রাজনৈতিক প্রভুদের অঙ্গুলিহেলনে চলার উল্টো মেরুতে অবস্থান, তাই শাসকের চক্ষুশূল যাদবপুর
যাদবপুর বা জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও 'ইনফ্যান্টাইল ডিসঅর্ডার চোখে পড়ে', কিন্তু সে তো ওই বয়সের ধর্ম
- Total Shares
ভারতে বিদ্যাচর্চার প্রদোষ কাল থেকেই আর্গুমেন্ট-কাউন্টার আর্গুমেন্ট,ডায়লগ এবং অল্টারনেটিভ পার্সপেক্টিভের উপর ভিত্তি করে এগিয়েছে, যার মূল সুর ছিল ডিবেট। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন 'দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান' গ্রন্থে ভারতবর্ষের এই ধারাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর বইতে মহাভারত, রামায়ণ, ভগবদ গীতা থেকে অজস্র উদাহরণ তুলে অমর্ত্য দেন দেখিয়েছেন ভারতবাসী কতটা তর্ক প্রিয়। সেই তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়েই ভারতবর্ষে জ্ঞান তপস্যা এগিয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল তারও ভিত্তি ছিল আনুগতিহীন প্রশ্ন এবং তর্ক। বাংলার নবজাগরণ ইউরোপের নবজাগরণের সমগোত্রীয় কি না তা নিয়ে বহু মত রয়েছে। কিন্তু এই নবজাগরণে তৎকালীন শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক এবং ছাত্রদের বিপুল অবদান রয়েছে। ইউরোপের শ্রেষ্ট দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এবন্দ ভারতের এই জ্ঞানের ধারা ঠাঁই পেয়েছিল হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিওর মধ্যে। তাঁরই অনুপ্রেরণায় এক ঝাঁক উজ্জ্বল ছাত্রকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি।
১৮৩৩ সালে 'ক্যালকাতা কুরিয়ার' লিখেছিল 'That a number of educated individual established a debating society in which questions on metaphysics and political economy should be discussed'। সেই সময় রামগোপাল ঘোষ, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জি মতো উজ্জ্বল ছাত্রদের সামনে লক, হিউম, বেকন, টম পেইন, অ্যাডাম স্মিথদের লেখা তুলে ধরতেন ডিরোজিও। তবে ইনি তাঁর ছাত্রদের শিখিয়েছিলেন 'যে মতবাদই পড় না কেন প্রশ্নহীন আনুগত্য দিয়ে মেনে নেবে না। প্রশ্ন করবে যতক্ষণ না তোমার মনে হয় তুমি সব প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছ।'
'গ্রোথ অফ কনজারভেটিভ র্যাডিক্যালিজম ইন বেঙ্গল' পর্বে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ পাল লিখেছেন, 'The general tone and temper of discussion was a decided revolt against existing religious customs and ceremonies of Hindu social organization'। রামগোপাল ঘোষরা এই মুক্ত চিন্তার বলে বলীয়ান হয়েই তৎকালীন সামাজিক শোষণ কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ও অবৈজ্ঞানিক চেতনার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। শিক্ষার এই ধারার উত্তরাধিকারই বহন করছে জেএনইউ এবং যাদবপুর।
আন্দোলনরত যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা [ছবি: সুবীর হালদার]
আজ এই সময় এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শাসককূলের চক্ষুশূল। সব মেনে নিয়ে আনুগত্য দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রভুদের অঙ্গুলিহেলনে চলার উল্টো মেরুতে অবস্থান যাদবপুরের। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও ডিরোজিওর মতো ছাত্র ছাত্রীদের সামনে জ্ঞানের ভান্ডার তুলে দেওয়ার পাশাপাশি মাথা উঁচু করে তর্ক করতে শেখান। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের মত সাম্প্রতিক প্রবেশিকা বিতর্ক শুধুমাত্র পরীক্ষা হওয়া বা না হওয়ার প্রশ্ন নয়। গত ৪০ বছর ধরে মাথা উঁচু করার যে সাহস শিক্ষকরা তার পড়ুয়াদের জুগিয়ে এসেছেন সেই সাহসটাকেই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে যা কিছু আলাদা তা কখনই মানতে পারে না রাজনৈতিক আধিপত্য। ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশ নয় তাদের প্রয়োজন এমন এক গোষ্ঠী যা তাদের পচন অপছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে। কলেজে প্রবেশের এক শুভ মুহূর্ত কী ভাবে কলুষিত হতে পারে বিভিন্ন কলেজে তারই নিদর্শন দেখছে পশ্চিমবঙ্গ। আর এখানেই ব্যতিক্রম যাদবপুর। আজ পর্যন্ত যাদবপুরে ভর্তি নিয়ে কোনও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি।
এখানে যারা পড়াশুনা করেন তাদের ক্লাসরুমই যথেষ্ট পরীক্ষায় পাস করার জন্য প্রাইভেট টিউশন নিতে হয় না। এক সেমেস্টার থেকে অন্য সেমেস্টারে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান বাড়তে থাকে পড়ুয়াদের। তার মাঝেই চলে স্যার ম্যাডামদের সঙ্গে বিপুল তর্ক। কখনও কখনও নবজাগরণের আশায় বিভোর ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা অতি উৎসাহের বশে গোড়া হিন্দু বাড়িতে মাংসের হাড় ছুড়ে দিয়েছিলেন। যাদবপুরের বা জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও কখনও কখনও এই ধরণের 'ইনফ্যান্টাইল ডিসঅর্ডার চোখে পড়ে'। কিন্তু সে তো ওই বয়সের ধর্ম।
কোনও বাঁধা ধরা ছকের মধ্যে চলতে চায় না যাদবপুর [ছবি: পিটিআই]
যাদবপুর বা জেএনইউ পড়াশুনার এই ধারা তুলে ধরতে গেলে প্রশ্ন আসে অন্য কোথাও কি পড়াশুনা হচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর হল বাকি বোর্ড থেকেও অনেকেই বহু নম্বর প্ৰয়ে পাস করছে। যাদবপুর বা জেএনইউয়ের প্রশ্ন বিপুল নম্বর পাওয়া নিয়ে নয়। প্রশ্ন ব্যবস্থাতা নিয়ে। যাদবপুরের শিক্ষকদের মত সারা দুনিয়ায় উচ্চ শিক্ষায় কলা বিভাগে শুধুমাত্র নম্বর পাওয়ার জন্য পড়াশুনা কোন গুরুত্ব নেই। তাঁদের মতে কলা বিভাগের প্রতিটি বিষয়ে নিজস্ব কিছু চাহিদা আছে। নম্বরের ভিত্তিতে পড়ুয়াদের প্রবেশে এই চাহিদার বিচার করা যায় না। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পরিক্ষাত্রীর কল্পনা নিজস্ব ভাষা জ্ঞান লিখিত ভাবে তা প্রকাশ করতে পাড়ার প্রত্যয় টুকুই খোঁজে যাদবপুর। এই কারণেই যাদবপুর কলা বিভাগের প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থাটা ধরে রেখেছে।
কোনও বাঁধা ধরা ছকের মধ্যে চলতে চায় না যাদবপুর। সেখানকার শিক্ষকদের দাবি এই কারণেই পুরুলিয়া বীরভূমের মতো প্রত্যন্ত এলাকার ছত্রছাত্রীদের পাশাপাশি কোলকাতার 'এলিট' স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দেখা পাওয়া যায় যাদবপুরে। আর এখানেই বেঁধেছে গোল।
বর্তমানে গোটা দেশের নিরিখে অগ্রণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোর মধ্যে একমাত্র জায়গা রয়েছে যাদবপুরের। অনেকেরই প্রশ্ন যাদবপুরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা যদি চলতে থাকে তাহলে প্রতিষ্ঠানের মান নামতে বাধ্য। বহু প্রথিত যশা শিক্ষাবিদ এই আশঙ্কাই ব্যক্ত করেছেন।