রাহুল গান্ধীর সভায় গেলেন না অধীর চৌধুরী, তাঁকে নিয়ে কেন বিড়ম্বনা কংগ্রেসে?
অধীর চৌধুরীর প্রচারে সে ভাবে নেই কংগ্রেসের পতাকা, তাঁকে নিয়ে জল্পনাও রয়েছে
- Total Shares
প্রদেশ কংগ্রেসের প্রচার সমিতির শীর্ষ পদে রয়েছেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী। শনিবার রাজ্যে প্রথম নির্বাচনী সভা করে গেলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী।
স্বাভাবিক প্রোটোকল অনুযায়ী ব্যক্তিগত ভাবে এই সভায় উপস্থিত থেকে সভার সাফল্য সুনিশ্চিত করাটা অধীর চৌধুরীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু শনিবার মালদহের ত্রিসীমানায় দেখতে পাওয়া যায়নি কংগ্রেসের এই নেতাকে। যুক্তি থাকতে পারে যে তিনি নিজে প্রার্থী এবং সেই হিসাবে তাঁর নিজের কেন্দ্রে তাঁর দায়িত্বের বোঝা অনেক। কিন্তু প্রোটোকলের বিচারে এই যুক্তি ধোপে টেকে না।
মালদহের চাঁচলে রাহুল গান্ধীর সভায় নেই অধীররঞ্জন চৌধুরী। (ছবি: পিটিআই)
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দীর্ঘ দিন ধরে এই ধারনা তৈরি করা হয়েছে যে বহরমপুর অধীর চৌধুরীর। ভাষাগত ভাবে যেটা হওয়া উচিত ছিল, বহরমপুর কংগ্রেসের। এটা ঠিক যে একসময় বলা হত মালদহ গনি খান চৌধুরীর। এটা কংগ্রেসের ব্যর্থতা যে তারা মালদহ ও মুর্শিদাবাদ – এই দু’টি জেলাকে তাদের দলীয় শক্তিকেন্দ্র হিসাবে প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছে উল্টে কোনও দুই বিশেষ ব্যক্তিত্বর ভরকেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
এটা ঠিক যে শ্রদ্ধেয় গনি খান চৌধুরীর প্রয়াণের পরে মালদহ তাঁর পরিবারকেন্দ্রিকই থেকে গেছে তবে কিছুটা হলেও দলীয় স্তরে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি এটাও প্রচারের আলোয় এসেছে। এবং অবশ্যই প্রথম নির্বাচনী সভাটি মালদহে করে রাহুল গান্ধীও সেই বার্তাটাই তাঁদের সমর্থকদের সামনে রাখব চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু কেন্দ্র হিসাবে বহরমপুর বা জেলা হিসাবে মুর্শিদাবাদ এখনও অধীর চৌধুরীর ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি অথবা অধীর চৌধুরী উঠতে দেননি।
মাননীয় প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন জঙ্গিপুর থেকে সাংসদ হয়েছেন তখনও কংগ্রেসের সাফল্যের চেয়ে অধীর চৌধুরীর অবদানের কথাই বেশি আলোচনায় এসেছে – স্বয়ং প্রণব মুখোপাধ্যায় তো দূর অস্ত্।
কংগ্রেসের নয়, বহরমপুর হল অধীর চৌধুরীর দুর্গ। (ফাইল ছবি: পিটিআই)
এই জেলাতে নিজের আধিপত্য প্রমাণ করতে এক সময় প্রয়াত অতীশ সিংহের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়ে এবং তাঁকে জিতিয়েও এনেছেন অধীর চৌধুরী। যদিও সেই ব্যক্তি আজ তাঁরই বিরুদ্ধে তৃমমূলের প্রার্থী।
কিন্তু অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে কংগ্রেস কোনও পদক্ষেপ করতে পারেনি এবং মুর্শিদাবাদ জেলাকে অধীর চৌধুরী নিজের দুর্গ হিসাবে কায়েম রেখেছেন। অধীর চৌধুরীর এই আধিপত্য নিশ্চিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয়।
আরও একটা বিষয় অত্যন্ত নজরকাড়া – সেটা হল যে নিজের কেন্দ্রে গত কয়েকদিন ধরে প্রচার শুরু করেছেন অধীর চৌধুরী। সেখানে তিনি আছেন, তাঁর সমর্থকেরা আছেন কিন্তু সে ভাবে কংগ্রেসের পতাকা সংবাদমাধ্যমের নজরে আসছে না। এই ঘটনাক্রম আরও একবার প্রমাণ করছে অধীর চৌধুরী লড়াইটা ব্যক্তিগত স্তরে লড়ছেন, দলীয় স্তরে কতটা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেসের ১৩ জন বিধায়ক জয়ী হয়েছিলেন। এখন বাস্তবিক ক্ষেত্রে অবশিষ্ট রয়েছেন ৮ জন বিধায়ক। এই পঁচজন বিধায়কের দলবদলের ক্ষেত্রেও প্রচারটি এই রকমই হয়েছে যে অধীর চৌধুরী দুর্বল হলেন – কংগ্রেস হল কি হল না, সেটা আলোচনায় আসেনি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে মুর্শিদাবাদের অধীর চৌধুরী এবং পশ্চিমবঙ্গের অবশিষ্টাংশের কংগ্রেস – এটা কি সমান্তরাল?
এমনকি যে ক’বছর অধীর চৌধুরী প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি থেকেছেন তখনও তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে সামগ্রিক চেহারাটার কোথাও যেন অভাব ছিল বলে মনে করেছেন কংগ্রেস কর্মীরা।
কংগ্রেস ঠিক এইরকমই একটা সমস্যায় ছিল যখন শ্রদ্ধেয় প্রণব মুখোপাধ্যায় দলের প্রদেশ সভাপতি থেকেছেন। সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা বলে সেই সময় জাতীয় নেতা প্রণববাবু পাকিস্তান থেকে নিকারাগুয়া অথবা চিন থেকে আমেরিকা অথবা বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক – ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন, প্রদেশ কংগ্রেসের খুঁটিনাটি বিষয় ব্যতিরেকে।
প্রদেশ কংগ্রেসের খুঁটিনাটি নয়, প্রণব মুখোপাধ্যায় অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন বিদেশনীতি ও অর্থনীতির মতো বিষয়ে। (ফাইল: ছবি পিটিআই)
কিন্তু অধীর চৌধুরী একটা অন্য ধরনের গলার কাঁটা কংগ্রেসের পক্ষে। লোকসভার নির্বাচন যদি তাঁর অনুকূলে যায় তা হলে তিনি স্বমহিমায় থাকবেন এবং তিনি স্বমহিমায় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জেলার পরস্থিতি সামলাবেন এবং স্বমহিমায় নিজের ইচ্ছা ও অনিচ্ছা প্রকাশ করবেন।
ব্যক্তিগত ভাবে এটি অধীর চৌধুরীর সাফল্য নিশ্চিত। কিন্তু দলীয় স্তরে কংগ্রেস এই কাঁটা না ওগরাতে পারবে, না গিলতে পারবে। নিজের দলের এত দীর্ঘ দিনের এক সাংসদের গতিবিধির উপর এবং শরীরী ভাষা বা মুখের ভাষার উপর দলের যদি কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকে তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই সেটা শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে মাথাব্যথার কারণ, বিশেষ করে ইদানীং কালে যে ভাবে গেরুয়া শিবিরের টানাপোড়েনের একজন অংশীদার হিসাবে বারবার অধীর চৌধুরীর নাম উঠে এসেছে সে ক্ষেত্রে দলের প্রথম প্রথম প্রচারসভাটি এই প্রবীণ সাংসদের এলাকায় না করে রাহুল গান্ধ স্বযং কোনও ইঙ্গিত দিলেন কিনা এবং সেই সভায় উপস্থিত না থেকে উল্টোদিকে অধীর চৌধুরী কোনও ইঙ্গিত দিলেন কিনা এটা যথেষ্ট গভীর গবেষণার বিষয়।