দলের জন্য টাকা চান মুখ্যমন্ত্রী, তাই তোলা আদায় কলেজ থেকে
ছাত্রভর্তি আতঙ্কের চেহারা নিয়েছে, সংগঠনে নিয়ন্ত্রণহীন মুখ্যমন্ত্রী
- Total Shares
একটা গল্প দিয়েই শুরু করি।
একদিন দুই ভাই স্কুল থেকে ফিরল অঙ্কের পরীক্ষার ফল নিয়ে। বাবা ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা, তুমি কত পেয়েছ অঙ্কে?” ছোট ছেলে উত্তরে বলল, দাদার থেকে ২ নম্বর বেশি। বাবা খুশি হলেন। তারপরে বাবার কী যেন সন্দেহ হল। তিনি ছোট ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, তোমার দাদা কত নম্বর পেয়েছে?” ছোট ছেলে বলল, “দাদা শূন্য পেয়েছে।” এ কথা শুনে বাবা অবাক হয়ে গেলেন।
আমাদের রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি এই ভাবেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা (ছবি: সুবীর হালদার)
আজ ছাত্র ভর্তি যেন এক আতঙ্ক। জলাতঙ্ক রোগের চেয়েও ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। প্রাপ্ত নম্বর এখন আর শিক্ষার মাপকাঠি হতে পারে না। চাই অনুদান, চাই উপঢৌকন। রাজ্যের নৈরাজ্যর দৃশ্য আজ সাম্রাজ্ঞীর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। কারণ ওনার সামনে আজ প্রবল ভাবে ‘উন্নয়নদাঁড়িয়ে রয়েছে’।নারদ-সারদা কেবল একমাত্র পন্থা নয়, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ কেড়ে নেওয়ার যে নিরলস প্রয়াস, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার জানে কী ভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে।
বিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কী ভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকাপয়সা লুঠ করে নেওয়া যায়, তা এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দেখিয়ে দিল। কী নিপুণ কুশলী! যেন তোলাবাজির নতুন এক গোষ্ঠী! প্রতি বছর নতুন করে ঘুরে এসেছে-- এই নৈরাজ্য আমরা দেখেছি ও জেনেছি। শিখেছি চপশিল্প সবচেয়ে বড় শিল্প। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নে চপশিল্পের ভূমিকা আমরা জানতাম না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথাম জানালেন যে তেলেভাজাও শিল্পের মধ্যে পড়ে। ঠিক সে ভাবেই দেখতে পাচ্ছি, পাহাড় থেকে সাগর পর্যন্ত কলেজগুলি তোলাবাজির এক নিপুণ পরিচয় বহন করছে।
আমরা এক সময় ছাত্রপরিষদ করেছি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এক সময়ে ছাত্র পরিষদ করেছেন। তখন ছাত্রপরিষদে নীতির লড়াই ছিল, আদর্শের লড়াই ছিল। আজকে যারা ছাত্র রাজনীতি করছে, তারা সেই নীতি ও আদর্শ মেনে করছে না। যারা আজকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ঝান্ডা নিয়ে লড়াই করছে আমার সন্দেহ হয় ছাত্রসমাজের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও প্রেম নিয়ে। সন্দেহ হয় তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও।
আরেকটা কথাও বলতে চাই যে যখন আরাবুল ইসলাম এখানকার একজন শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মেরেছিল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “এটা একটা ছোট্ট ঘটনা, আরাবুল ভুল করেছে।” শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির বদলে এই আরাবুল ইসলামের শিক্ষিকাকে অপমান করার মাধ্যমে দেখা গেল যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে আছেন। এটা দেখে ছাত্রসমাজ অনুপ্রাণিত হল। ওনার অনুপ্রেরণাতেই আজকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যেখানেই যাবেন, আজ এই পরিস্থিতি।
দেখতে হবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে য শিক্ষার প্রসার ও বিকাশ যথাযথ ভাবে ঘটছে কিনা। আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে যারা ছাত্র পরিষদ করছে, তারা যে টাকা আদায় করছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন যে সেই টাকার ৭০ শতাংশ তাঁর দলের ভাঁড়ারেই ঢুকছে। তিনি নিজেও নেতাজি ইন্ডোরে খোলাখুলি ভাবে বলছেন যে, সেই টাকার পঁচিশ শতাংশ অংশ আদায়কারীরা নিজেদের জন্য রেখে দিয়ে যেন বাকি ৭৫ শতাংশ অংশ দলকে দেওয়া হয়। এ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার ভাবে সংগঠনের কাছে কাছে বার্তা দিতে চাইছেন যে তুমি যাই কর, যে কোনও অন্যায় কর, সে সব তিনি ক্ষমা করে দেবেন, তবে তার বদলে ওই টাকার ৭৫ শতাংশ তৃণমূলের ঘরে জমা করতে হবে। এটা শুধু লজ্জারই নয়, পশ্চিমবঙ্গে মূল্যবোধের উপরে বড় আঘাত।
Any allegation? @MamataOfficial visits college to check the situation pic.twitter.com/WfVwyaZUjQ
— SumitroBandyopadhyay (@sumitrob) July 3, 2018
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই বলে আসছেন, “আমি গুন্ডা কন্ট্রোল করি।” আজ এই পরিস্থিতি তৈরি করার পিছনে ওনার অবদান সবচেয়ে বেশি। উনি যদি প্রথম থেকেই ছাত্র সংগঠনের যারা নেতা তাদের বলে দিতেন যে কারও থেকে ফর্মবাবদ কোনও অর্থ নেওয়া হবে না এবং প্রয়োজনে এ নিয়ে সরকারি নির্দেশিকা জারি করতেন, তা হলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। দলের প্রতি নিয়ন্ত্রণ কতটা শিথিল হয়ে গেলে পুলিশ-প্রশাসনকে দিয়ে নিজের দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকে গ্রেপ্তার করাতে হয়। কলেজের গেটে গিয়ে উনি নিজে বলছেন, “তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাদের বলছি তাঁরা কোনও টাকা নিয়ে ভর্তি করবেন না।” তাঁর আশ্বাসকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে এই সব আশ্বাসই সার, এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনও মিল নেই।
আমরা যখন ছাত্রপরিষদ করেছি তখন ছিল কলেজে অবস্থান করা, রাস্তা বন্ধ করা – এ সবকিছুর সঙ্গে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ জড়িত থাকত। নির্দিষ্ট নম্বরের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত। আজ আমরা দেখছি যে বিভিন্ন অনার্স পাঠ্যক্রমের জন্য টাকা বেঁধে দিচ্ছে – ইংরেজির জন্য ২৫,০০০ টাকা, সাংবাদিকতার জন্য ২০,০০০ টাকা লাগবে। ভূগোল পড়তে গেলে ৩০,০০০ লাগবে...। অতএব সকালবেলা থেকে রাত্রি বেলা অবধি এখন স্থানীয় সাংসদ, বিধায়ক, কাউন্সিলর, ঠিকাদার প্রমুখ যারা এখন তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পদ, তারাই এ সব নিয়ন্ত্রণ করছে।
ছাত্র রাজনীতি করার একটা বয়স থাকে, সেই বয়স পার হয়ে গেলে আর ছাত্র রাজনীতি করা যায় না। জেলাস্তরে বিভিন্ন তৃণমূল ছাত্রপরিষদকে দেখুন, দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তর কলকাতা, নদিয়া থেকে কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ থেকে মালদহ... ৪৫-৫০ বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে, কাউন্সিলর হয়ে গেছেন, তখনও তিনি একটি জেলার ছাত্রপরিষদের প্রধান বা উপপ্রধান। এর কারণ হল, ওই ধরনের লোককে সংগঠনের মাথায় রেখে তোলা তুলতে দেওয়া ও সেই তোলা আদায়ের একটা অংশ দলের ভাঁড়ারে দিয়ে দলতে আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ করা।
নারদ ও সারদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আর অর্থ উপার্জনের জায়গা নেই। এখন অর্থ উপার্জন করে হলে বিভিন্ন ঠিকাদারকে চমকাতে হবে, ছাত্র সংগঠনের থেকে টাকা তুলে ওনাকে দল পরিচালনা করতে হবে। যে স্লোগান দিয়ে উনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই স্লোগানের ভিত এখন নষ্ট হয়ে গেছে। উন্নয়নের কথা শুধু মুখে বললে হবে না, বাস্তবে সেই উন্নয়ন করতে হবে।
আগে পশ্চিমবঙ্গে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি তৈরি হত। এক সময় বলা হত, হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো। আজ উল্টোটা হয়ে যাচ্ছে। তার কারণ হচ্ছে, কেউ তৃণমূলের যে স্তরের সংগঠন করুক না কেন, তা সে ছাত্র সংগঠন হোক বা যুব সংগঠন, তারা দেখছে আয় করে দলের জন্য টাকা পাঠাতে হবে। নীতি-আদর্শ-নৈতিকতার কথা তাদের ভাবলে চলবে না। সে সব করলে দলে তাদের উত্থান হবে না। তাই তারাও চেষ্টা করছে অর্থ উপার্জন করে তা দলের কোনও নেতা-মন্ত্রীকে দিয়ে যাতে দলে তাদের পদ ও প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকে। এটার বিরুদ্ধেই জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবাদ।
আমরা চাই, শিক্ষাঙ্গন দুর্নীতিমুক্ত হোক, মার্কশিটে ছাত্রছাত্রীদের মেধার প্রতিফলন ঘটুক, ভর্তি ব্যবস্থা হোক অনলাইনে।
The first education minister to visit college? pic.twitter.com/5oair2iINU
— SumitroBandyopadhyay (@sumitrob) July 3, 2018
এ রাজ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, সিপিএম এ রাজ্যের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। তবে তার পরেও যে টুকু ছিল, সেটুকুও আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী নষ্ট করে দিলেন। শিক্ষামন্ত্রী নিজে টুকে পিএইচডি করেছেন বলে অভিযোগ। তাই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় স্লোগান শোনা যাচ্ছে—
পরিবর্তনের পরিহাস/ শিক্ষামন্ত্রী টুকে পাস/ শিক্ষাক্ষেত্রে নাভিশ্বাস।
উপায় কী? কোনও দল না দেখে ভালো ছাত্রদের নিয়ে সংগঠন করা হোক যারা আগামী দিনে ছাত্রদের দিশা দেখাবে। রাজ্যের কাছে তারা আদর্শ হয়ে উঠবে। সে সব না করে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা বহন করে, জেলা কমিটির পতাকা বহন করে তারা শিক্ষাঙ্গনে পরিবেশ নষ্ট করবে, তার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ জানাই।