নাগপুরে প্রণব মুখোপাধ্যায়: কেন তাঁকে নিয়ে এত উদ্বিগ্ন কংগ্রেস
বক্তৃতায় তিলক, সর্দার প্যাটেলকে স্মরণ করেছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি
- Total Shares
দেশ জুড়ে গেল গেল রব, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় গিয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের সদর দপ্তর নাগপুরে! তাও আবার দীক্ষান্ত বক্তৃতা করতে!! কোনও ভাবেই এ কথা মেনে নেওয়া সম্ভব নয় কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ক্ষেত্রে!!! প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে শর্মিষ্ঠার পক্ষেও বাবার এ হেন পদস্খলন মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ বিজেপির মতো একটি দলের পাতা ফাঁদে তিনি পা দিলেন।
Hope @CitiznMukherjee now realises from todays’ incident, how BJP dirty tricks dept operates. Even RSS wouldn’t believe that u r going 2 endorse its views in ur speech. But the speech will be forgotten, visuals will remain & those will be circulated with fake statements. 1/2
— Sharmistha Mukherjee (@Sharmistha_GK) June 6, 2018
.@CitiznMukherjee By going 2 Nagpur, u r giving BJP/RSS full handle 2 plant false stories, spread falls rumours as 2day & making it somewhat believable. And this is just d beginning! 2/2
— Sharmistha Mukherjee (@Sharmistha_GK) June 6, 2018
শোনা যাচ্ছে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধীও যারপর নাই বিরক্ত। তাই নাকি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন আনন্দ শর্মা ও আহমেদ প্যাটেলের মতো তাবড় কংগ্রেস নেতারা। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এ হেন আচরণ দেশের লক্ষ লক্ষ কংগ্রেস কর্মীকে আহত করেছে বলে মনে করেন আনন্দ শর্মা। আহমেদ প্যাটেলের বক্তব্য, এমন আচরণ তিনি প্রণবদার থেকে আশা করেননি।
The images of Pranab Da, veteran leader and ideologue at RSS Headquarters have anguished millions of Congress workers and all those who believed in pluralism, diversity and the foundational values of the Indian Republic.
— Anand Sharma (@AnandSharmaINC) June 7, 2018
I did not expect this from Pranab da ! https://t.co/VBqXZ8x7SE
— Ahmed Patel (@ahmedpatel) June 6, 2018
খুব সম্ভবত কংগ্রেস নেতারা ভুলে গেছেন, দেশের রাষ্ট্রপতি পদের জন্য যখন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম মনোনীত করা হয়, তখন তিনি নিয়মমাফিক কংগ্রেসের সাধারণ সদস্যপদও ত্যাগ করেন। অর্থাৎ তিনি এখন আর কংগ্রেসী নন, আপাতত দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। তবে এ কথাও ঠিক, প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কয়েক বছর বাদ দিলে, পুরো সময়টাই কংগ্রেস রাজনীতি করেছেন। তাই তাঁকে কংগ্রেস নিজের লোক বলে মনে করতেই পারে।
রাজনীতির পরে আসা যাক ব্যক্তি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথায়। ব্যক্তি হিসাবে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে চিরকালই রুটলেস ওয়ান্ডার বলা হয়ে থাকে। তিনি অনেক ভালো প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন বলে স্বীকার করেছেন মনমোহন সিং নিজেই। যখন মনমোহন সিং অসুস্থ ছিলেন, তখন মন্ত্রিসভার সবচেয়ে প্রবীণ হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কাজ সামলেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ই। রাষ্ট্রপতি হিসাবেও তাঁর মনোনয়ন ছিল একরকম সর্বসম্মত, যদিও তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন পি এ সাংমা।
যিনি দেশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না? আরএসএসের সদর দপ্তর তো কোনও নিষিদ্ধ স্থান নয় যে সেখানে দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান যেতে পারবেন না। যিনি সারা জীবন রাজনীতি করেছেন, বাণিজ্য, অর্থ, বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সামলেছেন, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়্যারম্যানের পদ সামলেছেন এবং শ-খানেক গুরুত্বপূর্ণ কমিটির দায়িত্ব সামলেছেন, আশি বছর পার করা সেই প্রবীণ ও জ্ঞানবৃদ্ধকে তুলনায় অনেক, অনেক নবীনদের কাছে এখন শিখতে হবে কোথায় তাঁর যাওয়া উচিৎ? নাকি তাঁদের এই পরামর্শ দেওয়া শোভন?
নাগপুরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বক্তৃতার পরেই বলা হয়েছে, আরএসএসের সদর দপ্তরে গিয়ে তাদেরই নীতি-শিক্ষা দিয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। সত্যিই কি তাই? বিচক্ষণ ও বিদগ্ধ প্রণব মুখোপাধ্যায় সবচেয়ে ভালো জানেন, কোন মঞ্চে কী বলতে হয়। তিনি সেই কাজই করেছেন। কোথাও মাত্রা ছাড়িয়ে যাননি। জাতি কাকে বলে, তার আভিধানিক অর্থ কী, সে কথাই বলেছেন, তার মধ্যে কেউ গূঢ় কোনও অর্থ পেয়ে থাকতে পারেন। আমাদের শিকড়ের সন্ধান তিনি করেছেন ইতিহাসের পাতায়।
নাগপুরে শরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের সঙ্গে আলোচনারত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়
ইতিহাসের পাতা থেকে ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির কথা বলেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, এই চুক্তির ফলে রাজা স্থির করে নিয়েছিলেন তাঁর রাজ্যের ধর্ম এবং কোনও দেশ আবার ঔদার্যও দেখিয়েছিল অন্য দেশের প্রতি। এক কথায় এক দেশ-এক জাতি-এক ধর্মের যে তত্ত্ব, ভারতের ইতিহাস সে কথা বলে না। সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করে প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, বসুধৈব কুটুম্বকম এবং সর্বে ভবন্তু সুখীনঃ সর্বে ভবন্তু নিরাময়ঃ। সহিষ্ণুতার যে পাঠ প্রণব মুখোপাধ্যায় দিয়েছেন, তাঁর বক্তৃতা শুনলেই বোঝা যায়, সেখানে কোথাও কোনও বার্তা বা খোঁচা নেই। কংগ্রেস ইতিহাসের প্রেক্ষিত ১৮৮৫ সাল থেকে নয়, ১৮৯৫ সালে পুনে কংগ্রেস, যার সভাপতি ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই সময় থেকে তুলে এনেছেন। উল্লেখ করেছেন বালগঙ্গাধর তিলক ও সর্দার প্যাটেলের কথা। এই দুই নামে যে আলাদা তাৎপর্য আছে, এবং সেই তাৎপর্য আরও বেড়ে যায় নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তরে, সে কথাও উল্লেখ্য। তাই নাগপুরে আরএসএস-কে বার্তা দেওয়ার ধারণা কতটা ঠিক, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থাকে।
কোথাও কোনও জাতি-বিদ্বেষ এবং জাতি-দাঙ্গার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন মোহন ভাগবত
প্রণব মুখোপাধ্যায় কী বলছেন, সে কথা কেউ বলবে না, উল্টে আরএসএস সদর দপ্তরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছবিটাই থেকে যাবে। কিন্তু তাতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লাভ হবে নাকি ক্ষতি হবে সে কথা বলা মুশকিল। অর্ধশতক সক্রিয় রাজনীতি করা ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলানো প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেশ-বিদেশের হাজারখানেক শীর্ষনেতার ছবি রয়েছে। এমন দেশ খুঁজে বার করতে হবে যেখানে তিনি যাননি। তাই তিনি নাগপুরে গেলে মহাভারত কতটা অশুদ্ধ হবে?
তবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাগপুরে যাওয়ার পিছনে আরেকটি মনোস্কামনাও থাকতে পারে, তা হল একবারের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব। যদি কোনও কারণে ভোটের ফল এমন হয় যেখানে এনডিএ ক্ষমতায় ফিরলেও নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে শরিক দলগুলি আপত্তি করে, তা হলে কি প্রণব মুখোপাধ্যায়ক ওই পদের জন্য মনোনীত করতে পারে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার? একটা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। প্রণব মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে তাদের মূল্যায়ন হল, 'তিনি সেই প্রধানমন্ত্রী দেশ যাঁকে পায়নি কংগ্রেসের জন্য।'
প্রণব মুখোপাধ্যায় যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধা নেই। যদিও দেশে এমন উদাহরণও নেই। তবে রাজ্যপালকে তুলে এনে মন্ত্রী করে দেওয়ার উদাহরণ কংগ্রেসে আছে। রাজ্যপালও রাষ্ট্রপতির মতোই নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক পদ।