উপনির্বাচনের ফল দিয়ে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন বিচার করা যাবে না
মোদী হঠলেই যদি দেশ বাঁচবে, তা হলে ২০১৪ সালের আগে দেশ তো বেঁচেই ছিল!
- Total Shares
ভারতের রাজনীতি থেকে বিজেপির বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। কবে এবং কোথায় বেজেছে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু ঘণ্টার আওয়াজ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। চারদিকে অঙ্ক কষা শুরু হয়ে গেছে। আশায় বুক বেঁধেছেন অনেকে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচন এমনই একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে একদল বিশেষজ্ঞের অভিমত। তাল মিলিয়ে বিবৃতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা: মোদী হঠাও দেশ বাঁচাও বা বিজেপি আরএসএস হটাও দেশ বাঁচাও।
দেশ বাঁচাতে হবে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে মরা এবং বাঁচার সংজ্ঞাটা কী। মাঝের পাঁচটা বছর আর এখনকার চারটে বছর বাদ দিলে দেশ বেঁচে ছিল। এখন দেশটা মৃত্যুপথযাত্রী। বেঁচে থাকার অক্সিজেন জুগিয়েছে কর্নাটকে সরকারগঠন অথবা সাম্প্রতিক উপনির্বাচনের ফলাফল। কারা জুগিয়েছেন এই অক্সিজেন? সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, তেজস্বী যাদব, কুমারস্বামী, চন্দ্রবাবু নায়ড়ু, চন্দ্রশেখর রাও, শরদ পওয়ার, অজিত সিং, ওমর আবদুল্লা। আরও কেউ কেউ থাকতে পারেন। এঁরাই যখন অক্সিজেন জুগিয়েছেন প্রতিপ্রাদ্য বিষয় হল এঁরাই দেশটাকে বাঁচাবেন।
কর্নাটকে জয়ের পরে বিরোধী ঐক্যের ছবি
এবার প্রশ্ন হচ্ছে এঁরা কারা এবং এঁদের কাছে ‘দেশ’ শব্দটির প্রকৃত স্বরপ কী। দেশ একটা ভৌগোলিক সীমারেখা, দে.শ একটা ইতিহাস, দেশ একটা ঐতিহ্য, দেশ একটা সংস্কৃতি, দেশ একটা আত্মসম্মান, দেশ একটা জাতীয় চরিত্র। জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশ একটা অন্তর্নিহিত অনুভূতি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে আজকের ভারত। মনীষীরা বার বার ভারতের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।” কিন্তু ‘আমার দেশ’ – এই অনুভূতি কি ভারতে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়? হয় না। হওয়ার মতো কোনও ঐতিহাসিক প্রয়াস ঘটেনি ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট থেকে।
বিবিধ ভারতের মিলনসূত্রটা কেথায়, কী ভাবে মালাটা গেঁথে ওঠা সম্ভব, এবং কোন রাজনৈতিক-সামাজিক প্রয়াস হয়েছে নতুন বারত গড়তে গিয়ে গত সাত দশকের যাত্রাপথে? হয়নি। পরিবর্তে ‘বিবিধ’ চরিত্রটাকে ভেঙেচুরে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা জন্য।
অখিলেশ-মায়াবতী-অজিত জোটবদ্ধ হয়ে উত্তরপ্রদেশে রাজনৈতিক বাজি মাত করতে পারেন, লেজুড় হিসাবে রাহুল গান্ধী, তাহলেই দেশটা বেঁচে যাবে। দেশ কি শুধুই কয়েকটা সংখ্যা মাত্র? ২৭২-এর বেশি বা কম?
কৈরানায় জয় এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিরোধীদের
কেন ২০১৪ সালে ‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখিয়ে দেশবাসীকে মোহগ্রস্ত করতে পেরেছিলেন মোদী? আজকের সংজ্ঞা অনুসারে দেশ তখন প্রাণবন্ত ছিল। তা হলে দেশবাসী কেন নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করল? দেশবাসী কি শুধু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের মানদণ্ডে সরকার ভাঙাগড়ায় সিদ্ধান্ত নেয়? তাই যদি হয় তা হলে রাহুল-অখিলেশ-মমতা-তেজস্বী দেশবাসীর কোন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে পারবেন? তেলের দাম কমিয়ে দেওয়া? রান্নার গ্যাসের দাম কমিয়ে দেওয়া? এক ধাক্কায় অনেক টাকা বেতন বাড়িয়ে দেওয়া? ডাল-সবজি-আলু-পেঁয়াজের দাম কমিয়ে দেওয়া? কোটি কোটি বেকারের চাকরির সুযোগ করে দেওয়া? সঞ্চিত টাকায় সুদের হার বাড়িয়ে ঋণের উপরে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া? কৃষকের ঋণ মকুব করে ফসলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া? এটার কোনওটিই কি সম্ভব? দেশবাসী এই আশাতেই মোদী জমানার সূচনা করেছিল এবং এই নিরাশায় মোদী জমানার অবসান ঘটবে?
বাস্তবে নরেন্দ্র মোদী একটা প্রতীক মাত্র। ভারতে এখন দুটি বিপরীতধর্মী ভাবনার সঙ্ঘাত চলছে, ১৯২৫ সালে নাগপুরে একটা ভাবনার সূচনা হয়েছিল। গত প্রায় ১০০ বছরে সেই ভাবনা শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে মহীরূহে পরিণত হয়েছে। ভালো কি মন্দ সে তো পরের কথা। কিন্তু কংগ্রেস-বামপন্থী-সমাজবাদীদের এখন লড়াই এই বিপরীতধর্মী বাবনার মোকাবিলা করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। কংগ্রেস-বামপন্থী-সমাজবাদীদের যে একাধিপত্য স্বাধীনোত্তর ভারতে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারই তারই সমান্তরাল শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে জনসঙ্ঘের সূচনা। তার প্রতীক হিসাবে প্রথম সারিতে দীর্ঘদিন প্রতীয়মান ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী ও অটলবিহারী বাজপেয়ী।
এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে এই দুই নেতৃত্ব যে পথে নাগপুরের ভাবনা বাস্তবায়িত করেছেন তার সঙ্গে মোদী এবং শাহ কোনও সঙ্ঘাতে এগোচ্ছেন। সবই সময়ের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। কংগ্রেস-বামপন্থী-সমাজবাদীদের ব্যর্থতা যে তারা গত ছয় দশক ধরে ভোটের অঙ্ক কষতে ব্যস্ত থেকেছে যার মধ্য থেকে নাগপুরের কৌশলীরা নিঃশব্দে দেশের মনস্তত্ত্বকে দুটো নির্দিষ্ট ভাবনায় দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে।
২০১৯ একটা সময়মাত্র। ২৭২ একটা সংখ্যামাত্র। সমাজবদলের দর্শন নিয়ে যাত্রা শুরু করে নাগপুর এখন নিশ্চিত যে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, অন্তত ভারতের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কংগ্রেস-বামপন্থী-সমাজবাদীরা এই তীব্র গতির বিপরীতধর্মী ভাবনার সঙ্গে দৌড়ে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করছে আপ্রাণ। জয়পরাজয় কোনও সংখ্যা দিয়ে বিচার্য নয়, ২০১৯ আছে। তারপর আবার ২০২৪-ও আছে অথবা ২০২৯ বা ২০৩৪। সময় আসবে, সংখ্যা আসবে, কিন্তু সংঘাতের অভিমুখ নিশ্চিত।