ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো কেন দারিদ্র্য-প্রেমে বুঁদ হয়ে রয়েছে?
নরেন্দ্র মোদীও পাঁচ বছর ধরে কংগ্রেসের বস্তাপচা রীতি মেনে চলেছেন যা বর্তমানে অচল
- Total Shares
সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা যে ভাবে ঢালাও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন তার থেকে একটা বিষয়ে পরিষ্কার - আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের পরে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন দেশের অর্থনীতির কোনও পরিবর্তন ঘটবে না।
এর মানে এই নয় যে দেশের অর্থনীতি একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক মহল যতই চেষ্টা করুক না কেন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা তা কোনও মতেই হতে দেবে না। রাজনীতিকরা চেষ্টা করবেন যাতে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেওয়া যায়। কিন্ত প্রাকৃতিক কারণেই দেশের অর্থনীতি টিকে থাকবে।
কিন্তু কেউ যদি স্বপ্ন দেখে থাকেন যে ভারতের প্রভূত উন্নতি ঘটবে তা হলে তিনি কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হবেন।
কর্মসংস্থানের কোনও প্রচেষ্টা নেই, শুধুই প্রতিশ্রুতি রয়েছে [ছবি: রয়টার্স]
লোকসভা ভোটের প্রার্থী নরেন্দ্র মোদী যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, গেরুয়া সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই প্রতিশ্রুতিগুলো রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টে, 'স্যুট বুট কি সরকারের' তকমা পাওয়া মোদী সরকার তাদের প্রকল্পগুলোকে এমন ভাবে রূপায়িত করেছে তাতে দেশের ব্যবসায়ীরা নিদারুণ ভেঙে পড়েছেন।
তার মানে এই নয় যে মোদী সরকারের প্রকল্পই সফল হয়নি। জিএসটির মতো প্রকল্প তো সফল ভাবেই রূপায়িত করা হয়েছিল। শ্রমিক সংক্রান্ত কিছু প্রকল্পও বেশ লাভজনক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলো 'সুবিধাবাদী' প্রশাসনিক কর্তাদের উপর এতটাই নির্ভরশীল যে সুষ্ঠু ব্যবসার ক্ষেত্রে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে।
'মেক ইন ইন্ডিয়া' প্রকল্পটি বেশ আকর্ষণীয় বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু যেখানে ভারতে একটি কারখানা গড়ে তোলা মানেই দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়া, সেখানে কেন কেউ মেক ই ইন্ডিয়া প্রকল্পের চাপ নিতে যাবে?
মোদী সরকার এখন 'স্যুট বুট কি সরকার' বলে প্রসিদ্ধ [ছবি: রয়টার্স]
এ দেশে বসে কিছু উৎপাদন করার চেয়ে চিন থেকে আমদানি করা অনেক বেশি সহজ ও সস্তা।
কোনও ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন - গত সাড়ে চার বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর হুজ্জতি কমেছে কি না? একটাই উত্তর আসবে - পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি।
আইন মেনে ব্যবসা করলেও তাদের মোটা টাকা 'দান' করতে হয়ে তাদেরকে 'অত্যাচারের' শিকার হতে হয়। এর পরেও আইনের বেড়াজালের মধ্যে থেকে সবরকম চেষ্টা করে সফল হন তাহলে তাঁদের 'অপরাধী' বানিয়ে দেওয়া হয়। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা, প্রতিটি আমলা এমনকি 'দু-মুখো' ইন্সপেক্টররা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু না কিছু আদায় করে ছাড়বেই। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তাদের পাশে দাঁড়াবে না।
ভারতের যে কোনও ব্যবসায়ীকেই ভারতরত্নের সত্যিকারের দাবিদার বলা যেতে পারে -- এত ঝুটঝামেলার মাঝেও তারা কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পায়। অন্তত তাদের মাথা জলের উপরে থাকে। একজন ব্যবসায়ী দৈনন্দিন জীবনে যে ঝামেলার মধ্যে দিয়ে চলে তার কোনও পরিবর্তন কিন্তু মোদীর জমানায় হয়নি। এ দেশের ব্যবসায়ীরা এবং উৎপাদনকারীরা অনেকটা মহাভারতের কামধেনুর মতো - যে গরুর কাছে যত দুধ চাওয়া যাবে তত দুধ পাওয়া যাবে। এই অর্থনীতিতে শিল্পের থেকেও বেশি 'দালালরা' উপকৃত হয়। এই অর্থনীতির থেকে উপদ্রবকারীরা বেশি উপকৃত হয়, দিন রাত মেহনত করে যারা উৎপাদন করেছে তারা নয়।
রাজনৈতিক নেতারা অবশ্য একটা ধ্রুব সত্য কথা বোঝেন না - কর্মসংস্থানের যে প্রতিশ্রুতি তারা করে থাকে তা শুধু মাত্র ব্যবসা বৃদ্ধি করতে পারলেই ও ব্যাবসায়ীদের সুবিধা দিতে পারলেই সম্ভব। শুধুমাত্র ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, এ কথা বড় বড় ব্যাবসায়ী সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কিন্তু আপনি যদি সমাজের উৎপাদনকারী মানুষের কাজ ব্যাহত করার চেষ্টা করেন এবং তাদের উপর অত্যাচার করেন, তাহলে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে সংরক্ষণ কিংবা কোটা ব্যবস্থা চালু করে ভোটারদের মন জয় করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের তো কামধেনু বলে মনে করা হয় [ছবি: রয়টার্স]
সমস্যাটা হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সে চেষ্টাও করেননি। এই প্রকল্পকে আরও বেশি করে কার্যকর না করে প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন যে কংগ্রেসের আমলে তৈরি হওয়া এই প্রকল্পটি আদতে বিশৃঙ্খল অর্থনীতির প্রতীক। এই মনোভাব পোষণ করায় সরকার আরও বেশি করে ব্যর্থতার শিকার হয়েছে।
মোদী সরকারের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা আরও একটি কারণে প্রকট হয়ে পড়েছে। ভোট জয়ের জন্য আর উন্নয়নমূলক প্রকল্প, কর্মসংস্থান কিংবা কৃষক ও শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য কী কী করা হয়েছে তার উপর আর নির্ভর করছে না সরকার। বরঞ্চ সরকার এখন জাত ধর্ম ভেদাভেদের রাজনীতির উপরই বেশি ভরসা করছে। দলের তরফ থেকে 'বিকাশ' নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে শুধু প্রচার চলছে যে তাদের আমলে অর্থনীতি সাত শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি বাড়ছে তা কেউই বিশ্বাস করতে নারাজ। প্রায় সমস্ত ব্যবসায়ী এখন অখুশি।
কৃষি ও শিল্পে এত কিছু বরাদ্দ করার পরেই কৃষকদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসেনি। স্বাধীনতার পর শেষ ৭০বছর ধরেই প্রতিটি সরকারই কৃষকদের প্রতি তাদের ভালোবাসার 'গল্প' শুনিয়ে এসেছে।
তা সত্ত্বেও শেষ সাতটি দশকে কৃষকদের জীবন আরও খারাপ হয়েছে। দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানের অভাব এবং যথাযথ সুযোগের অভাবে অভাবে তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরোনো পন্থা আর কাজে দিচ্ছে না কিন্তু প্রতিটি সরকার সেই পুরোনো পন্থাই আঁকড়ে থেকে মনে করছে যে এবার একটি পরিবর্তন আসবেই। কিন্তু তা কোনও দিনও সম্ভব নয় এবং যাঁরা নীতি ঠিক করে দেন তাঁদের গ্রামীণ জীবনের উন্নতিসাধনের জন্য নতুন চিন্তাভাবনা করতে হবে। ঋণ মকুব করে বা কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা যে সম্ভব হবে না তা এখন জলের মতো পরিষ্কার।
আমাদের দুর্ভাগ্য শুধুমাত্র শাসক এনডিএই দারিদ্র্যের প্রেমে বুঁদ হয়ে আছে এমনটা নয়। বিরোধী ইউপিএর অবস্থাও তথৈবচ। দেশের ভক্তদের সংখ্যা এতটা বেশি যে তারা অর্থনীতির থেকেও নেতা নেত্রীদের সিদ্ধান্তকে 'ঠিক' বলে প্রতিপন্ন করতে বেশি মত্ত থাকে।
এত প্রকল্পের পরেও ভারতীয় কৃষকদের দুর্দশার অন্ত নেই কেন? [ছবি: রয়টার্স]
হার্ভার্ড থেকে পাস করা কিংবা হিন্দুত্ব স্কুলের অর্থনীতির ছাত্র উভয়ই স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের সদস্য যাঁদের অর্থনৈতিক বিদ্যাবুদ্ধি এখনও ১৮ শতকে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কোনও একটি প্রকল্প যতই অবাস্তবে হোক না কেন, তাকেই তাঁরা আঁকড়ে ধরে থাকবেন, কারণ তাঁদের নেতানেত্রীরা এই প্রকল্প রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তাই তো যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন ভারতীয় অর্থনীতিতে তার কোনও প্রভাব পড়বে না।
এমন একটি দেশে এই কাণ্ডটি ঘটছে যে দেশ একদা বেশ ধনী এবং সম্পদশালী ছিল। বিষয়টি নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতাকে এই কথাটি বোঝানো মানে অপাত্রে সময়ে ব্যয় করা। ২০১৪ লোকসভা মোদী জিতেছিলেন কারণ তিনি কোনও দান খয়রাতের প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি ব্যবস্থা পাল্টানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং এই নয়া ব্যবস্থা মানুষের উৎপাদক শক্তি বৃদ্ধি করবে বলে জানানো হয়েছিল।
কিন্তু পাঁচ বছর বাদে দেখা গেল তিনিও কংগ্রেসের সেই জরাজীর্ণ দশক প্রাচীন প্রেসক্রিপশন মেনে চলেছেন। আর, তা দিয়ে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। তাঁর বিরোধীরা অবশ্য চাঁদ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সিয়ে চলেছে। কিন্তু তা কী ভাবে সম্ভব সে কথা মুখ ফুটে বলছে না।
এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা শুধুমাত্র একটি পন্থাতেই সম্ভব সোনার ডিম পাড়া হাঁসগুলোকে বধ করে চল কিংবা কামধেনুকে জবাই করে চল। আসুন আগামী জুন মাসে আরও একদফা অর্থনীতির শিরশ্ছেদ দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে