লোকসভা নির্বাচন ২০১৯: শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারল
শুধুমাত্র মমতা ও মায়াবতীর সঙ্গে জোট গঠন সম্ভব হয়নি, ফলাফলের পরেও জোট গঠন সম্ভব
- Total Shares
ভারতের দরিদ্রদের জন্য ন্যূনতম রোজগার নিশ্চয়তা (এমআইজি) প্রকল্প ঘোষণা করে কংগ্রেস আবার তাদের নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিল। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, এমআইজি প্রকল্পের ঘোষণা করা মানে দেশের দরিদ্র সম্প্রদায় এখনও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। দেশের নাগরিকদের মধ্যে যারা সবচাইতে অসুরক্ষিত তাদের আইনি ও সংসদীয় নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে। তাই আমি মনে করি, নির্বাচনে এই প্রকল্প কংগ্রেসকে সাহায্য করুক বা না করুক, এই ধরণের প্রকল্পকে সর্বদাই সাধুবাদ জানাতে হবে।
রাহুল গান্ধীর ন্যূনতম রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প ঘোষণা কংগ্রেসকে পুনরুত্থানে সাহায্য করবে [ছবি: রয়টার্স]
দারিদ্র্য-ভর্তুকি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। তবে আমি এই বিতর্কের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাই না। চারপাশে যে দারিদ্র্যে ও অবিচারের ছবি ফুটে ওঠে তা দেখে আমার শুধু একটা কথাই মনে হয় - দেশের দরিদ্র সম্প্রদায় সামান্য কিছু পেলেও আমাদের সেই পাওয়াকে স্বাগত জানানো উচিত। কর্পোরেট সংস্থাগুলো কিংবা বিমান সংস্থাগুলো বিপাকে পড়লে যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে দরিদ্রদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যাবে কেন?
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের এই ঘোষণা কিন্তু প্রতীকী - যে দলটি নির্বাচনে বিজেপির বড় বড় প্রতিশ্রুতিগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চলেছে সেই দলটির কাছে এই ঘোষণাটির গুরত্ব অপরিসীম।
এর উপর যদি কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির জোট ঘোষণা করে দেওয়া যায় তাহলে বিজেপি কিন্তু পাল্টা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বাধ্য হবে। আপের সঙ্গে জোটের প্রভাব দেশের রাজধানীর সাতটি আসনের উপর পড়বে। দেশের রাজনৈতিক মহলকেও একটি বার্তা পাঠানো যাবে - খোদ দেশের রাজধানীতেও বিজেপিকে পরাজিত করা অসম্ভব নয়।
বিজেপির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও বেশ চিন্তিত। তারা স্বীকার করে নিচ্ছে, এই মুহূর্তে একটি মাত্র আসনই - পশ্চিম দিল্লি - তাদের কাছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। তাদের আশঙ্কা, কংগ্রেস-আপ জোট হলে দিল্লির বাকি ছ'টা আসনেই বিজেপি হারতে পারে। আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর জন্য নির্দিষ্ট মূলমন্ত্রটা বেশ পরিষ্কার - 'একতাই শক্তি'।
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী কিন্তু দেশ জুড়ে জোট গঠন করে চলেছেন [ছবি: পিটিআই]
আরও একটু গভীরে প্রবেশ করা যাক। সংবাদমাধ্যম যখন জাতীয় স্তরে বিরোধী জোট ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রচার করে চলেছে, তখন কচ্ছপের গতিতে হলেও কংগ্রেস কিন্তু প্রায় প্রতিটি জোটই গঠন করে ফেলেছে। শরিকদের বিভিন্ন অদ্ভুতুড়ে দাবির মাঝেও।
কংগ্রেসের সমালোচনা করা খুবই সহজ। বিশেষ করে যখন খুব দ্রুত কোনও প্রতিবেদন লিখতে হয় তখন কংগ্রেসের মতো সহজ শিকার মেলা ভার। কিন্তু সবকটি রাজনৈতিক দলেরই সমালোচনা করার একাধিক কারণ রয়েছে।
দক্ষিণ ভারত থেকে শুরু করা যাক।
ডিএমকে-র নেতৃত্বধীন জোটে কংগ্রেসও সামিল রয়েছে। এই জোট তামিলনাড়ুতে ভালো ফল করবে বলে আশা করা যায়। কেরলে কংগ্রেসের ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) বেশ শক্তিশালী এবং ইউডিএফের লড়াইটা মূলত বাম নেতৃত্বাধীন এলডিএফের সঙ্গে হবে। কর্নাটকে, সংবাদমাধ্যম যাই প্রচার করুক না কেন, জেডিএসের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট গঠন সম্ভব হয়েছে।
ডিএমকে সভাপতি এম কে স্ট্যালিনের সঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী [ছবি: পিটিআই]
অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলঙ্গনার পরিস্থিতি অবশ্য বেশ জটিল।
অন্ধ্রে তেলুগুশম পার্টি (টিডিপি) একাই জগন রেড্ডির ওয়াইএসএর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইছে। কিন্তু তেলঙ্গানায় পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। এই রাজ্যে সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে তেলঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস) জয়লাভ করেছে। টিডিপির তরফ থেকে বলা হয়েছে, তেলঙ্গনায় তারা কংগ্রেসকে সমর্থন করতে পারে। অর্থাৎ একটি রাজ্যে টিডিপি কংগ্রেসের 'শত্রু' হতে চাইছে এবং প্রতিবেশী রাজ্যে টিডিপি আবার কংগ্রেসের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছে। অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেস একেবারেই শক্তিশালী নয়। আর তাই টিডিপির এ ধরণের সমঝোতার কারণ ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। সান্ত্বনা একটাই, দুটি রাজ্যেই বিজেপি কিন্তু নগণ্য।
এবার পূর্ব দিকে যাওয়া যাক।
ঝাড়খণ্ডে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) ও বাবুলাল মারান্ডির ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চার (প্রজাতান্ত্রিক) সঙ্গে কংগ্রেস আসন সমঝোতা করে ফেলেছে। একই ভাবে বিহারেও বেশ কিছু স্বার্থত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতৃত্বধীন জোটের সঙ্গে আসন সমঝোতায় রাজি হয়েছে কংগ্রেস।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে ব্যর্থ কংগ্রেস।
সম্প্রতি মালদায় একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে রাহুল গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা করেছেন। আর, এর পরেই মহাজোট নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ করে, ২৩ মে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরেও যেখানে জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, রাজনীতিতে আবার স্থায়ী শত্রু বলে কিছু হয় না।
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়তে নারাজ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় [ছবি: পিটিআই]
সত্যি কথা বলতে এই জোট সম্ভব হচ্ছে না কারণ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তারা মনে করছে যে বিজেপির উত্থানকে তারা একাই আটকে দিতে পারবে। শেষ লোকসভা নির্বাচনে, বিরোধীদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কংগ্রেসের আসন সংখ্যা যেখানে ৪৪ ছিল, তৃণমূল সেখানে ৩৪টি আসন পেয়েছিল।
একই ভাবে, কংগ্রেস ও মায়াবতীর সম্পর্ক কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশে এসপি-বিএসপি-আরএলডি জোটে কংগ্রেসকে সামিল করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) প্রধান। যদিও এই জোট কিন্তু বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে।
উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসকে যদি একাই লড়তে হয়, তাহলেও কংগ্রেসের হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। বিশেষ করে, যখন, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের সংগঠন বেশ মজবুত। তাই খুব হিসেবে কষে, উত্তরপ্রদেশে প্রার্থী তালিকা ঠিক করতে চাইছে কংগ্রেস। যাতে বিজেপিকে বিপাকে ফেলা সম্ভব হয় এবং বিরোধী জোটকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া যায়।
মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস ইতিমধ্যেই শরিক ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে জোট বাধা নিশ্চিত করেছে। তবে প্রকাশ আম্বেদকরের ভরিপা বহুজন মহা সঙ্ঘের (বিবিএম) সঙ্গেও কংগ্রেসের জোট গঠন করা উচিত ছিল। একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, বিবিএম শহরাঞ্চলে কংগ্রেসের কাছে পাঁচটিআসন দাবি করেছিল। কংগ্রেস এই দাবি মানতে রাজি নয়।
আবার দিল্লিতে ফিরে আসা যাক। যেখানে কংগ্রেসকে জয়যুক্ত হতেই হবে। অথচ আপের সঙ্গে জোট গঠন এখনও সম্ভব হয়নি। আপ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, কংগ্রেসকে সমর্থনের জন্য তারা এখন শুধুমাত্র দলীয় নেতৃত্বের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষা করছে।
শেষ পর্যন্ত কী হবে? দৌড়ে কি কচ্ছপ জিতবে, না কি খরগোশেরই জয় হবে?
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে