্যাহার করে নিলাম। এর ফলে পাকিস্তানের ব্যাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।
জম্মু ও কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর কড়া নজরদারি চলছে। বেশ কিছু আগে থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার পর তাদেরকে 'ক্ষতিকর' বলে মান্যতা দেওয়া উচিত। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, তাদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হবে এবং টাকা তছরুপ, পাথর দিয়ে আক্রমণ ও হিংসা ছড়াবার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে এনআইয়ের বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া এনআইয়ের উচিত।
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ কাশ্মীরে ও পাসকিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংশ করে আমরা একটি বড় সাফল্য অর্জন করেছি - বার্তা দেওয়া গিয়েছে যে আমাদের বর্তমান নেতৃত্ব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এক (উরি হামলার পর নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যে হামলা করা হয়েছিল), ডোকলাম অচলাবস্থা নিয়ে চিনের সঙ্গে ৭০ দিন ধরে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করা আর বর্তমান সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে একটি জিনিসই প্রমান করেছে - আমাদের বর্তমান নেতৃত্ব ঝুঁকি নিতে সদা প্ৰস্তুত।
দুটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকেই আমাদের তরফে কোনও হতাহতের খবর নেই। এর জন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলো কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে।
নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র আরও উন্নত করতে হবে [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]
প্রয়োজন তারা নিজেদের দেশের মঙ্গলের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। তাদের পারফরম্যান্স দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছে। কাশ্মীরে যারা জীবন সংগ্রামের জন্য প্রতিদিন লড়াই করে চলেছে, হটাৎ করেই, অভিনন্দনকে দেখে তারা আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
ডোকালাম ও দুটি সার্জিকাল স্ট্রাইকের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে পড়েছে - শান্তি পরিস্থিতি ও অশান্তি পরিস্থিতির মধ্যিকার লাইনটি অনেকটাই সরু। এই তিনটি ঘটনাই আমাদের অবাক করেছে। এই তিনটি অভিযানের সময়ে গোয়েন্দারা ব্যর্থ হয়েছেন এমন আখ্যা দেওয়া ঠিক হবে না। শত্রুর ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ আঁচ করতে পারাটা সহজ নয়।
এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। একমাত্র তাহলেই আমরা প্রত্যাঘাত করতে পারব। সশস্ত্রবাহিনীর অস্ত্র আরও উন্নত করতে হবে। গুলি বারুদের স্টকের অবস্থা বেশ শোচনীয়, তা এমনভাবে মজুত করতে হবে যাতে দশ দিনের জন্য গুলি বারুদ মজুত রাখা সম্ভব। এ বিষয়ে কতটা অগ্রসর হওয়া গিয়েছে তা নিয়ে এখনও আমরা নিশ্চিত নই। সরকারের উচিত প্রতিরক্ষা বাজেটের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা।
একটা সরকার যখন পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকে তখন আগের সরকারের উপর দোষারোপ করার কোনও মানে হয়না।
পাকিস্তান বারংবার পরমাণু অস্ত্র নিয়ে হুমকি দিয়ে চলেছে। এই হুমকির পর্দা ফাঁস করে দিতে হবে। পাকিস্তানের পরমাণু কমান্ড হয়ত বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন কিন্তু কোনও ভাবেই পরমাণু যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হয়নি। প্রথাগত কৌশল নিয়েই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নামতে পারি।
পাকিস্তানে আমাদের গোপন অভিযানগুলোর সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে হবে। সেনাপ্রধান হিসেবে ভিকে সিংয়ের মেয়াদকালে জেনারেল সিং টেকনিক্যাল সাপোর্ট ডিভিশন তৈরি করেছিলেন। খুব অল্প সময়তেই এই বিভাগ নিজেদের যোগ্যতার প্রমান দিতে পেরেছে। দাউদ, মাসুদ আজহার ও হাফিজ সঈদের মতো লোকেদের খুঁজে বের করে তাদের হত্যা করতে হবে। পাকিস্তানের অন্দরে ঢুকে আমাদের গোপন অভিযান চালাতে পারব। একমাত্র তাহলেই সঠিক প্রত্যাঘাত সম্ভব।
আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো বেশ লাভজনক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। যদিও এখনও আমরা পাকিস্তানকে অর্থ ও মদত দেওয়ার জন্য সৌদি আরব, চিন ও কিছু গাল্ফ দেশগুলোকে বিরত করতে পারেনি। বিদেশ থেকে পাকিস্তানের কোষাগারে অর্থ ঢোকার পথ বন্ধ করতে আমাদের উদ্যত হতে হবে।
কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদ উৎখাত করতে হবে [সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে]
আরও বেশ কিছু বিষয়ের উপর আমাদের জোর দিতে হবে। কিন্তু সকলের আগে আমাদের অন্দরমহলকে ঠিক করতে হবে।
মানবাধিকারের কথা মাথায় রেখে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে যারা পাথর ছোড়ে তারা একজন জঙ্গির চাইতে কোনও অংশে কম নয়।
কাশ্মীরের বেশ কিছু সরকারি আধিকারিকদের উপরও নজর রাখতে হবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে।
আর, যারা যারা জঙ্গিদের গাড়ি বোমা বা অন্যান্য পরিকাঠামো দিয়ে সাহায্য করছে তাদের চিহ্নিত করে শেষ করে ফেলতে হবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে