কংগ্রেস কেন ‘গুজরাট মডেল’ সফল করতে পারল না মধ্যপ্রদেশে
মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিলেও পরশ সকলেচা ও আনন্দ রাইকে ভোটে প্রার্থী করেনি কংগ্রেস
- Total Shares
মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সে রাজ্যে গুজরাট মডেল প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী।
গত এক বছর ধরে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব নানা রকম অরাজনৈতিক কার্যকলাপ করেছে – সমাজের গভীর পর্যন্ত যাঁর শিকড় রয়েছে সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেন, হুইসেলব্লোয়ার (কোনও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির খবর প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্তরে যিনি জানান), দক্ষিণপন্থী আন্দোলনকারী এবং কৃষকনেতাদের সমর্থন করেছে। তাদের ভাবনা ছিল, কংগ্রেসের ‘গুজরাট মডেল’ এখানেও কার্যকর করা, অর্থাৎ যে ভাবে জিগনেস মেবানি, অল্পেশ ঠাকুর এবং অন্যদের তুলে ধরে গত বছর গুজরাটের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস নির্বাচনী সুবিধা লাভ করেছে এখানেও তা করা।
মন্দসৌরের পথে রাহুল গান্ধী, ২০১৭ সালের কথা (ছবি: টুইটার/জাতীয় কংগ্রেস)
শোনা যাচ্ছিল যে পরশ সকলেচা ও ডাঃ আনন্দ রাইয়ের মতো যাঁরা ব্যাপম দুর্নীতির হুইসেলব্লোয়ার ছিলেন, এ বারের নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী করা হবে বলে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে কংগ্রেসের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরে দেখা গেল যে প্রার্থী তালিকায় তাঁদের কারও নামই নেই। সরকারি মেডিক্যাল অফিসার থাকা অবস্থায় পদত্যাগ করা আনন্দ রাই তাঁর হতাশা ঢাকবেন কী ভাবে!
টেলিফোনে ডেইলিও-কে আনন্দ রাই বলেন, “একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের বলা হয়েছিল যে আমরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চলেছি। তখন আমাদের বলা হয়েছিল যে দলে আমরা নবাগত, আমাদের প্রয়োজনীয় ‘বল’ নেই। তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েই সব শেষ হল।”
বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন দলিতদের অধিকার নিয়ে লড়াই করা তরুণ দলিত নেতা দেবাশিস জারারিয়া, বিভিন্ন টেভিভিশন চ্যানেলের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়মিত দেখা যায়, তিনি আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বালি মাফিয়ার বিরোধী, তথ্যের অধিকার এবং কৃষকদের সমস্যা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাপারে যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁদের একত্রিত করে চাপ সৃষ্টি করছিল ইন্দোরে বিচার এমপি নামে ডাঃ রায়ের সংগঠনটি। রতলম থেকে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যত ধর্মযুদ্ধে নামা পরশ সাকলেচা। তবে আগে নির্দল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হওয়া সাকলেচা এ বার কংগ্রেসের টিকিট পাননি। রাজনৈতিক ভাবে ঠিক থেকে সাকলেচা বলেছেন যে তিনি কংগ্রেসের হয়ে নিরলস ভাবে কাজ করে যাবেন। ২০০৮ সালে রতলাম থেকে নির্দল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছিলেন সাকলেচা।
ব্যাপম কেলেঙ্কারির হুইসল ব্লোয়ার আনন্দ রাই (ছবি: টুইটার)
সম্প্রতি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন প্রভাবশালী কৃষক কেদার সিরোহী অবশ্য বলেছেন যে প্রার্থী হতে না পেরে তিনি হতাশ নন। তিনি বলেছেন যে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হল রাজ্য থেকে বিজেপিকে বিতাড়িত করা। জবলপুরের জওহরলাল নেহরু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রিকালচালার ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফার্ম ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হলেন আম কিষাণ ইউনিয়নের প্রধান সিরোহী। এক বছর আগেও বিজেপি ও কংগ্রেস – দুই দলেরই তীব্র বিরোধী ছিলেন সিরোহী। মালওয়া এবং নিমার অঞ্চলে কৃষক আন্দোলনের মূল হোতা ছিলেন তিনিই, ২০১৭ সালের জুল মাসে তাঁদের আন্দোলনেই পুলিশ গুলি চালালে ৮ জন কৃষকের মৃত্যু হয়।
রাজ্যে যত কৃষি বিদ্যালয় আছে তারা প্রত্যেকেই কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ আর সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যত স্নাতক আছেন তাঁদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে সিরোহীর। বরিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিকদের আন্দাজ অনুযায়ী ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী যাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, যাঁরা টুইট, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ করার ব্যাপারে বেশ চটপটে, মন্দাসৌরে প্রতিবাদীদের মধ্যে তাঁদের সংখ্যা ছিল বেশ ভালো। তাঁরা যে ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছিলেন তাতে মন্দাসৌর, উজ্জ্বয়িন, রতলাম, নীমাচ এবং ধরের মতো সমস্যাসঙ্কুল অঞ্চলে ২০১৭ সালের জুন মাসে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা পরশ সাকলেচা এবার রতলম থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন (ছবি: এএনআই/ টুইটার)
মধ্যপ্রদেশ বেরোজগার সেনার প্রধান অক্ষয় হুঙ্কারও বহু তরুণ অনুগামী আছে বলে দাবি করা হয় তবে ভোপালের গোবিন্দপুরা থেকে তাঁর নির্বাচনে লড়াইয়ের প্রত্যাশা অধরাই রয়ে গেছে কারণ তাঁকেও টিকিট দেয়নি কংগ্রেস। সরকারি কর্মীদের অবসরের বয়স ৬০ বছর থেকে ৬২ বছর করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শিবরাজ সিং চৌহান, তার বিরোধিতা করে অন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন অক্ষয় হুঙ্কা।
গম কেনায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করা নরসিংহপুরের বিনায়ক পারিহার সম্প্রতি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। রাজ্যের পঞ্চায়েতি রাজ দপ্তরে পঞ্চায়েতি রাজ অধিকারিকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন ডিপি ঠকড়, কংগ্রেসের কাছে তাঁর যে টিকিটের প্রত্যাশা ছিল তা উপেক্ষা করা হয়েছে। শ-দেড়েক সরপঞ্চকে (পঞ্চায়েতপ্রধান) নিয়ে দেশের প্রাচীন এই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন গদরওয়াড়ার মীনা কোরাব। তিনি টিকিট পাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেছিলেন, তবে তাঁর সেই প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি।
কৃষক আন্দোলনের জেরে কারাবরণ করা অর্জুন আর্য সম্প্রতি সমাজবাদী পার্টি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, তিনি নিজে আবার মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহানের বিধানসভা কেন্দ্র বুধনির বাসিন্দা। শোনা যাচ্ছে যে তাঁকে টিকিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দিগ্বিজয় সিং নিজে তবে পরে নাকি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন।
রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ সীতাশরণ শর্মার ভাই গিরজাশঙ্কর শর্মাও কংগ্রেস প্রার্থী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বিজেপির ভূতপূর্ব বিধায়ক এবং মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদের প্রভাবশালী ব্যক্তি।
মধ্যপ্রদেশ প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান কমল নাথের ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানিয়েছেন যে এই সব কর্মীদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল, তবে এতজন ‘বহিরাগত’কে জায়গা দেওয়া দলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শোনা যাচ্ছে, সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে মধ্যপ্রদেশের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দীপক বাওয়ারিয়াকে এ জন্য দোষ দিচ্ছেন কমল নাথ, কারণ যাঁরাই কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়াতে চেয়েছেন, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে তিনি নির্বিচারে তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন। ভাওয়ারিয়া গুজরাটের নেতা এবং রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ।
সর্বশেষ যে কথা শোনা যাচ্ছে তা হল কংগ্রেস যদি নির্বাচনে জিতে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে তা হলে এই সব অসন্তুষ্ট নেতাদের মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন বোর্ড ও কর্পোরেশনে সুযোগ করে দেবে।
উত্তরে হয়তো তাঁরা এই গানটি গাইতে চাইবেন, “কৌন জিতা হ্যায় তিরি জুলফ কে সর হোনে তক...”
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে