বিমুদ্রাকরণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ক্ষমা চাওয়ার এটাই আদর্শ সময় কেন
এই পদক্ষেপে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েvন কৃষক, দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
- Total Shares
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণের কথা ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জাতির উদ্দেশে তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা-সমৃদ্ধ সেই বক্তৃতায় যে সব রাজনীতিক দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন মোদী, কারণ দুর্নীতির জন্যই দেশে বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এবং ক্ষতি হচ্ছে কর্মসংস্থানের।
মজার কথা হল এই তালিকায় ছিলেন ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও দীনদয়াল উপাধ্যায় এবং বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণী।
প্রধানমন্ত্রী তাঁদের নাম করেননি বটে তবে তাঁরাও সেই সব বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যেই পড়েন যাঁরা মোদীর পূর্বসূরী।
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে একযোগে ১০০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট বাতিল করেন মোদী যার ফলে বাস্তবে দেশের মোট মুদ্রার ৮৬ শতাংশই মূল্যহীন হয়ে যায়, যার ফলে নোটের আকাল দেখা দেয়।
এক মাস ধরে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও এটিএমের সামনে ছিল বিশাল সর্পিল লাইন।
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দাবি, “দু-বছর আগে ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলে সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করেছে, নগদ লেনদেন কমিয়েছে এবং এর ফলে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে।”
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মনে করেন বিমুদ্রাকরণ দেশের অর্থনীতিকে সুসংবদ্ধ করেছে (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
এটা একেবারেই নেওয়া যাচ্ছে না।
মোদী সরকারপ্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে বেশি অঙ্কের নোট বাতিল করলে যাদের কাছে কালোটাকা আছে তাদের উপরে কোপ পড়বে এবং সন্ত্রাসবাদীরা তাদের জঙ্গি কার্যকলাপ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পাবে না।
এর অনেক আগে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন যে তাঁকে ভোট দিয়ে জয়ী করে ক্ষমতায় আনলে বিদেশে থাকা কালো টাকা তিনি উদ্ধার করবেন এবং প্রতিটি ভারতীয়র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা হবে।
এর কিছুই অবশ্য হয়নি। মোদী কেন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারলেন না, সে ব্যাপারেও কোনও ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সঙ্ঘ পরিবার মনে করছে যে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি কখনও দেওয়াই হয়নি।
অর্থমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে অরুণ জেটলিকে অবশ্য কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে।
৫০০ টাকা ও ১০০০ চাকার নোট বাতিল করা ও তার পরে ২০০০ চাকার নোট চালু করে সরকার কী ভাবে অর্থনীতিকে সুসংহত করেছে?
২০০০ টাকার মতো বড় অঙ্কের নোট মুদ্রণের সম্ভাব্য অর্থ হল আরও বেশি অঙ্কের নগদ লেনদেন ঘটানো। এর ফল হল আরও বেশি কালো টাকা তৈরি করা, কালোটাকা নিয়ন্ত্রণ করা নয়।
জেটলি এ কথাও বলেছেন যে, “টাকা বাজেয়াপ্ত করার কোনও উদ্দেশ্যই সরকারের ছিল না।”
যখন থেকে ব্যাঙ্কে ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যের নোট জমা হতে শুরু করল তখন থেকেই সমপরিমাণ অঙ্কের মুদ্রাও নিজেদের কাছে জমানোও শুরু হয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দূরদর্শনে জাতির উদ্দেশে ৮ নভেম্বর বক্তৃতায় নোট বাতিলের যে কারণ বলেছিলেন, তার চার ঘণ্টার মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কেন্দ্রীয় বোর্ড নোট বাতিলের দুটি প্রধান কারণকে খারিজ করে দেয় – কালোটাকা ও জালমুদ্রা হ্রাস করা।
পরবর্তী ঘটনাবলি দিয়েও সরকারের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করা যাচ্ছে না। ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ সালে দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭.২শতাংশ ও ৮.১ শতাংশ যা ইউপিএ সরকারের আমলের শেষ দু’বছরের ৫.৪ শতাংশ ও ৬.১ শতাংশের চেয়ে অনেকটাই বেশি। তবে বিমুদ্রাকরণের পরের দু’টি অর্থবর্ষে এই হার ছিল ৭.১ শতাংশ ও ৬.৫ শতাংশ।
তবে যেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল কৃষক, দিনমজুর ও অসংগঠিত উদ্যোগ – যাঁরা মূলত নগদ লেনদেনের উপরে নির্ভরশীল তাঁরা যে শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়েন সেই অবস্থা এড়ানো যেত। বিপুল পরিমাণ কালোটাকার উপরে কোপ পড়ার যে কথা বলা হয়েছিল তাও ব্যর্থ হয়েছে। যে চার থেকে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা উদ্ধারের কথা বলা হয়েছিল, দেখা গেল তা স্রেফ রাজনৈতিক ভাঁওতা। মজার কথা হল এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত প্যাটেলের থেকে জোর করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সংরক্ষিত আমানত থেকে ৩ লক্ষ কোটি টাকা দেওয়ার জন্য জোর করছে মোদী সরকার।
বিমুদ্রাকরণের ফলে দেশের গরিব ও মধ্যবিত্তরা ভীষণ সমস্যায় পড়েন (ছবি: রয়টার্স)
জনপ্রিয় স্বাধীনচেতা অর্থনীতিবিদ মেনার্ড কেইনস ১৯১৯ সালে লিখেছিলেন, সমাজের স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য অন্য কোনও চতুর বা কোনও কষ্টকর পদক্ষেপ করার দরকার নেই, টাকাপয়সা নষ্ট করে দিলেই হবে।”
যখন বিমুদ্রাকরণের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে গেল তখন দেখা গেল যে সেই পরিকল্পনাটি ছিল অতিশয় কাঁচা, অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে সেই প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে অভ্যন্তরীণ কোনও আলাপ-আলোচনাও হয়নি।
এই ঘটনার পরে সাফল্যের যে সব দাবি করা হয়েছে তা দেশ ও বিদেশের বেশিরভাগ অর্থনীতিকই খারিজ করে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শ্লথ করার এ এক অনাবশ্যক পদক্ষেপ। বহু গরিব ও মধ্যবিত্তকে এর ফল ভুগতে হয়েছে।
এটাই কি বিমুদ্রাকরণের মূল্য?
বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদই হয়তো বলবেন – না। তাঁরা সকলেই হয়তো বলবেন যে তাড়াহুড়ো করে নেওয়া এই সিদ্ধান্তের মূল্য বড্ড বেশিই চোকাতে হল।
প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে সমালোচনার ঝড় উঠলেও এখনও বিজিপর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়নি।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে