ফৈজাবাদের নাম হল অযোধ্যা: আমরা কেন অবাক হইনি
অযোধ্যার প্রথম সাদাত আলি খান ফৈজাবাদ পত্তন করেছিলেন, তবে নাম পরিবর্তন করেননি
- Total Shares
দীপাবলির একদিন আগে, অর্থাৎ ৬ নভেম্বর, ফৈজাবাদের নাম পরিবর্তন করে অযোধ্যা রাখার কথা ঘোষণা করেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। যোগীর এই ঘোষণায় স্বভাবতই কেউই অবাক হয়নি। এ রকম কিছুএকটা আমরা আশা করেছিলাম। মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগেই এলাহাবাদের নাম প্রয়াগ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। হাজার হোক, শহর বা অঞ্চলরে নাম পরিবর্তন সর্বদাই গেরুয়া বসনধারী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সিংহভাগটাই তো প্রতীকী ও ধর্মীয় মেরুকরণের উপর নির্ভরশীল।
যোগী আদিত্যনাথের রাজনীতি একেবারে প্রতীকী [ছবি: রয়টার্স]
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেও যোগী আদিত্যনাথ তাঁর রাজনৈতিক দুর্গ গোরক্ষপুরের বিভিন্ন এলাকার নাম পরিবর্তনের জন্য পরিচিত হয়ে উঠে ছিলেন। গোরক্ষপুর শহর থেকে একটা সময় সাংসদ হয়েছিলেন যোগী। একাদশ শতাব্দীর ধর্মগুরু গোরক্ষনাথের নামে শহরটির নামকরণ। আর, সেই গোরক্ষনাথ মন্দিরের অছি পরিষদের প্রধান এখনও স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। সাংসদ থাকার সময় যোগী শহরের মিঞা বাজার এলাকার নাম পরিবর্তন করে মায়াবাজার রেখেছিলেন আর হুমায়ুনপুরের নাম পরিবর্তন করে হনুমানপুর রেখেছিলেন।
এই নাম পরিবর্তনের ফলে কার কী লাভ হয়েছিল তা এখনও কোটি টাকার প্রশ্ন। ইতিহাস অবশ্য অন্য কথা বলছে। আমরা যতই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জন্য মধ্যযুগীয় শাসকদের একাংশকে দুষি না কেন, একবিংশ শতকের শাসকরাও তাঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম যান না।
এবার কিন্তু আপনি আমাদের অবাক করতে পারলেন না [ছবি: রয়টার্স]
গবেষকরা বলছেন যে প্রাচীনকাল থেকেই প্রয়াগ ও অযোধ্যা নামটি রয়েছে এবং ইতিহাসের কোনও শাসকই এই দুই জায়গার নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করেননি।
ষোড়শ শতাব্দীতে মোগল সম্রাট আকবর ইল্লাহবাসের (ঈশ্বরের আলোয়) পত্তন করেন। পরবর্তীকালে, ইংরেজ আমলে নামটি ইংরেজিকরণ হয়ে এলাহাবাদ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আকবরও কোনও দিনও প্রয়াগের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করেননি। এই প্রয়াগ শহরটি গঙ্গা যমুনা ও কল্পিত সরস্বতী নদীর সঙ্গমের তীরে অবস্থিত।
অযোধ্যার নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা কোনও শাসকই করেননি [ছবি: রয়টার্স]
একই ভাবে অযোধ্যার প্রথম নবাব সাদাত আলী খান ১৭৩০ সালে ঘর্ঘরা নদীর উপকূলে ফৈজাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিনিও কোনও দিনও রামচন্দ্রের জন্মস্থান হিসাবে পরিচিত অযোধ্যার নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করেননি। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরা যখন ফৈজাবাদে জেলা তৈরি করেছিল তখন প্রাচীন মন্দিরটি সেই জেলায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
হিন্দুদের অন্যতম প্রিয় তীর্থস্থান এই অযোধ্যা এবং এখানকার সমস্ত অর্থনীতিই ধর্মীয় পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। ঐতিহাসিক নথিপত্র ঘেঁটে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় - অযোধ্যার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির হনুমান গড়ির রক্ষণাবেক্ষণার জন্য অর্থ আসত নবাবের রাজকোষ থেকে। ১৭৭৫ সালে সাদাতের নাতি আসফ উদ-দৌল্লা ক্ষমতা দখলের পরেই তিনি অযোধ্যার রাজধানী ফৈজাবাদ থেকে লখনউতে স্থানান্তরিত করেন। কিন্তু এর পরেও নবাবের কোষাগার থেকেই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ আসত। ফৈজাবাদ শব্দটির মানে 'সকলের মঙ্গল হোক'।
অযোধ্যাকে আলাদা জেলা করা হল না কেন? [সৌজন্য: গুগুল ম্যাপ]
এর থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে এই দুই শাসক ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁদের ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁরা স্থানীয় হিন্দু ধর্মের মানুষদের ভালো-মন্দের বিষয় সজাগ ছিলেন। চাইলে এই মুসলমান শাসকরা দুটি প্রাচীন শহরের নাম পরিবর্তন করে দিতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করে শহর সংলগ্ন এলাকায় নতুন দু'টি শহর পত্তন করেছিলেন।
উল্টোদিকে, উত্তরপ্রদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এলাহাবাদের ও ফৈজাবাদের নাম পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন এবং তা করতে গিয়ে কারুর আবেগের কথা তাঁর মাথায় এলো না। অনেকেই আবার মনে করছেন যে এই সিদ্ধান্ত ইচ্ছাকৃত ভাবে একটি বিশেষ ধর্মালম্বী মানুষের আবেগকে আঘাত করার জন্যই নেওয়া হয়েছে। যদিও উত্তরপ্রদেশ সরকারেরও স্লোগান হচ্ছে - "সব কা সাথ, সব কে বিকাশ।"
হনুমান গড়ি যার রক্ষণাবেক্ষণার অর্থ আসত নবাবের কোষাগার থেকে [ছবি: উত্তরপ্রদেশ পর্যটন]
যদি ধরে নেওয়া যায় যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভেবেই এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত তা হলে পাল্টা প্রশ্ন উঠছে, কেন সীমানাবর্তী জেলাগুলো থেকে কিছুটা অংশ কেটে প্রয়াগ ও অযোধ্যাকে আলাদা জেলা করা হল না?
এই ভাবেই তো আমাদের দেশের জেলাগুলো সাধারণ ভাবে তৈরি হয়ে থাকে।
এই পথে চললে অযোধ্যা ও প্রয়াগের নামের গৌরব বজায় থাকত আবার এলাহাবাদ ও ফৈজাবাদের মতো দু'টি ঐতিহাসিক নামকে মুছে ফেলতে হত না।
এই পন্থা অবলম্বন করলে করদাতাদের যে পয়সা এখন নাম পরিবর্তনের জন্য গচ্চা যাবে তাও সাশ্রয় করা যেত।
এখানে উল্লেখ্য, একটা সময় বিজেপি নেতারাই অখিলেশ যাদবকে কটাক্ষ করেছিলেন যখন তিনি তাঁর পূর্বসূরি মায়াবতীর তৈরি করা জেলাগুলোর নাম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মায়াবতী নিজের আমলে তৈরি হওয়ার জেলাগুলোর নামকরণ দলিত নেতাদের নামে করেছিলেন।
যাঁরা রামমন্দিরের ভবিষ্যৎ নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁরা কিন্তু যোগীর এই নাম পরিবর্তন নিয়ে একবারেই অবাক হননি। কিছুদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে দীপাবলির দিন অযোধ্যা নিয়ে সুখবর শোনাবেন তিনি।
যাঁরা রামমন্দির-বাবরি মসজিদ চত্বরে রামমন্দির হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তাঁদের দুধের স্বাদ কোনও মতেই ঘোলে মেটানো যাবে না। এমনকি তাঁরা অযোধ্যার রামকথা ময়দানে রামচন্দ্রের বিশাল মূর্তি নির্মাণ করেও তাঁদের খুশি রাখা যাবে না।
এর ফাঁকে যদি এই নাম পরিবর্তন কিছুটা হলেও বিজেপির ভোটব্যাঙ্ককে খুশি রাখতে পারে সে দিকেই এখন দলের নজর। এতে যদি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায় তাতে কিছুই যায় আসে না।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে