ক্রাইস্টচার্চ ও পুলওয়ামার ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই হবে
ক্রাইস্টচার্চ মুসলমানদের উপর হামলার বললেও, পুলওয়ামাকে হিন্দু-বিরোধী হামলা বলা হচ্ছে না
- Total Shares
নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ক্রাইস্টচার্চ মূলত ইংরেজ ঐতিহ্য বহন করে চলে। এই শহরটি তার ছবির মতো সুন্দর বাইসাইকেল ট্র্যাক, গন্ডোলা রাইড, স্ট্রিট আর্ট ও বেশ কিছু অদ্ভুতুড়ে প্রকল্পের জন্য পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। আঠারো শতাব্দীতে এখানে ইউরোপীয় বসতি গড়ে ওঠে। তার আগে কয়েক শতাব্দী ধরে স্থানীয় বেশ কয়েকটি উপজাতি এই অঞ্চলে বসবাস করত।
এই সুন্দর শহরটির জনসংখ্যা চার লক্ষ। জনসংখ্যার বিচারে শহরটি নিউজিল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম শহর।
সম্প্রাতিককালে শহরটি একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে।
প্রথমত, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে শহরটিতে একাধিক ভূমিকম্প হয়েছে। এই বিধ্বংসী ভূমিকম্পগুলোতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ভূমিকম্পের প্রভাব শহরের ঐতিহ্যশালী স্থাপত্যগুলোর উপরও পড়েছিল। এর পরে ২০১৭ সালে একটি তীব্র দাবানলে বিধস্ত হয়ে পড়েছিল শহরটি।
তবে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যে ঘটনাটি ঘটল তা কেউই স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি।
মসজিদে হামলার পর নিউজিল্যান্ডের নাগরিকরা একাত্ম হয়েছিলেন [ছবি: রয়টার্স]
রিক্কারটনের শহরতলিতে অবস্থিত আল নূর মসজিদে আর পাঁচটা দিনের মতোই সেদিনও দুপুরের প্রার্থনা শুরু হয়েছিল। হঠাৎই দুপুর ১:৪০ মিনিট নাগাদ এক বন্দুকধারী মন্দিরে প্রবেশ করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। এই ঘটনায় ৫০জন নিহত ও আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন। অপরাধীকে পাকড়াও করে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গোটা বিশ্বজুড়েই এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করা হয়েছিল, করা উচিতও ছিল। শুধুমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণার ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেদের ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল।অপরাধী শেতাঙ্গ আধিপত্যে বিশ্বাসী। আর অপরাধীর এই নীতি আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে গোটা বিশ্বজুড়েই এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল। গোটা বিশ্বের তাবড় তাবড় নেতানেত্রীরা এই ঘটনাটির নিন্দা করেছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এই ঘটনার প্রতি সহমর্মিতা দেখানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম তাদের সম্পাদকীয় পাতায় এই ঘটনা সংক্রান্ত মতামত প্রকাশ করেছিল। ২২ মার্চ সেই দেশের মুসলমান নাগরিকরা গোটা দেশ জুড়ে বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছিল। সেই সভায় বিশ্ব সংহতির প্রতীক হয়ে উঠেছিল হিজাব।
এই জঙ্গিহামলার এক মাস আগে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ছবির মতো সুন্দর কাশ্মীর উপত্যকায় আরও একটি জঙ্গি হামলা হয়েছিল। পাকিস্তানের মুসলিম জঙ্গি সংগঠন, জৈশ-ই-মহম্মদের এক সদস্য সেদিন একটি বাসে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল।
এই বাসটিতে সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানরা ছিলেন। ঘটনায় ৪০ জন জওয়ান নিহত হন এবং আরও অনেকে গুরুতর জখম হন।
পুলওয়ামা জঙ্গিহামলা হিন্দু-বিরোধী আক্রমণ হিসেবে আখ্যা পায়নি [ছবি: রয়টার্স]
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধী একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করেছিল। রাজনৈতিক অলঙ্করণ ছাড়াও ভিডিয়োটিতে কোরানের কিছু বাণী উল্লেখ করা হয়েছিল। ভিডিয়োতে "অপিবত্র" ও "বহু ঈশ্বর"-এ বিশ্বাসী হিন্দুদের কথাও বলা হয়েছিল। ভিডিয়োটিতে হিন্দুরা গোমূত্র পান করে বলা জানানো হয়েছিল।
সব মিলিয়ে ভিডিয়োটিতে হিন্দুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছিল।
ভারতীয়রা অবশ্য এই ধরণের পরিস্থিতির সঙ্গে বেশ সড়গড়। হাজার হোক এর আগেও তাদের এই ধরণের ঘটনার শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনার পরে বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা, আমার মতে আশাতীত।
গোটার বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে এই জঙ্গি হামলার তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছিল। যদিও নিউজিল্যান্ডের জঙ্গি হামলা সংক্রান্ত লেখাগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে এই ঘটনাটি নিয়ে প্রতিবেদনগুলোর অনেকটাই ক্লিশে। এরই মাঝে সান ফ্রান্সিস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভামসি জুলুরি নিউইয়র্ক টাইমসে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন লিখেছিলেন। প্রতিবেদনটিতে জুলুরি লিখেছিলেন, "বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া যাচ্ছে - হামলা সংক্রান্ত, ভারতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত (মানে পাকিস্তানকে দোষারোপ করার বিষয়টি) এবং পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া (তদন্তে সাহায্য করার প্রস্তাব) সম্পর্কিত, ভারতের এয়ার স্ট্রাইক সম্পর্কিত, এবং ভারতীয় বায়ুসেনার কমান্ডারের গ্রেফতার ও মুক্তি সম্পর্কিত। এই সব ঘটনাগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তাদের সম্পাদকীয় ও অন্যান্য মতামতধর্মী প্রতিবেদনে যুদ্ধ সংক্রান্ত, সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে জঙ্গিপনা সংক্রান্ত ও কাশ্মীরি লেখকদের নিদারুণ যন্ত্রনা সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করেছে।"
যদিও, এই প্রতিবেদনগুলোর একটিতেও ভারতীয়দের সম্পর্কে সহানুভূতি দেখানো হয়নি যারা দশকের পর দশক ধরে ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়ে আসছে।
I looked at New York Times headlines on India since #PulwamaTerroristAttack closely and this is what I found. https://t.co/Dlee257jbA
— Vamsee Juluri (@VamseeJuluri) March 11, 2019
অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও এই ঘটনা নিয়ে বেশ একপেশে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত এই হামলাটিতে যে হিন্দু-বিরোধী হামলা সেই কথা তাদের প্রতিবেদনে কোথাও প্রকাশ করা হয়নি। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত জুলুরির প্রতিবেদনটিতেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।
বিশ্বের নেতানেত্রীরাও এই ঘটনার নিন্দা করলেও এই ঘটনা যে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ সে কথা উল্লেখ করেননি। এই নেতানেত্রীদের করা এই সংক্রান্ত টুইটগুলো দেখলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
উল্টোদিকে, ক্রাইস্টচার্চ হামলা 'মুসলমানদের উপর হামলা' এই আখ্যা দিয়েই বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হয়েছে।
একই ভাবে পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার পর আমরা কোনও হিন্দু প্রার্থনার ব্যবস্থা দেখলাম না। শুধুমাত্র শহিদ জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত করা হয়েছিল। বরঞ্চ, এই ধরণের প্রার্থনাসভা নিয়ে কথা বলতে গেলে হিন্দু মৌলবাদের তকমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওহায়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক (যিনি কিন্তু ভারতীয় বংশদ্ভুত) একটি সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় কলমে একটি অভিযোগপত্র পাঠান। তাঁর অভিযোগ ছিল যে একটি ছাত্র সংগঠন নাকি ধর্মচর্চার জন্য লোকেদের অহেতুক সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে চলেছে।
ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর হিজাব সংহতির প্রতীক হয়ে উঠেছিল [ছবি: রয়টার্স]
ক্রাইস্টচার্চ আক্রমণ পরে গোটা বিশ্বজুড়ে মহিলারা হিজাব পরে প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু পুলওয়ামা হামলার পরে মঙ্গলসূত্র কিংবা মাথার তিলক কিন্তু সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠেনি।
#হিন্দুফোবিয়া বলে হ্যাসট্যাগ সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড হয়নি।
হাজার হাজার বছর ধরেই ভারতীয়রা এই ধরণের আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
মূর্তিপূজার জন্য তাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী বলে তাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও বহু যুগের এই ধর্ম আজও অক্ষত রয়েছে।
কোনও রকম সহমর্মিতা ছাড়াই হিন্দু ধর্ম আজও নির্মম অত্যাচার ও বিধ্বংসী আক্রমণের শিকার হয়েও টিকে রয়েছে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে