৬ ডিসেম্বর: রামমন্দির নাটকের কুশীলবরা এবং বাজপেয়ীর দ্বৈতরূপ

অযোধ্যা নিয়ে যখন বিজেপি নেতারা তৎপর তখন বাজপেয়ী নেপথ্যেও ছিলেন এবং সুবিধাও নিয়েছেন

 |  5-minute read |   08-12-2018
  • Total Shares

প্রায় তিরিশ বছর আগে, ১৯৮৯ সালে বিজেপি হিমাচলপ্রদেশের পালামপুরে বিজেপি একটি সংকল্প গ্রহণ করেছিল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যে রামমন্দির নিয়ে বিক্ষোভ করছে তাতে যোগ দেওয়ার ইঙ্গিত মিলেছিল সেই সংকল্পেই।

সকলের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেছে তাতে অটলবিহারী বাজপেয়ী এ ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না, তবে তিনি দলের সেই লাইনের বিরোধিতাও করেননি।

vajpayee-advani_1206_120818082329.jpgএকজন নেতা অযোধ্যা নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন, তবে অন্যজন ততটা ছিলেন না। (ছবি: রয়টার্স)

বহু বছর আগে সেই উমা ভারতী, যিনি মন্দির নিয়ে আন্দোলনের অন্যতম উজ্জ্বল মুখ ছিলেন, তিনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন: “বাজপেয়ী-সহ সকলেই চান যে অযোধ্যায় রামলালার মন্দির হোক। তবে আমরা সকলেই জানতাম যে অটলজি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব তো দেবেনই না, এই আন্দোলনে যোগও দেবেন না।” দলে অন্য একজন নেতা আমাকে বলেছিলেন যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলকে নিয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীর কোনও আগ্রহই ছিল না এবং আমাদের অনেককেই তিনি বলেছিলেন যে, কোনও রাজনৈতিক দল এ সবের অঙ্গ হতে পারে না।

তখন বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) মধ্যে সমন্বয়কারী হিসাবে ছিলেন গোবিন্দাচার্য – তিনি ছিলেন দলের আদর্শ নিরুপণকারী এবং নীতি নির্ধারণকারী। তিনি আমাকে লালকৃষ্ণ আডবাণীর সোমনাথ-ও-অযোধ্যা রথযাত্রা নিয়ে একটি আকর্ষণীয় তথ্য দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর অযোধ্যায় যে রথযাত্রা পৌঁছাবে, আরএসএস চেয়েছিল তাতে চার জন নেতৃত্ব দিন।

সেই চারজনকেই প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন গোবিন্দাচার্য। তিনি প্রয়াত বিজয়া রাজে সিন্ধিয়াকে, অর্থাৎ রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের মা এবং মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য আশবাদী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার ঠাকুমাকে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন অসমের কামাক্ষ্যা মন্দির থেকে রথ নিয়ে অযোধ্যা যাওয়ার জন্য। উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে তাঁর শরীর এই ধকল সইতে পারবে না। প্রয়াত সিকন্দর বখত, একসময় বিজেপির মুসলমান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ, তাঁকে বলা হয়েছিল মুম্বই থেকে রথযাত্রা করতে, তিনি বলেছিলেন যে কেউই তাঁর কথা শুনতে আসবে না। বাজপেয়ীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে জম্মু থেকে অযোধ্যায় যেতে। উল্টে তিনিই গোবিন্দাচার্যের মুখের উপর বলে দেন যে, “এটা কী ধরনের নৌটঙ্কি (নাটকবাজি)? ম্যায় অ্যায়সি নৌটঙ্কি পে নহিঁ জাতা (আমি এই ধরনের নিম্নরুচির কোনও নাটকবাজির মধ্যে নেই)।”

আডবাণীকে বলা হয়েছিল কন্যাকুমারী থেকে রথযাত্রা করতে। কিন্তু আডবাণী প্রস্তাব দিলেন, সোমনাথ থেকে রথযাত্রা করলে তা “অনেক বেশি রাজনৈতিক” হবে।

ramrathyatra_1206181_120818082416.jpgঅযোধ্যা আন্দোলনকে আরও জাগিয়ে তুলল এই রথযাত্রা (ছবি: টুইটার/ ইন্ডিয়াহিস্ট্রিপিক)

১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সেই যাত্রা শুরু হল।

বাজপেয়ীর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তথা আইনজীবী আপা ঘাটাতে, যিনি সংসদে অসংখ্য বক্তৃতা করেছেন চিরকালই বলে এসেছেন যে এই আন্দোলন নিয়ে বাজপেয়ী চিরকালই অস্বস্তিতে ছিলেন। আডবাণীর রথ যখন দিল্লির উপর দিয়ে যাচ্ছে তখন তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বাজপেয়ী কী বলেছিলেন সে কথা তিনি আমাকে বলেন: সেই ‘জনতা’ এই বলে চিৎকার করছে, ‘আডবাণীজি সংঘর্ষ করো হাম তুমহারে সাথ হ্যায় (আদবাণী আপনি আন্দোলন করে যান, আমরা আপনার সঙ্গে আছি)।’ দেখে মনে হচ্ছিল অটলজি কিছুটা বিরক্ত এবং তিনি বললেন যে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অযোধ্যায় যাচ্ছেন না আডবাণী, তিনি ব্রত পালন করতে যাচ্ছেন। বানরসেনা তাঁকে অনুসরণ করবে।

বাজপেয়ীর সারকথাটি ছিল: “এমনও হয় যে বানর সেনা জানেই না যে রাম কোথায় যাচ্ছেন।”

babri_647_0322170628_120818082644.jpgব্যক্তি হিসাবে কোনও দিনই কোনও নৃশংসতা পছন্দ করেননি বাজপেয়ী (।ছবি: ইন্ডিয়াটুডে)

বহু বছর বাদে যখন সেই মসজিদ ধ্বংস করা হল এবং ঘোষণা করা হল যে মন্দির অন্য কোথাও নয়, এখানেই গড়া হবে তখন এই সাংবাদিক নিজে সাক্ষী থেকেছে একটি ঘটনার –  “জয় শ্রীরাম ধ্বনির মধ্যে অতি-উত্তেজিত দলীয় কর্মীদের সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলছেন বাজপেয়ী।”

বাজপেয়ী তাঁর গাড়ি থেকে নেমে এলেন এবং বললেন, “বলতে রহো জয় শ্রীরাম ঔর করো নহিঁ কোই কাম (জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে থাকো, কোনও কাজকর্ম কর না)।”

একটা সময়ে আন্দোলনের সব নান্দনিকতা ভেঙে পড়ল – করসেবকদের গলাফাটিয়ে চিৎকার করা রক্তাক্ত পথের আবেদনে কোনও দিনই সাড়া দেননি বাজপেয়ী। আডবাণীর রথযাত্রা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরে, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জয়পুরে দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে বাজপেয়ী কিছুটা প্রতিবাদই করলেন। বাজপেয়ী স্পষ্ট ভাবেই নাকি জানতে চেয়েছিলেন, “এটা কি কোনও রাজনৈতিক দল নাকি কোনও ধর্ম সংসদ?”

তবে কয়েক মাস পরে ১৯৯১ সালে লোকসভা নির্বাচনের জন্য যখন প্রস্ততি শুরু হচ্ছে তখন বাজপেয়ীর নিজের অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছিল। আপাত ভাবে মনে হয়েছিল হিন্দুদের হৃদয়ভূমে রাম মন্দিরের তরঙ্গ উঠেছে (ঘটনাচক্রে তখন জাতীয় স্তরে বিজেপির উত্থান শুরু হয়েছে এবং কল্যাণ সিং তার পরে ১২০টি আসন নিয়ে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসেন)। বাজপেয়ীও রামমন্দিরের পক্ষে বক্তৃতা শুরু করেন এবং তিনি দেখেন যে তাতে জনতার সাড়াও পাচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশ যখন মোড় নিচ্ছে তখন বাজপেয়ীও রামমন্দিরের পক্ষে বলতে শুরু করেছেন এবং তার আদর্শগত দিকের কথা বলে সেই দাবিকে আরও ধারালো করতে শুরু করে।

চিরকালই গোবিন্দাচার্যর সঙ্গে বাজপেয়ীর সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল, সেই গোবিন্দাচার্য আমাকে বলেছিলেন, “কোনও ব্যাপার মন থেকে বিশ্বাস না করলেও তা নিয়ে সুষ্পষ্ট ভাবে বক্তৃতা করা ছিল বাজপেয়ীজির বিশেষত্ব।”

বাজপেয়ীর এই সাড়ম্বর বক্তৃতা তিনি পছন্দ করতেন।

“আডবাণী হয়তো রামমন্দির নিয়ে বক্তৃতা করতে পুরো ভারত চষে ফেলেছেন। তবে রামমন্দিরের প্রেক্ষিতে হিন্দুত্ব নিয়ে নিয়ে, হয়তো মানব সভ্যতা নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর বক্তৃতাটি করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, ১৯৯১ সালের ৪ এপ্রিল, দিল্লির বোট ক্লাবে।”

তার সঙ্গে মেলানো যায় ৫ ডিসেম্বর লখনউয়ে করা তাঁর বক্তৃতা, সেই মসজিদ ধ্বংস করার ঠিক আগের দিন, এবং বাজপেয়ী মন্দির-রাজনীতি করেননি। যেদিন মসজিদ ভাঙা হল তার আগের রাতে লখনউতে করসেবকদের উদ্দেশে বাজপেয়ী বক্তৃতা করেছিলেন, দিল্লিতে তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধু-সন্তদের সঙ্গে এক মঞ্চে ছিলেন।

vajpayee-fast_120618_120818082715.jpgরাজনীতিক বাজপেয়ীর নাটকীয়তার মধ্যে গেরুয়ার অনেকগুলো স্তর ছিল (ছবি: রয়টার্স)

জনান্তিকে অবশ্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলকে বানর সেনা বলে ডাকতেন বাজপেয়ী!

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আমি আউটলুক পত্রিকায় কর্মরত, তখন তাদের হিন্দি প্রকাশনার জন্য বাবরি ধ্বংসের আগের রাতের বক্তৃতার প্রয়োজন হয়েছিল। সেই বক্তৃতা ছিল অত্যন্ত লঘু ও লোক ক্ষেপানোর পক্ষে যথেষ্ট, যা তাঁর মতো নরমপন্থী ভাবমূর্তির কোনও ব্যক্তির নিরিখে একেবারেই বেমানান। সেই টেপ এবং তার লিখিত রূপ তাঁর কাছে এবং আমাদের সম্পাদক, দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিনোদ মেহতার কাছে পাঠানো হয়েছিল এবং তিনি আমাকে বলেছিলেন, হিন্দি প্রকাশনার সম্পাদককে নিয়ে বাজপেয়ীর সঙ্গে দেখা করতে।

সন্ধ্যারাতের দিকে আমরা আধঘণ্টার জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বাজপেয়ী বলেছিলেন যে একটি নির্দিষ্ট কারণে সেই বক্তৃতা করা হয়েছিল। “মেরা অযোধ্যা আন্দোলন মেঁ জাদা রোল নেহিঁ থা (অযোধ্যা আন্দোলনে আমার খুব একটা ভূমিকা ছিল না)।” তারপরে তিনি সেই প্রতিলিপি তুলে নিলেন এবং তা দেখে বললেন যে সেই বক্তৃতায় এমন কিছুই নেই যা আইনের আদালতে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। অযোধ্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আডবাণীর তথাকথিত মতপার্থক্য এবং গুজটার দাঙ্গা নিয়ে মোদী প্রসঙ্গে প্রশ্ন করায় তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন তার পরে মুচকি হেসেছিলেন।

আমরা সোজাসুজি কোনও জবাব পাইনি।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SABA NAQVI SABA NAQVI @_sabanaqvi

Eminent political journalist and writer. Author, most recently of Shades of Saffron: From Vajpayee To Modi

Comment